তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সময়োপযোগী, ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব এবং নাগরিক কল্যাণ নিশ্চিত করবে-এমন একটি নতুন টেলিযোগাযোগ আইন প্রণয়ন করার দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। যদিও এরই মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে এই আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই খসড়া বিরোধ নিষ্পত্তি, অতি উচ্চ হারে জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ, যেকোনো ধরনের অপরাধকে জামিন অযোগ্য বলে বিবেচনা করা, দায়মুক্তিসহ বেশ কিছু ধারা পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে চূড়ান্ত আইন প্রণয়ন করার কথা জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

বুধবার টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত সেমিনারে তিনি একথা জানান। ‘রিফরম অব দ্যা টেলিকমিউনিকেশন ল,২০০১’ শিরোনামে এ গোলটেবিল আয়োজনে যৌথ আয়োজক ছিল অ্যামটব (অ্যাসোসিয়েসন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ)।

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহদে পলক বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পূর্ণ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন আছে। একইসঙ্গে তাদেরও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে হবে।’ খসড়া আইনের যেসব বিষয় ব্যাবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব হবে না, সেগুলো সংশোধনের আশ্বাস দেন প্রতিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘কোনো অংশীজন ও দেশের জনসাধারণের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, এমন যা কিছু এই খসড়া আইনে আছে, তা অপসারণ করার উদ্যোগ নেব। এক্ষেত্রে ভরত ও ভিয়েতনামের আইসিটি আইন আমরা অনুসরন করতে পারি। একটি সময়োপযোগী আইন করা হবে যা দেশে ব্যাবসা বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক হবে।’ তিনি সেমিনারে আলোচকদের প্রস্তাব অনুযায়ী খসড়া আইনের দু’টি ধারা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ দু’টি ধারা হচ্ছে ৭(৩) ও ২৬(ঙ)।

৭(৩) ধারায় বিটিআরসি’র কমিশনারদের অপসারনের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে এবং ২৬(ঙ) ধারায় সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্লাটফরম পরিচালনার জন্য বিটিআরসি থেকেও লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে। ৭(৩) ধারার সমালোচনা করে বক্তারা বলেন, এ ধারারে মাধ্যমে বিটিআরসি’র স্বাধীনভাবে দায়িত্বপালন চরমভাবে ব্যহত হবে। ২৬(ঙ) ধারা দেশে অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসা ও অন্যান্য উদ্ভাবনকে জটিলতায় ফেলবে। একই সঙ্গে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পরিচালনায় গঠিত বিটিআরসি’র কাজ ডিজিটাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে বিস্তৃত করা হলে বিটিআরসি’র স্বাভাবিক দায়িত্বপালনেও বড় ধরনেরে জটিলতার সৃষ্টি হবে। প্রতিমন্ত্রী এ দু’টি সমালোচনাকে ইতিবাচক উল্লেখ করে দু’টি ধারাই বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেন।

খসড়া আইন নিয়ে বিশিষ্ট অংশিজনদের সুপারিশকৃত খসড়া পর্যালোচনার জন্য সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেন প্রতিমন্ত্রী। কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেন।

অনুষ্ঠানে বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সব আইন মানুষের জন্য। তাই মানুষের কল্যাণেই আইন করতে হবে। তিনি বলেন, আমি ক্ষমতায় বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি দায়িত্বে। এক্ষেত্রে অযথা কারো হস্তক্ষেপ কাম্য নয় আমার। নতুন আইনের কারণে কেউ যেন কোনো সমস্যায় না পড়ে সে দিকে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা চাই আপনাদের সার্ভিসটা হবে কম টাকায় সর্বোচ্চ সার্ভিস।

গোলটেবিল আলোচনায় দু’টি মূল প্রবন্দ উপস্থাপন করেন বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল হক এবং রবির চিফ কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স শাহেদ আলম।

টিআরএনবি সভাপতি রাশেদ মেহেদীর সভাপতিত্বে গোল টেবিল আলোচনায় আরও অংশ নেন অ্যামটব সভাপতি ও গ্রামীণ ফোনের সিইও ইয়াসির আজমান, বাংলালিংকের ভারাপ্রাপ্ত সিইও তৈমুর রহমান, টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল মাবুদ চৌধুরী (অতিরিক্ত দায়িত্ব), গ্রামীণফোনের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার হ্যান্স মার্টিন হেনরিকসন, এমটব মহাসচিব লে. কর্নেল মোহাম্মদ জুলফিকার (অব), ই-ডটকো-এর কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুনিল আইজ্যাক,মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জাকারিয়া শহীদ, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সভাপতি ইমদাদুল হক, সামিট কমিউনিকেশনের চিফ নেটওয়ার্ক আর্কিটেক্ট ফারুক ইমতিয়াজ, ফাইবার অ্যাট হোমের পরিচালক(কমিউনিকেশণ) আব্বাস ফারুক এবং ব্রাক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ল’র শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন টিআরএনবির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পরে দেশ যখন স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে এবং বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে সে সময় প্রস্তাবিত টেলিযোগাযোগ আইনের খসড়ার কিছু দিক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। খসড়া আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে গিয়ে বক্তারা বলেন, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দেশে ২০০১ সালে প্রণীত একটি পৃথক আইন থাকা সত্ত্বেও খসড়ায় এ সংক্রান্ত ধারা সন্নিবেশিত করা হয়েছে যা নতুন করে সমস্যা তৈরি করবে। খসড়ায় সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি টাকাসহ উচ্চ জরিমানার বিধান রয়েছে যা অনেক বেশি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রশাসনিক জরিমানাই এক ধরনের শাস্তি, এর ওপরে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায় যা ব্যবসাবান্ধব নয়। এতে এই খাতের সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরাধকে জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকার বা কমিশনকে তাদের কোন কাজের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কোনো পদক্ষেপের ওপর কোনো দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার থাকবে না বলে বলা হয়েছে। বক্তারা এ ধরনের বিধানকে সাংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী উল্লেখ করেন।

আলোচকরা আরও বলেন, আইনে এমন কোন ধারা থাকা উচিত নয় যা দেশী ও বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। তারা সরকারের কাছে খাত সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি আইন প্রণয়নের অনুরোধ করেন।