একাত্তরের সেই ছেলেটি

Daily Inqilab অয়েজুল হক

২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম

সোহানকে হামিদ সাহেব কিশোর বলে ডাকেন। দিনরাত কিশোর কিশোর বলে চিতকার করেন। সোহান মাঝে মাঝে রাগ করে বলে, আমার নাম সোহান। তুমি আর কিশোর বলবে না।
হামিদ সাহেব মুখে হাসি নিয়ে বলবেন, আট দশ বছরের ছেলেকে কেউ যুবক বলে না। কিশোর বলে।
-বেশ, আশি বছরের বুড়ো মানুষকে আমি আর দাদু বলবো না। বুড়ো বুড়ো করে ডাকবো।
হামিদ সাহেব গালভরা হাসি দেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এই সোহান ছেলেটা তার একাকীত্বের অভাব দূর করছে। করোনার দীর্ঘ ছুটিতে সে প্রায় সারাক্ষণ হামিদ সাহেবের পাশেই ছিল। দাদুর সাথে তার গল্পের যেন শেষ নেই। দীর্ঘ দেড় বছর পর স্কুল খুলেছে। পরীক্ষা হবে। দীর্ঘদিনের রেশ কাটিয়ে এ এক আনন্দ উৎসব। স্কুল খোলায় হামিদ সাহেবের আনন্দ যেমন আছে একটা লুকানো কষ্ট ও আছে। সোহান কে কাছে না পাওয়ার কষ্ট। সোহান সারাদিন স্কুল নিয়ে ব্যস্ত, রাতে পড়াশোনা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নামার পরে সোহান হাজির হয়। কাল স্কুল বন্ধ দাদু আজ খুব মজা হবে।
হামিদ সাহেব হাসেন, আজ তোকে বিজয়ের গল্প শোনাবো।
-বেশ শুরু কর দাদু।
হামিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করেন, শোন আমি ছিলাম কমান্ডার। তেত্রিশ জনের একটা ছোট দল। তখন তো আর মোবাইলের যুগ না। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি।
-হু।
-প্রায় সবাই বাড়িতে বলে এসেছিল, একটা দেশ নিয়ে ফিরবো অথবা ফিরবো না। একদিন গভীর রাত। তখন তো ঝোপঝাড় সবদিকে। রাস্তার অবস্থা এই খালবিল, এই রাস্তা।
সোহান হাসে। তারপর?
-সকালের আলো আসার আগেই বর্ডার পেরিয়ে পৌঁছে যাই ভারত। মুক্তি বাহিনীতে নাম লেখানোর পর মালদাহর গোরবাগানে তের চৌদ্দদিন চলে লেফট রাইট। সেখান থেকে শিলিগুড়ির পানিঘাটায় এক মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তরঙ্গপুরের কালিয়াগঞ্জে চলে ভারী অস্ত্রের ট্রেনিং, যুদ্ধের কলাকৌশল। এক নোঙ্গরে হাজার হাজার মানুষের সমাগম, খাওয়া। দুইটার খানা মিলত চারটায়।
-তোমার তো অনেক কষ্ট হতো দাদু।
-আরে কিসের কষ্ট! মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, আমার দেশ ও মানুষের মুক্তি।
জীবনের মায়া ত্যাগ করেই চলে আমাদের গেরিলা কার্যক্রম। আমরা অপারেশন করি সাত নম্বর সেক্টরের লালপুর, ভেড়ামারা, সুজানগর, ঈশ্বরদী প্রভৃতি এলাকায়। সারাদিন ইনফরমেশন, রাতে চোরাগোপ্তা হামলা করাই ছিল আমাদের কাজ।
-যুদ্ধের ট্রেনিং কেমন হয়েছিল দাদু? মাঝখানে প্রশ্ন করে সোহান।
-ট্রেনিং মানে একেবারে গেরিলা ট্রেনিং। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার সময় হামিদ সাহেবের চোখ দুটো চকচক করে। মুখে থাকে খুশির আভা।
একদিন একটা ছেলে ঠিক তোর বয়সী হবে।
-হু।
ক্যাম্পে এসে বলে, আমি যুদ্ধ করতে চাই।
ছোট ছেলে বলে ওকে আমার কাছে পাঠায়।
-কী নাম তোমার।
-আমার নাম কিশোর।
-তুমি তো বয়সেও কিশোর। তা কী বলতে চাও?
ছেলেটা কী আস্থা আর সাহসী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল জানিস?
-না।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, একটি স্বাধীন ভূখন্ড। বিজয়।
-তারপর?
কিশোর বলে, আমি যুদ্ধ করতে চাই।
আমি বলি,তুমি ছোট মানুষ। যুদ্ধ পারবে না।
কিশোর বলে, সে যদি নাই পারি আপনাদের পিছু পিছু ঘুরতে তো পারবো।
নাছোড়বান্দা। একটা গল্প বলা শুরু করে, এক রাতে তার মাকে তুলে নেওয়ার গল্প।
-কিভাবে তুলে নিল দাদু?
বলছি শোন। কিশোর তখন ঘুমিয়ে ছিল। মায়ের তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে বাড়ির বাইরে থেকে শব্দ আসছে। মেঝেতে পড়ে আছে পিতার রক্তাক্ত লাশ। সম্ভবত ধারালো অস্ত্রে জবাই করা হয়েছে। শরীর কেপে ওঠে কিশোরের। ছোট মানুষ নিজেকে সামলে যতক্ষণে বাইরে যায় ততক্ষণে তার মাকে নিয়ে চলে গেছে। কিশোর জানতে পারেনি তার মায়ের অবস্থা।
-আজও জানেনা?
হামিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,সেটা আমি বলতে পারবো না।
-তারপর?
-পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল রাজাপুরের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল। সেখান থেকেই তারা অপারেশন চালাত।
নভেম্বরের প্রথম দিকে প্রধান প্রধান সড়ক পথ গুলো বন্ধ হয়ে যায়।
-কিভাবে!
-অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম বড় বড় ব্রিজ গুলো।
-ওরা আসতো কিভাবে?
-ওই যে বললাম, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা সিদ্ধন্ত নিলাম, এবার ওদের সবচেয়ে বড় ঘাটিতে আক্রমণ করবো।
-রাজাপুরের মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে?
-হু।
-আচ্ছা।
-সেদিন আমাবস্যার ঘন কালো অন্ধকার রাতে আমরা তিন দলে ভাগ হয়ে ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাই।
-সেই ছেলেটা -কিশোর?
-হু।
-ও তো সবসময় আমার সাথে সাথে ছায়ার মতো লেগে থাকতো।
- সেদিনও ছিল?
-ছিল, তবে আমরা আক্রমণ শুরু করার পর ওকে আর দেখিনি।
-আচ্ছা।
-আমরা আক্রমণ শুরু করতেই ওরা ভেতর থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। তিনতলা বড় বিল্ডিং। আমাদের ধারণা ছিল ওরা বেরিয়ে আসবে। সেটা না করে ওরা বিল্ডিংয়ের দোতলা, তিনতলা, ছাদ থেকে নিচে গুলি ছোড়ার উৎস চিহ্নিত করে হামলা করছিল। ওদের সুবিধাজনক অবস্থায় আমরা কিছুটা পিছনে সরে আসতে বাধ্য হই। পয়তাল্লিশ মিনিট গোলাগুলির পর হঠাৎ অবাক করা ঘটনা ঘটে যায়।
কী!
নিচতলায় কয়েকটা গুলির শব্দ। আর্তনাদ। তারপর বিকট বিস্ফোরণ। একটা প্রথমে তারপর একটার পর একটা বিস্ফোরণ হতে থাকে। কয়েক মিনিটে পুরো বিল্ডিং ধ্বসে পড়ে।ভেতর থেকে প্রথমে আর্তনাদ এরপর শুনশান নিরবতা।
সোহান বড় বড় চোখ করে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলে, তারপর!
-ওদের সলিল সমাধি ঘটে যায়।
-এটা কিভাবে হলো দাদু?
-ওই যে কিশোর।ও গিয়েছিল চুপিচুপি।গোলাগুলির ভেতর চুপটি করে নিচতলায় ঢুকে প্রথমে হত্যা করেছিল গুলাবারুদ রক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকদের। তারপর সেখানে মাইল বিস্ফোরন ঘটায়। মাইনের সাথে ওদের অস্ত্রাগারে থাকা বিস্ফোরক গুলো একে একে বিস্ফোরিত হয়।মাটির সাথে মিশে যায় পুরা ভবন। -এটা যে কিশোর করেছে কিভাবে বুঝলে দাদু?
দাদুর চোখটা অশ্রুসিক্ত হয়।ভারী গলায় বলেন,ক্যাম্পে ফিরে ক্লান্ত দেহে যখন ঘুমাতে যাব, দেখি বালিশের নিচে একটা কাগজ। খুলে দেখি কিশোরের কাচা হাতের লেখা, স্যার আমি যদি আজ হারিয়ে যাই কষ্ট পাবেন না। আমি আমার মাকে নিয়ে একদিন ঠিকই ফিরে আসবো।
-এসেছিল? -না, আসেনি এখনো।আসেনি বলেই আমি তোর ভেতর কিশোর কে খুঁজি।
ফাহিমের চোখ দুটো চকচক করে।সাহসী গলায় বলে,আমি ভয় পাব না। অনেক বড় হব। দাদু তুমি দোয়া কর, আমি তোমার একাত্তরের সেই ছেলেটা।কিশোর। কথা শেষ করেই ফাহিম কেন যেন চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।হামিদ সাহেব ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফাহিমের ভেতর খুঁজে পান কিশোরের প্রতিচ্ছবি।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি