সাহরি-ইফতারে কাটছাঁট
২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:৫৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:২৮ এএম
পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে। রমজান উপলক্ষে আরেক দফা প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সরকারের এক কোটি পরিবারকে কম দামে পণ্য দেয়া, টিসিবির ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবসায়ীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেও রমজানের নিত্যপণ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। বাজারে প্রচুর সরবরাহ। কিন্তু পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ইফতারের জন্য প্রয়োজনীয় তেল, খেজুর, ছোলা, ময়দা, চিনিসহ সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষ বাজারে গিয়ে চাহিদার অর্ধেক পণ্য ক্রয় করে ঘরে ফিরছেন। গত রমজানে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিনি এখন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২৫০ টাকার খেজুরের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। ৫০ টাকা কেজির ময়দার দাম এখন ৭৮ টাকা। ইফতারি পণ্যের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে সাধারণ মানুষ। এজন্য ইফতারি থেকে আইটেম কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোজাদার। রাজধানীর শনির আখড়া বাজারে কেনাকাটা করতে আসা গৃহিণী শাহান সুরাইয়া বেগম বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসার খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর চুলায় গ্যাস নেই। তাই ইফতারির আয়োজন আগের মতো থাকছে না। শুধুমাত্র খেজুর আর ছোলা-মুড়ি দিয়ে ইফতারির পরিকল্পনা করেছি। আনোয়ারা নামের একজন বললেন, গত রাতে রাইসকুকারে রান্না করা ভাত দিয়েই ইফতার করতে হবে। যাত্রাবাড়ী বাজারে একাধিক ক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ফলের দাম বেশি তাই এবারের ইফতারিতে কোনো ফল রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে সরকার যে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে তাতেও গোশতের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। একটি বেসরকারি কোম্পানীতে ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন কেরামত আলী। রোজার প্রথম দিন গতকাল সকালে রাজধানীর খামারবাড়িতে স্থাপন করা ভর্তুকি মূল্যের বিক্রয় পয়েন্টে গরুর গোশত কিনতে এসেছিলেন কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় না কিনেই চলে যেতে হলো তাকে। কেরামত আলী বলেন, যে দাম নির্ধারণ করেছে তাতে আমাদের মতো গরিবরা কিনতে পারবে না। যারা বড়লোক তাদের জন্যই এ সুবিধা। আমরা চাকরি করি। যারা রিকসা চালায় সেই নিম্নআয়ের মানুষের পক্ষে গরুর গোশত ক্রয় করা সম্ভব নয়।
কেরামত আলী থাকেন কলাবাগানে। পরিবারে তার ৬ জন সদস্য। তিনি বলেন, ঘরভাড়া বাবদ আমাকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। যে আয় হয় তাতে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। ৫০০ টাকা গরুর গোশত হলে ১ কেজি কিনতাম। রোজায় পরিবার এবং বৃদ্ধা মা একটু গোশত খেত।
রমজান মাসে নিম্ন আয়ের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণে সহায়তা করার লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়িতে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রাঙ্গণে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। এই উদ্যোগের আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষ প্রতি কেজি গরুর গোশত ৬৪০ টাকায় (বাজারমূল্য কেজি প্রতি ৭৫০ টাকা), মাটন প্রতি কেজি ৯৪০ টাকায় (বাজারমূল্য ১,১০০ টাকা), ড্রেসড ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ৩৪০ টাকায়, দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকায় (৯০ টাকা) এবং ডিম প্রতি পিস ১০ টাকায় (বাজারে ১২ টাকা) কিনতে পারবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে এবার দুধের আধা লিটারের ছোট প্যাকেট, অল্প পরিমাণ ডিম এবং আধা কেজির গোশতের প্যাকেট রাখা হবে যাতে একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষও তার সাধ্যের ভেতর এসব পণ্য কিনতে পারেন। আমাদের লক্ষ্য সচ্ছল মানুষরা নয়, বরং যারা তুলনামূলকভাবে স্বল্প আয়ের তারাই। কিন্তু শুক্রবার খামারবাড়ি স্পটে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের এই বাড়তি দামে কেনার সামর্থ নেই। আর যারা পণ্য কিনেছেন তারা বেশিরভাগই চাকরিজীবী, না হয় ব্যবসায়ী।
জানা গেল, প্রথম দিনে ৪০ মিনিটেই বিক্রি শেষ হয়ে যায় ভর্তুকি মূল্যের দুধ, ডিম, ও গোশত। রাজধানীর গ্রিনরোডে নিজস্ব ফ্লাটে থাকেন রবিউল ইসলাম। তিনি ডিম কিনেছেন ৩০টি, গরুর গোশত ১ কেজি এবং মুরগির গোশত ১ কেজি। খাসির গোশত শেষ হয়ে যাওয়ায় আধা কেজি কিনেছেন। রবিউল ইসলাম বলেন, স্ত্রী সকালে বলল এখানে থেকে বাজার করতে তাই এখানে আসা। আমার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে ভালো বেতনে চাকরি করে। আমি আইটি ব্যবসা করতাম, কিছুদিন হয় সেটা বাদ দিয়েছি। আমি কিছু পণ্য কিনতে পারলেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সাংবাদিক সহকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী প্রায় ২০ থেকে ২২ জনের সঙ্গে কথা বললে তারা প্রত্যেকেই জানান, এবার পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ইফতার ও সাহরির আইটেম কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। মাছ-গোশত এমনকি প্রতিটি সবজির দামও বেশি। তাছাড়া প্রতিটি ফলের দাম গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। হোসেন আলী নামের একজন চাকরিজীবী বলেন, এবারের ইফতারিতে বেশ কয়েকটি আইটেম বাদ দিতে হয়েছে। প্রতিবছর ইফতারের মেন্যুতে ফল, খেজুর, জিলাপী ও রুহ আফজা রাখতাম। এবার ইফতারে অনেক কিছু বাদ গেছে। লেবুর হালি একশ টাকা হওয়ায় রুহ আফজা রেখেছি। কিন্তু কোনো ফল ইফতারের মেন্যুতে রাখতে পারিনি। মূলত ফল আমাদের মতো মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। তিনি বলেন, এক কেজি ফল কিনতে গেলে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। খেজুরের দামও গত বছরের চেয়ে অনেক বেড়েছে। জিলাপীর কেজি ৩০০ টাকা। এজন্য এগুলো এবারের ইফতারিতে রাখতে পারিনি। আগের বছর রুহ আফজা কিনেছিলাম ৩০০ টাকা দিয়ে, এবার সেটির দাম চাচ্ছে ৩৬০ টাকা।
রাজধানীর কদমতলা বাজারে পণ্য কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মোস্তফা মামুন বলেন, গত বছর যেখানে ৭০ টাকা দিয়ে ছোলা কিনেছি, এবার ৮৫ টাকা দাম। গত বছর ৭৫ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতিকেজি চিনি কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকায়। এক কেজি আটা ৪০ টাকা থেকে ৬৮ টাকা হয়েছে। সয়াবিন তেলের দামেও আগুন। প্রতি লিটার কিনতে হয়েছে ১৮৫ টাকা। আর ফলের বাজারে তো যাওয়ারই উপায় নেই। প্রতি কেজি আপেল কিনতে ২৫০ টাকা গুনতে হয়। অন্যান্য ফলের দামও অনেক। গত বছর যে খেজুর ৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম সেটি এবার ৫০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় ইফতারিতে এসব পণ্য রাখব কিভাবে? মানুষের আয় বাড়েনি কিন্তু ব্যয় বেড়ে গেছে হু হু করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সংবাদকর্মী জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রমজানে পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ ৯২ ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশে প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি। যে লোকটা রোজা রেখে জুম্মার নামাজের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন সেই লোকটা বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য বেশি নিচ্ছেন। সরকারের দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা এবং তাদের যোগাসাজসে অসৎ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ বাজারে কোনো পণ্যের অভাব নেই। রাজধানী ঢাকার প্রতিটি কাচাঁবাজার ও দোকানে পণ্যে ঠাসা।
জানা গেছে সরকার থেকে জানানো হয়েছে, রমজান উপলক্ষে সচিবালয় সংলগ্ন আব্দুল গণি রোড, খামারবাড়ি রোড, মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি, মিরপুর ৬০ ফুট রোড, আজিমপুর ম্যাটারনিটি হাসপাতাল, পুরান ঢাকার নয়া বাজার, আরামবাগ, নতুন বাজার, মিরপুরের কালশী, খিলগাঁও রেলগেট, নাখালপাড়া, সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুরের বসিলা, উত্তরার দিয়াবাড়ি, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, হাজারীবাগ, বনানীর কড়াইল বস্তি, কামরাঙ্গীরচর ও রামপুরায় ভ্রাম্যমাণ সেলসপয়েন্ট থাকবে। এ সব পয়েটে সরকারের দেয়া ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হবে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ পণ্য কিনতে গিয়ে ফিরে আসছেন। রিকশাচালক আশরাফ হোসেন বলেন, সব জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে ডাল-ভাতের জোগাড় করতেই কষ্ট হচ্ছে। ইফতারি নিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষের কোনো ভাবনা থাকে না। আগের বছর ছোলা-মুড়ি কিনে ইফতারি করেছি। এবার হয়তো এগুলো দিয়ে ইফতারি করা সম্ভব হয়নি। আমাদের মতো মানুষের ভাত খেয়েই ইফতারি করতে হবে। সরকারের ভর্তুকি মূল্যে গোশত কিনতে গিয়ে ফিরে এসেছি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি