মুনশী মেহেরুল্লাহ ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব
২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১০ এএম
অবিভক্ত বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতেরএকজন অবিসংবাদিত সিংহ পুরুষ মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। তিনি একাধারে বৃটিশ বাংলার অন্যতম প্রধান বাগ্মী, ইসলাম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, বতার্কিক, মরদে মুজাহিদ এবং কবি ছিলেন। যতদূর জানা যায়, তার উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হয়নি। কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত মেহেরুল্লাহ তাঁর তীক্ষবুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য সমকালীন সমাজে ব্যাপক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তৎকালিন উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি মদদপুষ্ট খ্রিস্টান পাদ্রীদের ধর্ম প্রচারের গতির বিরুদ্ধে তিনি প্রায় একাই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে সমস্ত অপশক্তির ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেন। আর এজন্য ইসলামের সেবায় বাংলা এবং আসামসহ বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। তিনি ইসলাম ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের উপর গ্রন্থও রচনা করেছেন। আধুনিক বিবেচনায় তাকে তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের একজন প্রতিভাবান ছাত্র এবং ওস্তাদ বলা যায়। এজন্য জ্ঞানীমহল থেকে তাকে ‘বাগ্মীকুল তিলক’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল।
মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর যশোর জেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে অল্প বয়সেই মেহেরুল্লাহকে সংসারের হাল ধরতে হয়। ইংরেজ বাবুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি যশোর জেলা বোর্ডে একটি ছোটখাট সরকারি চাকুরি পান। কিন্তু চাকুরি নামক গোলামীর জিঞ্জির তার ভালো লাগেনি। তাই স্বাধীনচেতা মেহেরুল্লাহ কিছুদিন পরেই চাকুরি ছেড়ে দেন এবং যশোরের দাড়টানা মোড়ে দর্জির দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এই পেশায় তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। জেলা ম্যাজিট্রেট থেকে শুরু করে অনেক মিশনারিরাও তার কাস্টমার ছিলেন। তারপর জেলা ম্যাজিট্রেট খুশি হয়ে তাকে দার্জিলিং নিয়ে যান এবং সেখানে দোকান করে দেন।
হাদিসে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য বিদ্যা অর্জন করা ফরজ। তাই জ্ঞানার্জনের প্রতি তার ছিল দুর্বার আকর্ষণ। কাজের ফাঁকে তিনি বই পড়তেন। যশোরের দাড়টানা মোড়ে দোকনে বসে তিনি দেখতেন মিশনারিদের তৎপরতা। মিশনারিরা সেবার নামে নি¤œবর্ণের হিন্দু এবং গরিব মুসলমানদেরকে ধর্মান্তরিত করত। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে আল্লাহ, রাসুল ও কোরআন সম্পর্কে বিষোদগার করত। খ্রিস্টান মিশনারিরা নানাবিধ অবান্তর এবং অবাস্তব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করত। এমনকি তার দোকানে বসেই মিশনারিরা প্রায়ই তাকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ছবক দিত এসব তার মোটেই ভালো লাগেনি। অতঃপর খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
তখন থেকেই শুরু হয় তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে মুন্সি মেহেরুল্লাহর কঠোর অধ্যয়ন। এসময় তিনি আল কুরআন, হাদিস, বাইবেল, বেদ, গীতা, ত্রিপিটক এবং উপনিষদসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি জানতেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের জ্ঞান না থাকলে বিভিন্ন ধর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয়। খ্রিস্টানদের অভিযোগগুলো কী এবং সেগুলো খন্ডনের দলিল কী এ বিষয়ে তিনি ব্যাপক পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি দার্জিলিং থেকে যশোর ফিরে আসেন এবং মিশনারিদের বিরুদ্ধে একপ্রকার তর্কযুদ্ধ শুরু করেন। কিছুকালের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেন তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের এক তুখোড় বক্তা।
এই সময়ে মেহেরুল্লাহ সর্বপ্রথম ‘খ্রিস্ট্রীয় ধর্মের অসারতা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। প্রতিদিন বিকালে যশোরের হাটে দাঁড়িয়ে নিজেই তা বিক্রি করতে শুরু করেন। বিক্রয়কালে বইটি সম্পর্কে পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি যে কথাগুলো বলতেন তা এতটাই বাগ্মীতাসুলভ ছিল যে, তা শোনার জন্য লোকজন ভিড় করত এবং তা এক সময় জনসমাগমে পরিণত হতো।
এভাবেই তিনি পবিত্র ধর্ম ইসলামের সার্বজনীনতা ও খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা নিয়ে দ্বীনি তাবলীগের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার সুনাম পুরো যশোরে ছড়িয়ে পড়ে। । এরপর তিনি খ্রিস্টানদের সমস্ত অপপ্রচারের জবাব দিতে ছুটে চলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের অলিতে গলিতে। এ সময় করকাতার নাখোদা মসজিদে আরো দুইজন আলেমের সাথে বৈঠক করে তিনি গঠন করেন ‘নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি’। সমিতির পক্ষ থেকে মেহেরুল্লাহকে বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দেয় হয়। এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, মুন্সী জমির উদ্দিন নামে এক মুসলিম ব্যক্তি, পাদ্রিদের প্ররোচনায় পড়ে খ্রিষ্টাধর্ম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি এলাহাবাদের ডিভিনিটি কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে রেভারেন্ড জন জমির উদ্দিন নাম ধারণ করেন। পরিতাপের বিষয় এই যে, পাদ্রি জমির উদ্দিন ইসলাম ও কোরআনের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। তখন মুনশী মেহেরুল্লাহ তার সাথে এক বিতর্কে লিপ্ত হন এবং মুন্সি মেহেরুল্লার ক্ষুরধার যুক্তি এবং প্রমাণের কাছে তিনি পরাজিত হয়ে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় অল্প সময়ের মধ্যে মুন্সি মেহেরুল্লাহর খ্যাতি এবং পা-িত্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শত শত মানুষ তার সাথে সাক্ষাৎ লাভ করে নিজেকে ধন্য করতে লাগলেন। অত:পর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করেন। উল্লেখ করার মত একটি ঘটনা হল, ইংরেজরা এক সভায় ভারতবর্ষের মানুষকে বলেছিলো তোমাদের দেশের মানুষ-বাটু, লম্বা, খাটো, বড়, কালো, ধলো কেন? আর আমাদের দেশের সব মানুষ সাদা। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যখন আমাদের সুধীমহল হিমশিম খাচ্ছিল, তখন ইংরেজদের এই প্রশ্নের প্রতিউওরে তিনি বলেনঃ ‘শুওরক্য বাচ্ছা এক কিছিম হ্যায়- টাট্টু ক্যা বাচ্ছা হ্যারেক রকম হ্যায়’।
তাঁর লেখা প্রতিটি বই এতই পান্ডিত্যপূর্ণ ও সুলিখিত যে, বিজ্ঞ পাঠকমাত্রকেই তা অভিভূত করে ফেলে। তার তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাহায্যে তৎকালীন উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি মদদপুষ্ট খ্রিষ্টান পাদ্রিদের ধর্ম প্রচারের গতিকে বিঘিœত করেছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
মুনশি মেহেরুল্লাহ তার তাবলিগি মিশনের সহায়ক হিসেবে যে সব বই লিখেছেন তা হল: খৃষ্টীয় ধর্মের অসারতা, মেহেরুল ইসলাম, বিধবা গঞ্জনা, হিন্দু ধর্ম রহস্য বা দেবলীলা, রদ্দে খৃষ্টান ও দলিলুল ইসলাম
পান্দেনামা এবং জওয়াবে নাসারা। ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ৭ মে ১৯০৭ খ্রি: পরলোকগমন করেন। বর্তমানে সুহৃদ প্রকাশন (৪৫, বাংলাবাজার, ঢাকা) হতে দু’খ-ে মুন্সী মেহেরউল্লাহ রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও মুন্সী মেহের উল্লাহ রিসার্চ একাডেমি হতেও তার বেশ কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর তার অগাধ পা-িত্য একটা সময় তাকে খ্যাতির শীর্ষস্থানে আরোহন করায়। তার উপর সরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু অসমসাহসী এই মর্দে মুজাহিদ ছিলেন একজন অকুতোভয় ইসলামের সৈনিক। কোন ভয়ভীতি তাকে তার অভীষ্ট লক্ষ থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত করতে পারেনি। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। সেইসাথে আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে, ইসলামের এই মর্দে মুজাহিদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম তেমন কিছুই জানে না। হয়ত অনেকেই তার নামটি পর্যন্ত জানে না। যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি করি, তার সম্পর্কে জানার জানা, তার লেখা গ্রন্থ অধ্যয়ন করা আমাদের সকলের একান্ত কর্তব্য।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান