ঢাকা   মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নতুন ধারার ইতিবৃত্ত

Daily Inqilab হাফিজ মুহাম্মদ

০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৪, ১২:১১ এএম

শত বছরের সাহিত্যের পালাবদলে নতুন ধারা সৃষ্টি। যা বাংলা সাহিত্যে লেটেস্ট ধারা হিসেবে পরিচিত। মূলত শামসু- গুণের কবিতা পাঠের মাধ্যমে হঠাৎ গভীর রাতে ২০২১ সালে ঘুমের মধ্যে নতুন ধারার স্বপ্ন দর্শন। এর কিছুদিন পরেই বেশ কিছু কবি লেখক ফেসবুক গনমাধ্যমে ‘‘জয়তু নতুন ধারা’’ স্লোগান তোলেন। কাজেই এই নতুন ধারা দৈবিক ভাবে এসেছে। এজন্য নতুন ধারা এক অভিনব ইতিহাস তৈরি করে ২০২১ সালে, ঢাকায় ফেসবুক নতুন ধারার ইস্তেহার ঘোষণার মাধ্যমে। এরপর সিলেট থেকে নিজ খরচে হোসেন আহমেদ চৌধুরী ইস্তেহারটি ছাপেন। এটাই এদেশে ৯৪ বছর মধ্যে শিল্প সাহিত্যের প্রথম ইস্তেহার। আর এটা নির্মাণে কি প্রকার মেধা ও পরিশ্রম লেগেছে, ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন। মূলত ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, বড় কবিরাই অভিনব ইস্তেহার তৈরি করেছেন এবং পৃথিবীর কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। যেমন: কবি শাল বোদলেয়ার, কবি আদ্রেবেতো...। গৌণ কবিদের দিয়ে কখনো ইস্তেহার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ইদানিং নতুন ধারার কবিতায় বহু ভাষিকতা থাকার কারণে সমাজে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এই নতুন ধারার মূল উপজীব্য হলো: সমাজের প্রান্তিক মানুষ, স্বজন-বন্ধু, সম্পর্কবাচক শব্দ, গ্রামবাংলার প্রকৃতি, চিত্রকল্প, পুরাকীর্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রগতি, দর্শন নির্ভরতা ও ধ্বনিতে সাংগীতিক বিন্যাসসহ প্রভৃতি বিরাজমান থাকে। নতুন ধারায় মানব জীবনের ছোট ছোট সুখ, দুঃখ, দৈনন্দিন ঘটনা, সামাজিক সমস্যার, বিভিন্ন দিক থাকবে। কবিতার গঠন হবে সংক্ষিপ্ত এবং রস হবে প্রগাঢ়। আধুনিক কবিতার মত অতটা ব্যঞ্জনাময় আর জটিল হবে না কোন দুর্বোধ্যতা এখানে কাজ করবে না। প্রমিতের সঙ্গে আঞ্চলিকের একটা সংমিশ্রণ থাকবে। নতুন ধারা কবিতার মূল উদ্দেশ্য হলো: ভারত, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাগুলোকে এনে প্রমিতের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটানো। কাজেই বাংলা ভাষার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

তাছাড়া নতুন ধারায় আস্তিক, নাস্তিক, ধর্ম, অধর্ম, বাস্তব, অলৌকিকতা যোগ করা হয়েছে। যা কোনো আধুনিক কবিতার ধারের কাছেও নেই। মূলত ২০ থেকে ৩০ ভাগ লোকাল শব্দ থাকলে তার সঙ্গে প্রমিত শব্দ ৭০ ভাগ থাকলে তখন নতুন ধারা মানান সই হবে। ফলে নতুন ধারা একটি পূর্নাঙ্গ সার্থকতা লাভ করবে। কাজেই কবিতার দেহে এবার নতুন পোশাকের সমৃদ্ধ আবরণ ঢেকে যাবে। যার হাওয়া নির্মল। গ্রামীণ চিরাচরিত কোল ঘেঁষে শহুরে তান্ডবে গড়া কবিতার নতুনা চিত্রপট। যা ছিল অনুপস্থিত আজ তা দৃশ্যমান। ঘনিষ্ঠজনদের ঘনিষ্ঠতা, রূপ, রস, উপমা, অলংকারের কাব্যিকতা প্রতীয়মান হিসেবে গণ্য করা হয়। নতুন ধারায় প্রভাবিত হয়ে নিয়মিত লিখছেন এমন আরো কয়েক জন কবির কবিতার চুন্বক অংশ তুলে ধরছি যাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক কবিগণও রয়েছে।

‘ফোড়ন ওঠার ঝাঁজ দেইখ্যা লতা মুচকি হাসে
পরানের পোলার জিভের স্বাদ গ্যাছে
তাই লতা আজ সাধ বদল করব
স্বাদ থেকে সাধ জিভ থাইক্কা একদম মনে।’
(লতা কাহিনী- উত্তম কুমার দাস)
‘তোর্ষার ঘাটে রোজ খেয়া বায় মধুরানাথ দাস
তবুও তার ঘরপোড়া মনডা পইড়া থাকে সেই
টোক নয়ানবাজারেরং পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে
সাত পুরুষের ইজারার ঘাট ছাইড়া আইছে কবে
তবুও মনে আছে কাশেম চাচা, সালেমার কথা।’’

(খেয়া ঘাটে ওঠে গান- উৎপলেন্দু পাল)
‘‘বাগে, য্যান এক অটোমেটিক গ্রিনহাউস।
হের লগে মাঠের পর মাঠ ভাঙে,
রাতের পর রাত জাগে, দোয়া মাগে মান্নত করে ফকির।’
(বশির শেখ ম্যাঘ ধরততে চায়- কিংকর দাস)
কাজেই নতুন ধারার কবিতায় কোনো জটিলতা নেই, একদম সরল ও সোজা। এখানে ডান-বাম সকলের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশের টিভি নাটকের ভাষা কোলকাতার দর্শকরা ভালো ভাবে বুঝতে পারে। এজন্য নতুন ধারার ভাষা সে রকম বোধগম্য হবে। এ যাবত আমাদের ভারতবর্ষে সাহিত্যের যত ইস্তেহার ঘোষণা করা হয়েছে, তা সবই বিদেশ থেকে ধার করা সম্পদ। কিন্তু নতুন ধারা কোনো ধার করা নয়, এটা আমাদের সম্পদ। বহুরৈখিকতা কবিতার অনুষঙ্গ, একারণে নতুন ধারার কাঁচামালের একটু ভিন্নতা রয়েছে। সেখানে শুধু প্রান্তিক মানুষ বা বন্ধু-স্বজনের মধ্যে আল্লাপচারিত ঘনিষ্ঠতা শব্দ গুলো যেভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয় তা আধুনিক কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। উদাহরণ স্বরূপ- চা বিক্রেতা রমিজ বলছে, ও পাড়ার নাফিসার মা হাসছে...। নতুন ধারার ইস্তেহার এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে তা একক ভাবে মূল স্বত্ত্বায় নির্ভর যোগ্য হবে। আর সেখান থেকে কেউ কোনো পয়েন্ট চুরি বা কপি করলে খুব সহজেই পাঠকের দৃষ্টি অগোচরে মুহূর্তে ধরা পড়বে।

পৃথিবীতে অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, চুরি-ডাকাতি, খুন, গুম, ধর্ষণ, ব্যাভিচার, যেনা, পরকীয়া, সমকামিতার মতো জঘন্য কাজের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে প্রকৃতির সহজাত নিয়মেই বিশ্ব ব্রহ্মা-ের স্রষ্টা শতবছর পর পর রাশ টেনে ধরেন নানামুখী মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে। তাতে প্রলয় আসে প্রাণহানির। বিশ্বজুড়ে সংখ্যা দাঁড়ায় মিলিয়ন বিলিয়ন তারও বেশি।

মারিচক্রের কালচিত্রের ইতিহাস
মারিচক্রের কালচিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৩২০ সালে দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবোনিক প্লেগ, ১৪২০ সালে দ্য এওইডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ (দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়), ১৫২০ সালে গুটিবসন্ত, ১৬২০ সালে মহামারির প্রলয়ে মূর্চ্ছা যায় রক্তিম ‘মে ফ্লাওয়ার’ (স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস), ১৭২০ সালে দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই, ১৮২০ সালে ভারতবর্ষে কলেরা, যুক্তরাষ্ট্রে ইয়েলো ফিভার, ১৯২০ সালে দ্য স্প্যানিশ ফ্লু, ২০২০ সালে নোভেল করোনা ভাইরাস যার প্রাণঘাতি ক্ষয়-ক্ষতি একুশ সালেও বর্তমান। বাংলা সাহিত্যে ইতোমধ্যেই আমরা কথিত আধুনিক কিংবা উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার ১০০ বছর অতিক্রমের মুহূর্তে প্রবেশ করেছে। বাংলা কবিতার বাঁকবদল করা কবিতা ‘বিদ্রোহী’র ১০০ বছর আমরা অতিক্রম করছি এ বছরেই কিংবা কল্লোল যুগেরও একশো বছরের ক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। এ প্রেক্ষিতে বিষয়টির অবতারণা যৌক্তিক এবং সময়ের দাবী বলে সাহিত্য মহলে জোরসে আলোচনা শুরু হয়েছে। সাহিত্যের কালান্তরের পবির্তনের দিকে তাকালে দেখা যায় প্রাচীন থেকে সাম্প্রতিক- এই দুয়ের ব্যবধানের মাঝে ভাষা, শব্দ, বাক্য, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, বিষয়, গঠনসহ নানাবিধ দিকের পরিবর্তন, সংযোজন, পরিমার্জন গতিধারায় বহমান। সেই প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ পেরিয়ে আজ চলছে অতি আধুনিক ডিজিটাল যুগ। তাইতো মানুষের মুখের ভাষায় প্রাণময় আবেগিয় আত্মীয়তায়তা বাচক শব্দেই কবিতা রচনা হওয়াই যুক্তিসংগত বলে মনে করা হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একেবারে প্রচলিত মুখের ভাষায় কবিতা রচনা হচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাই।
এজন্য তথাকথিত আধুনিক কবিদের বুঝতে হবে, ভাষা বেঁচে থাকে চর্চায় আর বিলুপ্ত হয় চর্চার অভাবে। (অসমাপ্ত)


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

২৪’-এর গণঅভ্যুত্থান: প্রসঙ্গ নজরুলীয় চেতনা
একখণ্ড আক্ষেপ
সামান্থা হার্ভের বুকার জয়
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
আরও

আরও পড়ুন

কানাডাকে ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার হুমকি ট্রাম্পের

কানাডাকে ৫১তম অঙ্গরাজ্য করার হুমকি ট্রাম্পের

নেপথ্যে এক বাংলাদেশীর হতাশা

নেপথ্যে এক বাংলাদেশীর হতাশা

ফের চুক্তি লঙ্ঘন ইসরাইলের

ফের চুক্তি লঙ্ঘন ইসরাইলের

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে

চলতি মাসে পদোন্নতি পাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা

চলতি মাসে পদোন্নতি পাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা

দুই মামলায় মির্জা ফখরুলকে অব্যাহতি

দুই মামলায় মির্জা ফখরুলকে অব্যাহতি

সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হচ্ছে না

সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হচ্ছে না

ফ্যাসিস্ট হাসিনা জানতেন না কুমিল্লা খন্দকার মোশতাকের নয়, মেজর গনি-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের

ফ্যাসিস্ট হাসিনা জানতেন না কুমিল্লা খন্দকার মোশতাকের নয়, মেজর গনি-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের

৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর

৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর

পক্ষভুক্তদের রুল শুনানি আজ

পক্ষভুক্তদের রুল শুনানি আজ

সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

রাঙামাটির সাজেকে দিনভর গোলাগুলি: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জেলা প্রশাসনের

রাঙামাটির সাজেকে দিনভর গোলাগুলি: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জেলা প্রশাসনের

'বিপ্লবোত্তর ছাত্র ঐক্য' জবিতে ১২ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ

'বিপ্লবোত্তর ছাত্র ঐক্য' জবিতে ১২ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ

শেরপুরে সেনা সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গ্রেপ্তার-৭

শেরপুরে সেনা সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গ্রেপ্তার-৭

ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু

ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার

খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থাকারীরাই মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থাকারীরাই মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বে

ভিভো ভি৪০ ফাইভজি, হালকা ওজনে শক্তিশালী ব্যাটারি

ভিভো ভি৪০ ফাইভজি, হালকা ওজনে শক্তিশালী ব্যাটারি

ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি সম্প্রীতি চায় না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি সম্প্রীতি চায় না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা