ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১
কেউ শুনছে না নদীর কান্না ভারতের পানি আগ্রাসনে মরছে উত্তর বঙ্গের সব নদী ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে হুমকিতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

নদীর বুকে ফসলের ক্ষেত

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক :

০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৩৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:২৬ পিএম

পানি হচ্ছে নদীর প্রাণ। সেই পানির জন্য হাহাকার করছে দেশের প্রতিটি নদী। অথচ কেউ শুনছে না নদীর এই কান্না। নদীকে জীবন্তসত্ত্বা ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দখলে-দূষণে মরছে নদী। অপর দিকে ভারতের ফারাক্কা ও গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে এবং উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করে এদেশের নদীগুলোকে কার্যত হত্যা করা হয়েছে। ভারত এখন নতুন করে আবারও ফারাক্কার উজানে আরও দু’টি খাল খনন করে পানি অন্যত্র নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এতে তিস্তা একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার ছাড়া নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যরে দূষণে নদীর প্রাণ বৈচিত্রও এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি নদীর পাড় দখল করে, কিংবা নদীর বুকেই চলছে অবৈধ নির্মাণ। সব মিলিয়ে দেশের বেশির ভাগ নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর। আর এসব চর এখন ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। নদী মরে যাওয়ায় নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাও মারাত্মক হুমকির মুখে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে মৎস্যসম্পদ। সেই সাথে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- আর দখল রাজত্ব নদীকে তিলে তিলে মারছে। নদীর সঙ্গে মরছে নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। তাতে বিপদ আরও বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মাছ হয়ে উঠছে অমূল্য সম্পদ। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার করা জেলে-মাঝিদের জীবনধারা বাস্তব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বৃহত্তর যশোরের জেলাগুলো, খুলনার তিনটা জেলা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, এমনকি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এগুলোর ভাগ্য সরাসরি গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া বরগুনা, ফিরোজপুর, বরিশাল, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, এসব জেলার নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি ভেতরে ঢুকছে। এতে লবণাক্ত হচ্ছে বিপুল এলাকা। বদলে যাচ্ছে ইকোসিস্টেম। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ৫০ বছর পর সুন্দরবনে একটা সুন্দরীগাছও থাকবে না। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরগুনা থেকে মানুষ দেশান্তরী হতে থাকবে। কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নীলফামারি, লালমনিরহাট, গাইবান্দা, পঞ্চগড় এসব জেলার নদীগুলো এখন পানিশূন্য। নদীর বুকে ধু ধু বালুচর। কোথাও কোথাও নদীর বুকে ফসলের চাষ হচ্ছে।
দেশের নদীর মরণদশা নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট বেশ কয়েকটি পর্বে ছাপা হচ্ছে। পানির জন্য উত্তরাঞ্চলের নদীর হাহাকার নিয়ে মাহফুজুল হক আনার ও হালিম আনসারীর পাঠানো রিপোর্ট এ পর্বে তুলে ধরা হলো।
দিনাজপুর শহরের সামান্য উত্তরে গাবুড়া আর পশ্চিমে পূণর্ভবা নদী। রাতের ঘুম হারাম করে নদী সংলগ্ন গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পানির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। কখন ভারতীয় ঢলের পানিতে গ্রাম-শহর প্লাবিত হয়। হঠাৎ করেই গাবুড়া নদীর পানির প্রবল স্রোতে দু’টি শাখা নদীর মুখ খুলে যায়। ইতিহাস ঘেটে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয়দের জানায় আগে এগুলো শাখা নদী ছিল। উজানে ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনের কারণে শুষ্ক মওসুমে নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। নদীর বুকে চলে আবাদ। এভাবেই বড় নদীগুলো ক্ষীন আর অনেক শাখা নদী বন্ধ হয়ে যায় প্রতিবছর। ২০১৮ সালের বন্যায় গাবুড়ার এই ঘটনাই বলে দেয় ভারতের পানি আগ্রাসনের চালচিত্র। ৮ জেলা নিয়ে গঠিত রংপুর বিভাগের অন্তত ৩৫ নদীর হৃদপিন্ড হিসেবে বিবেচিত তিস্তা ও মহানন্দা নদী। ভারত থেকে বয়ে আসা নদী দু’টির অসংখ্য শাখানদী রংপুরের ৮ জেলার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। এর মধ্যে খরস্রোতা ধরলা, আত্রাই, পূণর্ভবা, ছোট যমুনাসহ অসংখ্য নদী রয়েছে। পানি শূন্য এসব নদীর বুকে শোভা পাচ্ছে ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত। ভারতীয় পানি আগ্রাসী তৎপরতা থেকে দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য বহু পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে তিস্তা ব্যারেজসহ একাধিক রাবার ডেম। কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে বাস্তব অপেক্ষা না দেখলে তা বুঝা যাবে না। বর্তমানে তিস্তা, ধরলা, পূণর্ভবা, আত্রাই মহানন্দাসহ মূল কয়েকটি নদীতে ক্ষীনাকার পানি ছাড়া পুরোটাই বালুর চর ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর শাখা নদীগুলো যেন বর্ষা মওসুমে ভারত থেকে ধেয়ে আসা পানির ঢলের স্বাদ নেয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো দাড়িয়ে আছে। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের হাত থেকে বাংলাদেশের নদী এবং সেচ সুবিধাকে বাঁচাতে ব্যারেজ রাবার ডেম যতটা জরুরি তার চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে পানি সংরক্ষনে জলধারা তথা খাল সৃষ্টি করা অথবা পুরাতন খালগুলো খনন করে জীবিত করা। তিস্তা ও মহানন্দার নির্মিত বাঁধ (দ্বিতীয় ফারাক্কা হিসেবে বিবেচিত) দিয়ে ভারত একতরফা পানি নিয়ন্ত্রন করছে। শুষ্ক মওসুমে বাঁধের গেট বন্ধ করে উজানের পানি ড্রেনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে সেচ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের তেতুলিয়া বাজারে দাড়ালে শাখা নদী ও বাজারের ওপর দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি ভারতের ড্রেনে পানির স্রোতের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে ভারত আরো কয়েকশ’ কিলোমিটার খাল বা ড্রেন তৈরি করে আরো বেশি পানি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। অথচ বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের উজানে নির্মিত খালগুলো পানি সংরক্ষনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারছে না। পানিও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একই অবস্থা দিনাজপুরের মোহনপুর রাবার ডেম এলাকায়। কিন্তু ভারতের কয়েক কিলোমিটার উজানে নির্মিত রাবার ডেমের ব্যাপারে ভারতই আপত্তি জানিয়েছে অনেক আগেই। আবার বাঁধের ভাটিতে থাকা এলাকাগুলো পুরো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতের সাথে পানির সুষম বণ্টন নিশ্চিতের পাশাপাশি পানি সংরক্ষনাগার বা খাল সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জানা গেছে, রংপুর তথা উত্তরবঙ্গের হৃদপিন্ড বলে বিবেচিত তিস্তা ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক এই তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার। একইভাবে ভারতের সিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় প্রবেশ করা মহানন্দা নদী ক্রমান্বয়ে আত্রাই, পূনর্ভবা, ধরলা ছোট যমুনাসহ বিভিন্ন নামে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও বগুড়ার একাংশ দিয়ে বয়ে গেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত তিস্তার ১শ’ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশে। ভারত শুষ্ক মওসুমে পানি আটকে রেখে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে সেচ কাজে ব্যবহার করছে। আবার বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী পানি মেলে না। এভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি এখনও। তিস্তা নদীর এই করুণ দশার জন্য ভারতের দাদাগিরি আর বাংলাদেশের নতজানু নীতিকেই দায়ী করছেন ওয়াকিবহাল মহল। গবেষকরা বলছেন, তিস্তার অস্তিত্ব রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি কপাট এখন বন্ধ। ব্যারেজের উজানে যতটুকু পানি মিলছে তার বেশিরভাগই সেচ কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ব্যারেজের ভাটি এলাকায় এখন পানি নেই। ফলে ভাটি এলাকা অর্থাৎ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এক প্রকার মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এ অঞ্চলের গোটা নদীর বুকে শোভা পাচ্ছে ধু-ধু বালুচর। তিস্তার এসব চরে লোকজন কিছু রবিশস্য চাষ করলেও পানির অভাবে ভালো ফলন পাচ্ছে না।
তিস্তা তীরবর্তী লোকজন জানায়, আগে নদীতে সারা বছরই পানি থাকত, আমরা মাছ ধরতাম, ভালোভাবে খেতে-চলতে পারতাম। হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরে এ নদীতে। মানুষ পারাপার করে অনেক মাঝি জীবিকা নির্বাহ করত। এখন নদীতে পানি নেই, মাছও নেই। সবারই জীবন-জীবিকা এক কঠিন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।
মহানন্দা নদীর উজানে তৈরি বাঁধের কারণে বৃহত্তর দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন শাখা নদীগুলোও মৃত প্রায়। এসব নদীর সাথে সংযুক্ত শাখা নদীগুলো কার্যত শুষ্ক মওসুমে আবাদি জমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্ষা মওসুমে নদী ও শাখা নদীগুলো মুহূর্তেই আগ্রাসী হয়ে উঠে। বর্ষা মানেই ভারতীয় পানির ঢলের আতঙ্ক বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুরবাসীর জন্য স্থায়ী হয়ে গেছে। সকল প্রকার আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে ফারাক্কা তিস্তা মহানন্দাসহ অসংখ্য নদীর উজানে বাঁধ বা গেট নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রন এবং ব্যবহার করে চলেছে ভারত। অথচ দিনাজপুরের মোহনপুর এলাকায় আত্রাই নদীতে সামান্য একটি রাবার ডেম নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত। সংশ্লিষ্ট একটি মহলের মতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাবার ডেমটি অপসারণ করা না হলে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশি তিস্তা মহানন্দাসহ নদী পাড়ের মানুষদের পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্যের জন্য চরম দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। আর তা হলো কৃষি কাজের জন্য পানি সরাতে তিস্তা ব্যারেজ এর উজানে আরও দু’টি খাল খননের উদ্দেশ্যে প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগ। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলায় অধিক কৃষিজমি সেচের আওতায় আনতে পারবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার খাল খনন প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তা ও মহানন্দার পানি প্রত্যাহার করবে। এতে করে এসকল নদীর বাংলাদেশ অংশে পানি কতটুকু থাকবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নদী পাড়ের মানুষ ও নদী সংশ্লিষ্টগণ। কারণ শুষ্ক মওসুমে উত্তরাঞ্চলে ৮ জেলায় পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তা থেকে পানি নিতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন ও তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পৃথক অন্য ১টি খাল খনন করা হবে। এ দু’টি খাল খনন হলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১ লাখ কৃষক সেচের সুবিধা পাবেন। এমনিতেই ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে দোয়ানিতে তিস্তা বারেজের ভাটিতে একদম পানি নেই। নদীর ভাটি এলাকা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এমন কী তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানির রিজার্ভেও তেমন পানি নেই। রিজার্ভ শুকিয়ে গেছে। একই অবস্থা দিনাজপুরে পূণর্ভবা ও আত্রাই গাইবান্ধার ধরলা নদীপাড়ের। পাশাপাশি শাখানদীর আশে পাশে কয়েকফুট গভীরে সেচ মেশিন নামিয়ে পানি উত্তোলনের ঘটনাই প্রমাণ করে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের কথা। যা প্রায় দুই দশক আগে থেকে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর পানি দিয়ে সেচ সুবিধা পাওয়া দুরের কথা, শুষ্ক মওসুমে নদীর প্রভাবে দূর এলাকাতেও ভূ-গর্ভস্থ স্তর নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের আরও দুইটি নতুন খাল খননের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করার সংবাদটি ভাটি অঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর ও বৃহত্তর দিনাজপুরের বিস্তৃর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের আশপাশের এলাকায় ধু ধু বালুচরে পরিণত হবে। ছোট ছোট নদী ও শাখা নদীগুলো বিলীন হয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়বে।
৬২ বছর বয়সী প্রবীণ জেলে আশরাফ উদ্দিন জানান, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিস্তায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। আগে নদীতে পানি ছিল সারা বছর, মাছও ছিল অনেক প্রকারের। বিশেষ করে অত্যন্ত জনপ্রিয় তিস্তার বৈরালী বা বোয়াল মাছ। মহানন্দা, আত্রাই পূনর্ভবার বোয়াল ও আইড় মাছের সুনাম রয়েছে যা দেশের অন্য নদীতে পাওয়া যায় না। মন্ত্রী বা সরকারের বড় বড় কর্তারা এলে এই মাছ নিয়ে যেত রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায়। আমাদের আগেভাগেই অর্ডার দিয়ে রাখত জেলার বড় বড় কর্তাগণ। এখন আর এ মাছ তেমন পাওয়া যায় না। পানির অভাবে বিলুপ্তির পথে। শুধু বৈরালী নয়, বাটা, আইড় ও বোয়ালসহ অনেক মাছই নদী থেকে হারিয়ে গেছে। পানিই নেই, মাছ থাকবে কিভাবে? মাছ শুন্য হয়ে পড়েছে তিস্তা। সারাদিন জাল ধরে ঘুরে বেড়িয়েও ১ কেজি মাছ ধরা যায় না।
এদিকে, পানি না থাকায় তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচড়া শেখ হাসিনা সেতু গাইবান্ধার ধরলা, দিনাজপুরের পূণর্ভবা, আত্রাই ব্রীজ সবটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে ধু ধু বালুচরের ওপর। তিস্তা ব্যারেজের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, নদীতে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা সিলড্রাপ ও ক্যানেলগুলো ভরে রাখা হয়েছে। পানি কম থাকায় ব্যারেজের সবগুলো গেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এর চেয়েও যদি পানি কমে যায় তবে সেচ প্রকল্প সচল রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে। দিনাজপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, পূনর্ভবা আত্রাই নদী খননের কাজ চলছে। যে সব অঞ্চলে খনন হয়েছে বা হচ্ছে সেই টুকু জায়গাতেই পানি থাকছে সামান্য। কিন্তু নদীর যে বৈশিষ্ট প্রবাহ তা নেই। কারণ উজান থেকে পানি আসলে তবে তো ভাটিতে পানি যাবে।
তিস্তা তীরবর্তী লোকজনসহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলার লোকজনের দাবি, ভারতের নদী আগ্রাসন মরুকরণের হাত থেকে বাঁচতে হলে অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং রাবার ডেম বা সুইচ গেট নির্মাণ করে শাখা নদীর পানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার