মুসলিম স্কুলের শতবর্ষী লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফেলায় ভারতের শহরে শোক
১০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২০ পিএম
কাঁচের টুকরা, পাথর, ইট এবং মদের বোতল ছড়িয়ে আছে পুরো কম্পাউন্ড জুড়ে। মূল ভবনের প্রবেশপথের দরজাটি নেই। পুড়ে যাওয়া ফ্যান, জানালা, দরজা ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ মেঝেতে পড়ে আছে, কালি দিয়ে কালো হয়ে গেছে। এক কোণে ভাঙা ছাদ থেকে পানি পড়ছে। এ মাসের শুরুতে আল-জাজিরা পূর্ব ভারতের বিহার রাজ্যের নালন্দা জেলার বিহার শরীফ শহরের একটি বিশিষ্ট মুসলিম স্কুল মাদরাসা আজিজিয়া পরিদর্শন করার সময় এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত শহরের মুরারপুর আশেপাশের স্কুলটি রাম নবমীর সময় ৩১ মার্চ একটি হিন্দু উৎসবের সময় জনতা আক্রমণ করে। অধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, ভারত জুড়ে প্রধানত মুসলিম পাড়ার মধ্যদিয়ে প্রচুর সংখ্যক মিছিল যেতে দেখে, যারা অস্ত্র বহন করে, উস্কানিমূলক সেøাগান দেয় এমনকি দোকান, বাড়িঘর এবং ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা চালায়। বাসিন্দারা বলছে, লাঠি এবং পেট্রোল বোমা নিয়ে সশস্ত্র প্রায় ১ হাজার লোকের জনতা স্কুলে প্রবেশ করে এবং এটিকে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং এর লাইব্রেরিটি ধ্বংস করে যেখানে মূল্যবান পাÐুলিপি এবং ঐতিহাসিক নথিসহ প্রায় ৫ হাজার বই ছিল।
স্কুলের নিরাপত্তা প্রহরী মোহন বাহাদুর আল-জাজিরাকে বলেন, জনতা ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করছিল। বাহাদুর বলেন, মিছিলটি স্কুলের দিকে অগ্রসর হতে দেখে তিনি এর গেটে তালা লাগানোর চেষ্টা করেন। ‘কিন্তু জনতা পাথর ছুড়ে গেট ভেঙে দেয়’।
‘ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন লোক আমাকে ধাক্কা দিয়ে থাপ্পড় মারে এবং আমাকে চিৎকার করে বলে, ‘তুমি নেপালি জারজ, আমরা তোমাকে মেরে ফেলব’। বাহাদুর বলেন, তিনি ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
স্কুলের প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ শাকির কাসমি আল-জাজিরাকে বলেন, যখন সহিংসতা শুরু হয় তখন তিনি ইফতার করতে বাড়িতে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যখন আমি নিরাপত্তারক্ষীর কাছ থেকে ফোন পাই, আমি ছুটে গিয়ে প্রধান সড়কে পৌঁছাই যেখানে আমি দেখলাম কিছু ছেলে ঢিল ছুড়ছে এবং একটি বিবাহ হলে আগুন লেগেছে’।
কাসমি বলেন, পরদিন সকালে তিনি যখন স্কুলে যান, দেখে হতবাক হয়ে যান। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘তারা [দাঙ্গাকারীরা] সবকিছু ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম যখন দেখলাম হাজার হাজার বই ছাই হয়ে গেছে। আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে, তারা এটি করেছে এবং আমি কখনই ভাবিনি যে, এটি এখানে কখনও ঘটতে পারে’। স্কুলের লাইব্রেরিতে যেসব বই ছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল কোরআনের কপি, হাদিসের বই এবং ১০০ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে হাতে লেখা ইসলামিক বই। কাসমি বলেন, ‘ওইসব বই এখন চলে গেছে।
আল-জাজিরা ২ এপ্রিল যখন স্কুলটি পরিদর্শন করে, তখনও সহিংসতার লক্ষণগুলো ছিল তাজা। আশেপাশের একটি মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, যেটিকেও আক্রমণ করা হয়েছিল, তিনি ছাইয়ের স্ত‚পের মধ্যে কুরআনের অর্ধ-পোড়া পাতা এবং অন্যান্য বই সংগ্রহ করে একপাশে রাখছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এসময় জনতা ঢুকে পড়ল। আমাদের নিরাপত্তার জন্য পালাতে হয়েছে। তারা গেট ভেঙে, মসজিদের মিনার ভেঙে ফেলে এবং মসজিদের আঙিনায় পার্ক করা যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়’। ইমাম বলেন, পুলিশ তাকে উদ্ধার করার আগে কয়েক ঘণ্টা মসজিদের ভেতরে একটি কক্ষে নিজেকে আটকে রেখেছিলেন। কাসমি এবং শাহাবুদ্দিন অভিযোগ করেছেন যে, সহিংসতা শুরু হলেও পুলিশ কয়েক ঘণ্টা পরে পৌঁছেছিল। অথচ স্কুল থেকে মাত্র ৫০০ মিটার (১,৬৪০ ফুট) দূরে লাহেরিতে ছিল সবচেয়ে কাছের পুলিশ স্টেশন।
নালন্দার একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার অশোক মিশ্র বলেছেন, পুলিশ ১৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে, নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজ ব্যবহার করে অপরাধীদের শনাক্ত করার পরে আরো গ্রেফতারে অভিযান চলছে। মিশ্র আল-জাজিরাকে বলেন, ‘শান্তি মিছিল পরিচালনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছে’।
বিহারের রাজধানী পাটনার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নওশাদ আলম, যিনি নালন্দায় সহিংসতা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, আল-জাজিরাকে বলেছেন, রাজ্য সরকার এলাকায় শান্তি ও স¤প্রীতি নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে, স্কুল এবং এর ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়া রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
২৭ বছর বয়সী ইতিহাস বøগার উমর আশরাফ আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘সমস্ত বইই ছিল মূল্যবান এবং অনন্য। এমনকি লাইব্রেরির আসবাবপত্রও ছিল অনন্য। দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এবং ঐতিহ্যগত চিকিৎসা সংক্রান্ত দুর্লভ বই ছিল। আক্রমণটি আমাদের মূল্যবান সাহিত্য মুছে ফেলার একটি ইচ্ছাকৃত কাজ বলে মনে হচ্ছে’।
আশরাফ বলেন, স্কুলটি ১৯০০ সালের দিকে বিবি সোগরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট মুসলিম সমাজসেবী যিনি তার সম্পত্তি মানুষের শিক্ষা এবং অন্যান্য স¤প্রদায়ের কাজের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
তিনি বলেন, বিহারের প্রাচীনতম স্কুলগুলোর মধ্যে একটিতে ৫০০টিরও বেশি শিশু ভর্তি হয়েছিল যেখানে কুরআন, আইনশাস্ত্র এবং হাদিসের ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং মানবিক বিষয়েও পড়াশোনা করে।
গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে, অধিকার গোষ্ঠী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিন্দু উৎসবগুলোকে ‘ভোটারদের সমাবেশ করার জন্য ব্যবহার করছে, যার ফলে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে’। গ্রæপের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, এ জনতা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অনুভ‚তিতে উৎসাহিত হয় যা তাদের দায়মুক্তি দেয়’। বিহারে অবশ্য বর্তমানে বিজেপি বিরোধী জোট শাসিত।
শনিবার, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেন, তার সরকার বিহার শরীফে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণে কাজ করছে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশাসন তার কাজ করছে। [সহিংসতার কারণে] যেখানেই কোনো ক্ষতি হয়েছে আমরা তা খতিয়ে দেখছি। জনগণের জন্য যা করা দরকার আমরা তা করব’। সূত্র : আল-জাজিরা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গারো পাহাড়ের বালু খেকোদের বিরুদ্ধে এসিল্যান্ডের সতর্কবার্তা
রেকর্ডের মালা গেঁথে দ. আফ্রিকার বিপক্ষে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়
মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর, চীনকে ঠেকাতে কোয়াড কি এখনও প্রাসঙ্গিক?
টেলর সুইফটের পর কমলাকে বিখ্যাত বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক
ফিরেই গোলের দেখা পেলেন রোনালদো,নাসেরের সহজ জয়
কোহলি রিভিউ না নেওয়ার যে কারণ জানালেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার
মাঠের বাইরে নতুন পরিচয়ে মেসি
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ
গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই
নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন
গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন
চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে