ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

জাকাতে নিহিত পবিত্রতা ও সম্প্রীতি

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

২৬ মার্চ ২০২৩, ১১:৩০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৩:১৬ এএম

পবিত্র রমজান মাস অঝোর ধারায় অফুরান রহমত বর্ষণের মওসুম। নবীজির পবিত্র জবানীতে ‘এই মাসে কেউ একটি নেক কাজ করলে অন্য সময়ে একটি ফরজ ইবাদত আদায়ের সমান সওয়াব। আর যদি কোনো ফরজ ইবাদত আদায় করে তার সওয়াব হবে রমজান ছাড়া অন্য সময়ে ফরজ ইবাদতটি আদায়ের ৭০ গুণ। মাহে রমজানের এই সুবিধা ও মুনাফা লাভের আশায় মুসলমানরা শুরু থেকে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত জাকাত আদায় করেন রমজান মাসে।

জাকাত শব্দের অর্থ পবিত্রতা। নানা দিক থেকে এই পবিত্রতার ভাবধারা বিশ্লেষণ করা যায়। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে আমরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। কুলি, মজুর, ব্যবসায়ী, চাষি; এমনকি দর্জি নাপিতের সাহায্য ছাড়া আমাদের জীবন অচল। তবে এখানে আর্থিক লেনদেনে কেউ সম্পদশালী হয়ে যায়, আবার কেউ গরীব থেকে যায়। এর পেছনে কারণ, সম্পদের সুষম বণ্টন না হওয়া বা অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে সমাজের কিছু শ্রেণির মানুষ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়া। তাদের সম্পদ আরেকটি শ্রেণির কাছে গিয়ে জমা হলে ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়।

এখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি কতখানি বঞ্চিত হয়েছে বা তাদের কী পরিমাণ সম্পদ ধনীদের কাছে জমা হয়েছে তার হিসাব দুনিয়ার কেউ দিতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালাই সেই হিসাব দিয়ে বলেছেন, এক বছরব্যাপী যাদের কাছে জাকাতের নেসাব পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ জমা আছে তারা শতকরা ২.৫% অর্থ গরীব মিসকিন ও বঞ্চিত শ্রেণির মাঝে বিলিয়ে দিলে সবার হক ও পাওনা সঠিকভাবে আদায় হবে এবং সম্পদ পবিত্র হয়ে যাবে। কুরআন মজীদে এ কথাই বলা হয়েছে :

‘তাদের সম্পদে যাচনাকারী ও বঞ্চিতদের পাওনা রয়ে গেছে’। (সূরা জারিয়াত, আয়াত-১৯)
জাকাতে সম্পদ পবিত্র হওয়ার চাইতেও বড় কথা ব্যক্তি মানুষ পবিত্র হয়ে যায়। যত বড় জ্ঞানী বা ধনী হোক যদি লোকটি কৃপণ হয় সমাজের কাছে তিনি ঘৃণিত। সম্পদ হারানোর ভয় বা আরো আরো পাওয়ার লোভ তাকে কুরে কুরে খায়। এই লোভ-মোহের জিঞ্জির থেকে মানুষ মুক্ত হওয়ার হাতিয়ার জাকাত ও দান খয়রাত। প্রাণ খুলে যত বেশি দান-খয়রাত করবে, বিশেষ করে আল্লাহর নির্ধারিত জাকাত আদায় করবে মন ততবেশি পবিত্র, লোভ মোহ থেকে মুক্ত হবে। কাজেই জাকাতে ব্যক্তির নিজের জন্যও পবিত্রতা নিহিত আছে।

সমাজে যারা বঞ্চিত ধনীদের প্রতি তাদের মনে ঘৃণা বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তাতে সাধারণ মানুষের মনে অপবিত্রতার কলুষতা জমাট বাঁধে। অর্থনৈতিক শোষণ বৈষম্য থেকে সৃষ্ট এই অপবিত্রতা থেকে সাধারণ মানুষের মন তখনই পবিত্র হয় যখন ধনীরা জাকাত আদায় করে, গরীবদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। তখনই ধনী-গরীবে হিংসা-বিদ্বেষ বা শ্রেণি বৈষম্যের পরিবর্তে ভালোবাসার পবিত্রতার বাতাবরণ তৈরি হয়। কাজেই বছর শেষে সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ দান করার বিধান জাকাত বা পবিত্রতা নামে আখ্যায়িত হওয়া যে কোনো বিবেচনায় সঠিক ও যথার্থ।

অধার্মিক ধনীরা মনে করে অর্থ সম্পদ তাদের পরিশ্রম, বুদ্ধিমত্তা ও ব্যবসায়িক সাধনার ফসল। কাজেই জাকাতের বিধানে নিজের উপার্জিত সম্পদ কড়ায় গ-ায় আদায়ের নির্দেশ অযৌক্তিক। গোপন কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থ, নাম-যশ বা প্রতিপত্তির সম্ভাবনা ছাড়া তারা দান করতে রাজি নয়। এখানে ইসলামের বক্তব্য পরিষ্কার। মানুষ চেষ্টা ও উপার্জন করে সত্য; কিন্তু আসলে অর্থ সম্পদ বা রিজিক দেন আল্লাহ তায়ালা। এ কথাটি বুঝার জন্য দু’টি উদাহরণ দেব।

ছোটবেলায় বা পাঠ্যজীবনে সাথীরা মেধায় বিচক্ষণতায় পিছিয়ে বা এগিয়ে থাকে। এমন অনেক প্রমাণ আছে যারা ছোটবেলায় মেধায় বিচক্ষণতায় পিছিয়ে ছিল বড় হয়ে তারা বিশাল সম্পদের মালিক আর যারা এগিয়ে ছিল তারা বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা বা অর্থ সম্পদে পেছনে পড়ে আছে। এর কারণ, রিজিক কাকে দেবেন বা বঞ্চিত করবেন কিংবা কম বা বেশি দেবেন তা একমাত্র আল্লাহর হাতে।

কোনো কোনো খান্দান এক সময় সমাজে মানী-সম্মানী ও সম্পদশালী ছিল। অথচ কোনো দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই তাদের ওপর দারিদ্র নেমে এসেছে এবং আশপাশের গরীবের ছেলেরা বড়লোক হয়ে গেছে। তাতে প্রমাণ হয় ধন-সম্পদ দেয়া বা নেয়ার মালিক আল্লাহ।
‘ওয়া তিলকাল আইয়ামু নুদাবিলুহা বাইনান নাছ’ ‘মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এই দিনগুলোর আমি পরিবর্তন ঘটাই’। Ñ(সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪০)

আপনি আপনার শিশুর হাতে টাকা বা লোভনীয় জিনিস দিলেন। এখন যদি বলেন, আমাকে কিছু ফেরত দাও। সে দিতে চাইবে না। অধার্মিক মানুষের অবস্থাও তাই। অতএব সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আল্লাহর দেয়া সম্পদ হতে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী হিসেব-নিকাশ করে জাকাত আদায় করে দেব। কারণ জাকাত সম্পদ বাড়িয়ে দেয়, ক্ষয় লোকসান থেকে সম্পদের হেফাজত করে।

ঈদের আগে ঘটা করে কিছু জাকাতের লুঙ্গি বা শাড়ী বিতরণ করলে জাকাত আদায় হবে না। হিসাব-নিকাশ না করে জাকাতের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দান করলেও জাকাত আদায় হবে না।
গাড়ী বাড়ি, কলকারখানার আসবাবপত্র ও কলকব্জার ওপর জাকাত নেই। লোন বাদে জমানো টাকা বা বিক্রয়যোগ্য পণ্যের জাকাত দিতে হয়।

মা-বাবা, দাদা-দাদি তদুর্ধ্ব যারা এবং সন্তান, নাতি, নাতনি অধঃস্তন যারা গরীব হলেও তাদের জাকাত দেয়া যাবে না। তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তো এমনিতেই পালন করতে হবে। এ ছাড়া ভাই-বোন বা অন্য নিকট বা দূর আত্মীয়সহ অভাবী লোকদের জাকাত দেয়া যাবে। সম্ভ্রান্ত গরীব আত্মীয়দেরকে জাকাত দিচ্ছি Ñএ কথা না শোনানেই উত্তম। তাতে তাদের মন রক্ষা হবে।

সম্পদশালীদের অনেকে নিজেরা চেয়ারম্যান বা ট্রাস্টি হয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন এবং জাকাতের অর্থ সেবামূলক কাজে ব্যয় করার জন্য ট্রাস্টে জমা রাখেন। মনে রাখতে হবে, জাকাত আদায় হওয়ার জন্য তামলিক শর্ত। অর্থাৎ জাকাত গ্রহীতাকে অর্থের মালিক বানিয়ে দিতে হবে। কাজেই যতক্ষণ তা গরীবদের হাতে বা খাতে মালিকানা হস্তান্তর না করেন ততক্ষণ জাকাত আদায় হবে না।

মাহে রমজানে ইসলামের আর্থিক ইবাদত জাকাত ফিতরা, সদকা শষ্যক্ষেতে সার বিতরণের মতো সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনুক, এই কামনা করছি।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

পার্বত্য এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়নি: নাহিদ

পার্বত্য এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়নি: নাহিদ

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু

সুনামগঞ্জে ২২ লাখ টাকার ইলিশ জব্দ

সুনামগঞ্জে ২২ লাখ টাকার ইলিশ জব্দ

ছাত্রজনতা হত্যার নির্দেশদাতা বিতর্কিত পুলিশ সদস্যরা এখনো লাপাত্তা

ছাত্রজনতা হত্যার নির্দেশদাতা বিতর্কিত পুলিশ সদস্যরা এখনো লাপাত্তা

রোগীদের সুস্থ করে তুলতে ‘রোবটের মতো’ কাজ করেছে লেবাননের যে চিকিৎসক

রোগীদের সুস্থ করে তুলতে ‘রোবটের মতো’ কাজ করেছে লেবাননের যে চিকিৎসক

মোদীর সফরের আগে ভারত সরকারের নামে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা পান্নুনের

মোদীর সফরের আগে ভারত সরকারের নামে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা পান্নুনের

মিয়ানমার থেকে মণিপুরে অনুপ্রবেশ ৯০০ জঙ্গির, দাবি ভারতের

মিয়ানমার থেকে মণিপুরে অনুপ্রবেশ ৯০০ জঙ্গির, দাবি ভারতের

৪৩ দিন পর কাজে ফিরলেন আর জি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা

৪৩ দিন পর কাজে ফিরলেন আর জি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা

গিল-পান্তের ব্যাটে পিষ্ট বাংলাদেশ

গিল-পান্তের ব্যাটে পিষ্ট বাংলাদেশ

ফের মৃত্যুর খেলা! ‘স্কুইড গেম সিজন ২’র টিজারে বিপদের বার্তা

ফের মৃত্যুর খেলা! ‘স্কুইড গেম সিজন ২’র টিজারে বিপদের বার্তা

অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি কচুয়ায় যুবলীগ নেতার ৪টি দোকান পুড়েছে দুর্বৃত্তরা

অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি কচুয়ায় যুবলীগ নেতার ৪টি দোকান পুড়েছে দুর্বৃত্তরা

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপির দু’পক্ষে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপির দু’পক্ষে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

লেবাননের বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

লেবাননের বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

রাঙামাটিতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের টহল, পরিস্থিতি শান্ত

রাঙামাটিতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের টহল, পরিস্থিতি শান্ত

পরমাণু দূষিত পানি নিয়ে চীন ও জাপানের কিছু ঐকমত্য

পরমাণু দূষিত পানি নিয়ে চীন ও জাপানের কিছু ঐকমত্য

ঝিকরগাছায় বিএনপি নেতা খায়রুজ্জামান মিনুসহ ২১ নেতাকর্মী বহিষ্কার

ঝিকরগাছায় বিএনপি নেতা খায়রুজ্জামান মিনুসহ ২১ নেতাকর্মী বহিষ্কার

হিজবুল্লাহর ভয়ে ইসরাইলিদের আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে থাকার নির্দেশ

হিজবুল্লাহর ভয়ে ইসরাইলিদের আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে থাকার নির্দেশ

ভারতের ঘুম হারাম করে পাকিস্তানকে ভয়ঙ্কর হেলিকপ্টার দিচ্ছে চীন

ভারতের ঘুম হারাম করে পাকিস্তানকে ভয়ঙ্কর হেলিকপ্টার দিচ্ছে চীন

পাকিস্তানে সেনানিবাসে আত্মঘাতি হামলা, সেনাসহ নিহত ১৮

পাকিস্তানে সেনানিবাসে আত্মঘাতি হামলা, সেনাসহ নিহত ১৮

জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১৪২৩, আহত ২২ হাজার

জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১৪২৩, আহত ২২ হাজার