নকশী কাঁথার মাঠের কবি
২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম
বাংলাদেশের নির্মল প্রাকৃতিক দৃশ্যে যেখানে সোনার মাঠ যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত, সেখানে কিংবদন্তি কবি জসীমউদ্দীন গ্রামীণ জীবনের নির্যাসকে অমর করে রেখেছেন তাঁর মর্মস্পর্শী কথায়। তার অনেক মাস্টারপিসের মধ্যে একটি আবেগের একটি প্রাণবন্ত ট্যাপেস্ট্রি হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে, যা নকশী কাঁথার মাঠ।
নকশী কাঁথার মাঠ ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য আখ্যানকাব্য।। বাংলা কবিতার জগতে যখন ইউরোপীয় ধাঁচের আধুনিকতার আন্দোলন চলছিল তখন প্রকাশিত এই কাব্যকাহিনী ঐতিহ্যগত ধারার শক্তিমত্তাকে পুনঃপ্রতিপন্ন করে। এটি জসীমউদদীনের একটি অমর সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত। কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়ে বিশ্বপাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যোপন্যাসটি রূপাই ও সাজু নামক দুই গ্রামীণ যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। এই দুজনই ছিলেন বাস্তব চরিত্র।
নকশি কাঁথা, একটি ঐতিহ্যবাহী সূচিকর্ম, শুধুমাত্র গ্রামীণ মহিলাদের শৈল্পিকতারই নয়, দৈনন্দিন জীবনের বুননে বোনা গল্পগুলিরও প্রতীক। জসীমউদ্দীন তার কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম এবং ঐতিহ্যের সুতোয় বিরামহীনভাবে বর্ণনা করেছেন।
‘বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী,
উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।’
কাব্যের নায়ক-নায়িকা তথা রূপাই-সাজুর বাসস্থান হিসেবে জলির বিলের দুপাশে অবস্থানরত, নামহীন এ-গাঁও আর ও-গাঁওয়ের বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক জীবনে ওঠা-বসা, মেলামেশা, জীবিকানির্বাহ সূত্রে গড়ে ওঠা অন্তরঙ্গতা ও বিরোধের ইঙ্গিত দিতে এ রাখালী গান সূত্রধরের ভূমিকা রেখেছে।
‘এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাঁশের বাঁশীর সুরে,
ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে!
এ-গাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান,
ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান।’
এই চিত্রণ সৃষ্টি করা হয়েছে একটি কবিতা অথবা গানের মাধ্যমে, যা গাঁওবাসীদের জীবন এবং তাদের সাংস্কৃতিক দিক প্রতিফলিত করছে। সেই অনুভূতি ও ভাবনার প্রকাশের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে রাতে বাঁশীর সুর তার শান্তি এবং বিশ্রাম দেয়, কিন্তু সে তার জীবনের অন্যতম দিকে যায় যখন তার মন ভাঁজে যায় গাঁয়ের মেয়ের সাথে সম্পর্কের সাথে।
‘দেখেছি এই চাষী মেয়ের সহজ গেঁয়ো রূপ,
তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ!’
এই লাইনগুলির মাধ্যমে, সুন্দর একটি মেয়ের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা হয়েছে, এবং তুলসী ও ফুলের মঞ্জরীর মাধ্যমে এর সৌন্দর্যের সাথে দেবতার পূজা ও ধূপের সুবর্ণ ছবি তৈরি হয়েছে। এটি প্রকৃতপক্ষে কবিতা বা সঙ্গীত রচনার সময় সৌন্দর্য্যের উচ্চারণে ধরা হয়েছে, এবং এর মাধ্যমে একটি রোমান্টিক বা ভাবনামুক্ত ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছে।
জসীমউদ্দীন ‘পল্লী কবি’ বা গ্রামীণ বার্ড হিসাবে সমাদৃত, তার কবিতায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সৌন্দর্য ধারণ করার এক অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল। নকশী কাঁথার মাঠ কবিতাটি কৃষিপ্রধান প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে তার গভীর সংযোগের একটি প্রমাণ, যেখানে বপন এবং ফসল কাটার ছন্দময় চক্র জীবনের চক্রকে প্রতিফলিত করে। নকশি কাঁথার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জসীমউদ্দীন কৃষকদের দৈনন্দিন জীবন, তাদের পরিবারের সুখ-দুঃখ এবং দারিদ্র্যের রূঢ় বাস্তবতাকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। চিত্রকল্প ও গীতিময় ভাষার মাধ্যমে কবি এঁকেছেন কৃষকের ক্ষেতে মেহনত, তাদের ঘাম উর্বর মাটির সাথে মিশে যাওয়া এবং সোনালী ফসল স্বপ্নের সাগরের মতো দুলছে।
‘কৃষানের গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো
এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো।
আজকে তাহার পাড়া বেড়ানোর অবসর মোটে নাই
তার খাড়–গাছি কোথা পড়ে আছে কেবা খোঁজ রাখে ছাই!
অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা,
বনের পশু মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা।
দাঁড়ায় শুইয়া কৃষান ঘুমায় কৃষানের কাজ ভারি,
ঢেঁকির পারেতে মুখর করিছে একলা সারাটি বাড়ি।’
নকশী কাঁথার মাঠ কবিতাটিতে প্রেম, ক্ষতি এবং স্থিতিস্থাপকতার গল্প বুনেছে। গ্রামীণ জীবনের সরলতাকে এমন এক সমৃদ্ধি দিয়ে চিত্রিত করা হয়েছে যা ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে, কবিতাটিকে সর্বজনীনভাবে সম্পর্কিত করে তুলেছে।
নান্দনিক সৌন্দর্যের বাইরে, নকশী কাঁথার মাঠ কবিতাটি বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতিফলন হিসেবে সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। তার শ্লোকের মাধ্যমে গ্রামীণ সম্প্রদায়ের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান এবং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে জীবন্ত করে তোলেন।
‘স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,
তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে।
একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,
প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত ।’
এই লাইনগুলির মাধ্যমে কবি সাজুর বাড়ি থেকে দূরে থাকা একক স্ত্রীর জীবনের একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ চিত্রিত করেছেন। সাজু বাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারে এবং একা থাকা সময়ে তার বুকখানি হতে পারে একটি উপাস্য বা শরণ। কবি এখানে সাজুর জীবনের সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের পাশাপাশি বুকখানির কষ্ট ও শ্রম উপস্থাপন করছেন।
তার মা সকলেই তার পাশে রয়েছে, এটি হতে পারে একটি অত্যন্ত সহানুভূতি ও সমর্থন প্রদর্শন করে এবং গ্রামীণ সমাজের একটা রীতিনীতি ফুটে উঠেছে যা একটা মেয়ের জীবনে গুরত্বপূর্ণ দিক।
জসীমউদ্দীনের লোক ঐতিহ্য, উৎসব এবং ভূমি ও জনগণের মধ্যে সহানুভূতিশীল সম্পর্কের চিত্রায়ন কবিতায় গভীরতার স্তর যোগ করে। নকশি কাঁথা একটি সম্প্রদায়ের সম্মিলিত চেতনার রূপক হয়ে ওঠে, প্রতিটি সেলাই একটি ভাগ করা স্মৃতি বা আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে।
মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী
“মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি।”
আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই,
সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই।”
‘মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি ।’
এখানে ভালোবাসার মূল্যবোধকে উপস্থাপন করে। এটি একটি প্রেমভরা বাণী যা কাউকে আবেগপূর্ণ এবং আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করেছে।
‘দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই, সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই ।’ সাধারণভাবে ধার্মিক ভাবনার প্রতি মধুর স্বীকৃতির রূপে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি একটি ভক্তি অথবা আত্মনির্ভরের মাধ্যমে দীন এবং দুঃখ অবসান করার করার কথা বলা হয়েছে।
নকশী কাঁথার মাঠ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে অমর এক অংশ হিসেবে মনে থাকবে, যার মাধ্যমে ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং মানবিক ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। নকশী কাঁথার মাঠ কবিতাটি আবেগের গভীরতার জন্য পরিচিত। এটি মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখকে অন্বেষণ করে, প্রেম, বিচ্ছেদ এবং গ্রামীণ পরিবেশে মানুষের মুখোমুখি হওয়া সংগ্রামের মতো বিষয়গুলিকে স্পর্শ করে। জসীমউদ্দীনের সহানুভূতিশীল তার চরিত্রগুলো পাঠকদের মনে অনুরণিত হয়।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান