ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচনের দেশটির গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলির ওপর তার থাবা আরও শক্তিশালী করে যাচ্ছেন এবং বহুস্তর বিশিষ্ট ও সোচ্চার গণতন্ত্রের ভারতকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করছেন। তার বিশ্লেষক, ক‚টনীতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধীরা বলছে যে, মোদির দল নিজেদের সুরক্ষার জন্য আদালতকে ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছে এবং তার প্রতিদ্ব›দ্বীদের লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছে। তারা বলছে যে, সংসদ থেকে ভারতের সর্বাধিক পরিচিত বিরোধী দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ক্ষমতাচ্যুতি দেখায় যে, কিভাবে নরেন্দ্র মোদির দল বিচার ব্যবস্থায় কারসাজি করছে। গত সপ্তাহের শেষের ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিজ রাজ্য গজরাটের স্থানীয় আদালত গান্ধীকে সংসদ থেকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং তাকে আগামী বছরের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা থেকে সম্ভাব্যভাবে বিরত রাখতে জন্য মানহানির মামলায় প্রয়োজনীয় সময়ের সঠিক দৈর্ঘ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদÐ দেয়। মোদির সমালোচক অন্য দলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের কয়েক সপ্তাহ পর ভারতের সংসদ থেকে গান্ধীবে বহিষ্কার করা হয়।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি এবং নিজের নামে প্রায়শই ব্যাপকভাবে প্রচারিত ব্যাপক জনকল্যাণ প্রকল্পের মাধ্যমে মোদি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। শক্তির এই ভিত্তি থেকে তার সরকার চাপ এবং প্রলোভনের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে তার ইচ্ছা মতো নতজানু করার দিকে এগিয়েছে, পাশাপাশি এটিকে কৌশলের সাথে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছেন, যা বিরোধীদের আদালতে আটকে রাখে।রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযান এবং ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার কৌশলগুলির ঘন ঘন প্রয়োগগের ফলে কোনও প্রতিদ্ব›দ্বীকে অকেজো করে দেয়ার জন্য মোদির ক্ষমতা কোন সীমা পর্যন্ত ব্যবহৃত হতে পারে। নরেন্দ্র মোদির বিরোধীরা বলছেন যে, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার কার্যকাল শুরু হওয়ার পর থেকে এবং বিশেষ করে ২০১৯ সালে ব্যাপক ভোটে তার পুন:নির্বাচনের পর থেকে মোদি সরকার আদালতের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার জন্য তার চাপ, প্রলোভন এবং সমর্থক-চালিত আদালতের অভিযোগগুলি ব্যবহার করে আসছেন।

মোদির মিত্ররাও বশিভূত আইনি ব্যবস্থার সুবিধা নিচ্ছে, যেখানে প্রায় ৫ কোটি মুলতুবি মামলার জট রয়েছে, যেগুলি ভিন্নমতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা, যা অভিযুক্তদের বছরের পর বছর ধরে ফাঁদে ফেলে রাখতে পারে, কখনও কখনও তাদের জব্দ করতে বহু পুরানো সামাজিক পোষ্টগুলিকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। পাঞ্জাব জুড়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ সীমিত করে দিয়েছে, কারণ তারা একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার সন্ধান অভিযান চালাচ্ছে, যার জনসাধারণের দৃষ্টিতে দ্রæত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি বিজেপির দ্বারা সহিংসতার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে। কাশ্মীরে ভারত সরকার জম্মু অংশে স্থানীয় সহিয়ংস হিন্দুবাদী কর্মীদের পুনরুজ্জীবিত করছে, সেখানে দেশের সামরিক সীমাবদ্ধতা স্থাপন করছে। জাতীয় ম‚লধারার সুবিধাবাদী গণমাধ্যমগুলি ম‚লত মুখে কূলুপ এঁটেছে, সুশীল সমাজের ভিন্নমত পোষণকারীদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং বাকরুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে এবং দেশটির গুরুত্বপ‚র্ণ নীতিগুলি নিয়ে সংসদীয় বিতর্ক প্রায়শই বাতিল করা হচ্ছে। মোদি, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাইরে থেকে অক্ষত রেখে কিন্তু সেগুলিকে তার বশবর্তী করছেন। এটা করতে তিনি বিচারপতিদের জন্য শক্তিশালী প্রণোদনা ব্যবহার করছেন। একারণে ঘরে এবং পশ্চিমে মিত্ররা সব দেখেও উপেক্ষা করছেন।

প্যারিসের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্সেস পো-এর ভারত বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফ জাফ্রেলট বলেছেন যে, বিচার বিভাগের উপাদানগুলির উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য মোদির পদ্ধতিগুলি রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, নতুন নতুন পদ এবং প্রণোদনার মূলা ঝুলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করে বিরোধীদের নিকেশ করছেন, তার পুরোনো কৌশল। গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলায় মোদির জীবনীকার এবং হিন্দু ডানপন্থী রাজনীতির দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে, এবার বিজেপি বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীকে সাজা এবং সংসদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য আশ্চর্যজনক গতি এবং দ্রæততার সাথে এগিয়েছে। তিনি বলেন, ‘শাসক দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে আদালত একই ধরণের গতিতে অগ্রসর হবে না, যাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘৃণাম‚লক বক্তব্য এবং সহিংসতার আহŸান সহ অপরাধের পুনরাবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে। এটি একই কাঠামোর নির্বাচনী ব্যবহার।› নীলাঞ্জন বলেন, ‹অবশ্যই, আপনি বিচারিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করছেন, নির্বাহী বিভাগকে আপনার মতো করে বিচার বিভাগ চালাচ্ছেন এবং দায়মুক্তির সাথে এটি করছেন এবং এটি সম্পর্কে একেবারেই নির্লজ্জ কিন্তু, আনুষ্ঠানিকভাবে, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।›
রাহুল গান্ধী এবং তার কংগ্রেস পার্টির নেতারা মনে করেন যে, জেলের সাজা এবং সংসদ থেকে তাকে অপসারণ মোদি এবং ভারতের বহুল সমালোচিত ধনকুবের গৌতম আদানি, নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্তা তার সমষ্টিক শেয়ার কারসাজির জন্য অভিযুক্ত করেছে, তা প্রকাশ করার জন্য প্রচেষ্টার জন্য মোদির প্রতিশোধ। ২০২০ সালে মোদির তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর নতুন দিল্লিতে জানুয়ারির একটি নির্বাচনী সমাবেশে উপস্থিত হয়ে ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতাকারী শান্তিপ‚র্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার আহŸান জানিয়েছিলেন। বিজেপি সদস্যরা সেই বিক্ষোভকারীদের, যাদের মধ্যে বয়স্ক মহিলারা একটি প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। সেখানে ঠাকুরের নেতৃতে সেøাগান ছিল, ‹জাতির বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মেরে মারো।’ মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লির পুলিশ এই মামলায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এমনকি বিক্ষোভকারীদের ওপর একজন সশস্ত্র লোক গুলি চালানোর পরেও এবং শহরটি মারাত্মক দাঙ্গা ও সংঘর্ষে নিমজ্জিত হওয়ার পরেও।

অথচ, বিজেপি মুখপাত্র শাজিয়া ইলমি বলেন, ‘গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্প‚র্ণ আইনি সমস্যা।’ তিনি দুই স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক যারা ধর্ষণ এবং খুনের চেষ্টার আরও গুরুতর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর অপসারণের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের ঠাকুরের সহিংসতা আহŸানের জন্য বিষয়ে ইলমি বলেছেন যে, নাগরিকরা অভিযোগ নিয়ে সারা দেশের আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য স্বাধীন। একজন বিচারক দিল্লিতে সেই সহিংসতার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এবং কেন কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি, তা নিয়ে পুলিশকে চাপ দিয়েছিলেন, তাকে দ্রæত অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা ও বিরোধী দলের সদস্যরা পরে পুলিশী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন নিয়ে গেলে বিচারক মামলাটি বাতিল করে দেন।