পাকাপোক্ত ট্রানজিট-করিডোর
২৬ মার্চ ২০২৩, ১১:৪২ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৪ পিএম
বাংলাদেশের কাছে ভারতের আবদারের যেন শেষ নেই। ‘আবদার-অভিলাষ’ পূরণের ফর্দে প্রতিবেশী দেশটির জন্য এ যাবৎ সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিযোগ মনে করা হয় ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা। যা চালু করা হয়েছে ‘কানেকটিভিটি’ কিংবা ’ট্রান্সশিপমেন্টে’র নামে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্যসামগ্রী ওঠানামা, পরিবহণের মধ্যদিয়ে ট্রানজিট এবং করিডোর ব্যবস্থার ট্রায়াল রান (পরীক্ষামূলক) সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই পুরোদমে তা চালু হবে। ট্রানজিটে আনীত ভারতীয় মালামাল দেশের সড়ক মহাসড়কের ওপর দিয়ে ভারী পণ্যবাহী যানবাহনে পৌঁছেছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। করিডোর সুবিধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া, কুমিল্লার বিবিরবাজার, সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর ও স্থলসীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আসাম, মেঘালয়, মনিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যে গেছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর দিয়ে আগেই ট্রানজিট সুবিধা চালু করা হয়। সব মিলিয়ে এটি একতরফা বা একমুখী ট্রানজিট ও করিডোর ব্যবস্থা। কেননা এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কোন পণ্য ভারতে রফতানি হচ্ছে না। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তির শুরুতেই বলা আছেÑ ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’। চুক্তি মাফিক ভারতের পণ্য যাচ্ছে ভারতেই।
‘কানেকটিভিটি’ অথবা ’ট্রান্সশিপমেন্টে’র কথামালায় ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রকল্প-পরিকল্পনা, উদ্যোগ-আয়োজন সাজানো হচ্ছে আরো পাকাপোক্তভাবে। ‘ভারতের পণ্য’ শুধুই নয়; ‘ভারতের পণ্য ও যাত্রী ভারতে’ পরিবহণ ব্যবস্থা হবে আরো সহজ। শতবর্ষ প্রাচীন ব্রিটিশ আমলের সেই ‘আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে’ নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবিত করে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। দেশের রেলপথের উন্নয়নের সঙ্গে পরিপূরক ও সম্পূরক করেই যোগাযোগ সুবিধা পেতে আগ্রহী ভারত। এই টার্গেটে সড়ক খাতের মতো রেলওয়ে খাতেও বিভিন্ন প্রকল্পে কঠিন শর্তাধীনে ঋণ প্রদান করছে দেশটি।
ইতোপূর্বে বিগত ৯ মার্চ ২০২১ইং ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত শহর সাবরুমের সঙ্গে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির রামগড় শহরের মধ্যে সংযোগকারী ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু’ ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র প্রায় ৮০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত ফেনী মৈত্রী সেতুটি ভারতের ট্রানজিট-করিডোর সুবিধার জন্য আরেক ধাপ পরিপূরক অগ্রগতি। সেখানে ইমিগ্রেশন, কাস্টমসহ স্থলবন্দর চালুর অপেক্ষায় রয়েছে।
দেশের সড়ক-মহাসড়কের পাশাপাশি রেলপথ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। এ ধরনের অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা নয়া রেলপথ। যা বর্তমানে চালু হওয়ার পথে। ভারতের সংবাদ মাধ্যম বলছে, ৯৭২ কোটি রুপি তথা হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নয়া রেলপথসহ পূর্ণাঙ্গ রেলওয়ে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। ভারতের ইরকন ইন্টারন্যাশনাল (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন লি.) নির্মাণকাজ তদারক করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে বাংলাদেশের ব্যয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এক যুগ আগে ২০১০ সালে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। স্মারক অনুযায়ী ভারত সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনসট্রাকশন (ইপিসি) ভিত্তিতে এই রেল সংযোগ নির্মাণ করা হচ্ছে।
আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে নয়া রেলপথ সম্প্রসারণ কাজে ১০ কি.মি. অংশ বাংলাদেশ প্রান্তে এবং অবশিষ্ট সাড়ে ৫ কি.মি. ভারতে পড়েছে। দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার বর্তমান দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কি.মি.। আখাউড়া-আগরতলা সাড়ে ১৫ কি.মি. নয়া রেলপথ সংযোগ হলে সেই দূরত্ব কমে হবে মাত্র ৫৫০ কি.মি.! দূরত্ব কমবে ১১শ’ কি.মি.। রেলপথে যোগাযোগ স্থাপিত হবে কলকাতা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সরাসরি আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর থেকে ভারতের নিশ্চিন্তপুর এবং নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা স্টেশনের সাথে যুক্ত হচ্ছে নয়া এই রেলপথ। এতে ভ্রমণ সময় লাগবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা! বাঁচবে প্রচুর সময় ও অর্থ।
এর সুফল ভোগ করে ভাগ্য পাল্টে যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ বা ‘সাত কন্যা’ হিসেবে পরিচিত আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর ও নাগাল্যান্ড এবং সেই সাথে সিকিমের সাথে ভারতের অপরাপর তথা মূল অংশের সংযোগ ঘটবে। এর ফলে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ, মেডিক্যাল-পর্যটন, বাজার সুবিধার দুয়ার খুলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত কানেকটিভিটি সুবিধার সম্প্রসারণ হবে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনসাধারণের কাছে বাংলাদেশের উৎপাদিত হরেক ধরনের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও, বাংলাদেশের বাজার সম্ভাবনা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যাবে। যার কারণ ভারতের দেয়া শুল্ক-অশুল্ক বাধা-প্রতিবন্ধকতা। আখাউড়ার অপর প্রান্তে ও আগরতলার সন্নিকটে নিশ্চিন্তপুর হতে চলেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন। সেই সাথে বন্দরবিহীন ও ভূমি-পরিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) উত্তর-পূর্ব অঞ্চলটিতে হচ্ছে প্রথম আন্তঃদেশীয় স্থলবন্দর। চার দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী জুন-জুলাই মাস নাগাদ আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ চালুর আশা রয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগরতলায় এক নির্বাচনী সমাবেশে শিগগিরই আগরতলা-আখাউড়া রেলপথ চালু হবে বলে জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই রেলপথ চালু হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আরো গতিশীল হবে। তিনি বলেন, ফেনী নদীতে সেতু নির্মিত হওয়ায় ত্রিপুরা এবং সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রে উন্নীত হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ভারতের জন্য এটি বিরাট সুবিধা বয়ে আনবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে মালামাল রোডেও যাচ্ছে, ট্রেনেও যাবে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি রাস্তাঘাটের ওপর দিয়ে ভারতীয় পণ্য যাচ্ছে। এর প্রতিদান পাওয়া গেলে না হয় মেনে নেয়া যেতো। না পেলেও মেনে নিতে হচ্ছে।
তিনি জানান, দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে মোড অব ট্রান্সপোর্টেশনে বিশাল ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা পাচ্ছে ভারত। এর ফলে ভারতের জন্য ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত বিরাট সুবিধা হলো। তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্য ‘দি সেভেন সিস্টার্সে’র সাথে সড়ক, নৌ ও রেলপথÑ এই তিন দিক দিয়েই সহজে ও বিকল্প কানেকটিভিটি পাচ্ছে। এসব কৌশলগত সুবিধা মাথায় রেখেই ভারত তা করছে।
একই প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হয়ে গেছে। এটি ট্রানজিট-করিডোর হবে না, ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থা হবে। লাভজনক হবে। এর কতটা ব্যবহার হবে তা নিয়ে এখনও সংশয় আছে। তবে রামগড়ে ফেনী মৈত্রী সেতু হয়ে সরাসরি সড়কপথে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর কানেকটিভিটি সুবিধা বেড়ে যাবে।
ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, এই কানেকটিভিটি ভারতের জন্য সুবিধাজনক। তবে এটির সামরিক ব্যবহারের সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ তা এলাউ করবে না। কেননা তাতে রাজনীতিতেও হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। ভারত আশা করি তা করবে না। কন্টেইনার পরিবহন হবে। #
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সচিবালয়ের ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনে উপদেষ্টারা
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরায়েলের
ফায়ার ফাইটার নয়নের জানাজা বাদ জোহর, অংশ নেবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সচিবালয়ের আগুন লাগা ভবনেই উপদেষ্টা নাহিদ-আসিফের মন্ত্রণালয়
সচিবালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
চাঁদপুরে দুই উপজেলার মধ্যবর্তী সেতু ভেঙ্গে পড়েছে
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাস মালিককে কুপিয়ে হত্যা
মোজাম্বিকে কারাগারে ভয়াবহ দাঙ্গায় নিহত ৩৩, দেড় হাজার বন্দির পলায়ন
কেনাকাটার সময় আমরা সাধারণত যে ভুলগুলো করি
মিরপুরে সাংবাদিকদের ২১ বিঘা জমি এখনও ইলিয়াস মোল্লাহর দখলে!
রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মিলন গ্রেপ্তার
ইসরায়েলি বর্বরতা চলছেই, গাজায় নিহত বেড়ে প্রায় সাড়ে ৪৫ হাজার
সচিবালয়ের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ, নিরাপত্তা জোরদার
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
৪২ ঘণ্টা পর কর্ণফুলী নদীতে মিলল নিখোঁজ ২ পর্যটকের মরদেহ
পশ্চিম তীরে ইসরাইলের ড্রোন হামলা, নারীসহ ৮ ফিলিস্তিনির মৃত্যু
সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় নয়: আসিফ মাহমুদ
ভারতে শঙ্করাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে হস্তক্ষেপ চাইলেন একদল বাংলাদেশি হিন্দু
অবশেষে সচিবালয়ে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে
হাসিনাকে ভারত কি ফেরত পাঠাবে, আলজাজিরার প্রতিবেদন কি বলছে