মক্কা বিজয় নবীজির রণকৌশল
১১ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:১১ পিএম
২০ রমজান মক্কা বিজয় দিবস। পৌত্তলিক কুরাইশদের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে মহানবী (সা.) স্বদেশভ‚মি মক্কা ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন মদিনায়। দেশত্যাগী মুসলমান মুহাজির ও মদিনাবাসী আনসারদের নিয়ে তিনি মদিনায় ইসলামীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কার কুরাইশরা মদিনার ইসলামী শক্তিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য একের পর এক যুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায় এবং ৮ হিজরির ২০ রমজান মহানবী (সা.) অসাধারণ রণকৌশল প্রয়োগ করে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।
মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের বিশ^বিজয়ের সূচনা। এ বিজয়ের পটভ‚মিতে আছে ২ বছর আগের হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা।
হিজরি ৬ষ্ঠ সালে মহানবী (সা.) ১৪শ’ মুসলমানকে নিয়ে কাবাঘর জিয়ারত ও উমরা পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মক্কার কাছে হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরাইশরা বাধা দেয়, মুসলমানদের মক্কা প্রবেশ করতে দেবে না। নবীজি কুটনৈতিক তৎপরতায় কুরাইশদের বুঝাতে চাইলেন, তিনি কাবাঘর জিয়ারত ও উমরা পালন করেই মদিনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু কুরাইশরা কিছুতেই রাজি নয়। অনেক আলাপ আলোচনার পর মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি হয়, নাম হুদাইবিয়ার সন্ধি। সন্ধির শর্তগুলো ছিল দৃশ্যত মুসলমানদের জন্য অপমানজনক। একটি শর্ত ছিল এ বছর উমরা না করেই মুসলমানদের মদিনায় ফিরে যেতে হবে। মুসলমানরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না এমন শর্ত। তারা নিশ্চিত ছিল, মক্কায় গিয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতে পারবে। মহানবীর কাছ থেকে তারা সে আশ^াস পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মহানবী (সা.) কুরাইশদের শর্ত মেনে নিয়ে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিতে সই করেন।
চুক্তি সম্পাদনের পর নির্দেশ দিলেন সবাই ইহরাম খুলে নাও, মাথার চুল কামাই কর, কুরবানীর জন্য আনা পশুগুলো জবাই কর। কিন্তু সে আদেশ পালিত হলো না। নবীজি লক্ষ্য করলেন, একটু আগে পর্যন্ত তার অজুর পানি, মুখের থুথুর বরকত নেয়ার জন্য যে সাহাবিরা কাড়াকাড়ি করেছে তারাই এখন পশু কুরবানী করার নির্দেশ মানছে না। কঠিন পরিস্থিতি। তিনি মনক্ষুণœ হয়ে তাঁবুতে ফিরে গেলেন। সফরসঙ্গীনী উম্মে সালামার কাছে ঘটনা খুলে বললেন।
বিচক্ষণ উম্মে সালামা (সা.) ব্যাপারটি বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি এখনই তাঁবু থেকে বের হন। কারো সাথে একটি কথাও বলবেন না। সোজা গিয়ে আপনার কুরবানীর উটটি জবাই করুন। আপনার নাপিতকে ডেকে মাথা মুÐনের ব্যবস্থা করুন।
এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলো, মাথা মুÐন করে ইহরাম খুলে ফেলল। মূলত তারা অপেক্ষায় ছিল, সন্ধির অপমানজনক শর্তগুলো হয়ত পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু নবীজির কুরবানী এবং মাথা মুÐন দেখার পর তাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেলে। তাই নবীজির হুকুম পালনের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। যে মহিয়ষী মহিলার একটি রাজনৈতিক পরামর্শে এতবড় কঠিন পরিস্থিতি শান্ত হলো, সংকটের অবসান হলো তিনি নবীজি (সা.)-এর সহধর্মীণী আমাদের মা উম্মে সালামা। এ ঘটনা প্রমাণ করে, মহিলারা রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার পদে আসীন হতে পারবেন।
২১ মাস যেতে না যেতে মাথায় কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে। কথা ছিল, কুরাইশ বা মুসলমান কেউ অপর পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোনো গোত্রের ওপর আগ্রাসনে সাহায্য করবে না। কিন্তু কুরাইশদের সহায়তায় তাদের মিত্র বনু বকর খোজায়া গোত্রের ওপর আক্রমণ ও ব্যাপক হত্যাকাÐ চালায়। খোজায়া গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র। এ ঘটনার পরপর কুরাইশরা বুঝতে পারল পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াতে পারে। পরিস্থিতির নাজুকতা আঁচ করে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদিনায় গিয়ে হজরতের সাথে সাক্ষাত ও আলাপ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার প্রচেষ্ট ব্যর্থ হয়। বুঝতে পারে মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। আবু সুফিয়ান তড়িঘড়ি মক্কার পথে রওনা হয়। এর পরপরই ৮ম হিজরির ১০ রমজান ১০ হাজার মুসলমানকে সাথে নিয়ে মহানবী মক্কা অভিযানে বের হন। মহানবী মক্কার জীবনে অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতন, যুদ্ধ বিগ্রহ, মদিনা আক্রমনের প্রতিশোধ নিতে পারে, এ আশংকায় মক্কায় তখন থমথমে আতঙ্ক।
মহানবী মক্কার উপকণ্ঠে উপনীত হলেন। তিনি এমন সব রণকৌশল গ্রহণ করলেন যাতে কুরাইশ বাহিনী ভয়ে হতভম্ভ হয়ে গেল। সামান্য প্রতিরোধ করার মনোবলও হারিয়ে ফেলল।
মরুভ‚মির খোলা প্রান্তরে ১০ হাজার মুসলিম ফৌজের অবস্থান। নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই নিজেদের উপস্থিতি শত্রæপক্ষকে জানতে দেবে না। কিন্তু না। নবীজি নির্দেশ দিলেন রাতের খাবার দশ হাজার লোকের প্রত্যেকে আলাদা চুলায় রান্না করবে। রাতের অন্ধকারে বিশাল প্রান্তরজুড়ে থোকা থোকা আগুন জ্বলে উঠল। যাতে শত্রæবাহিনীর গুপ্তচররা ভাবে না জানি কত ফৌজ এসেছে কুরাইশদের আক্রমন করতে। এত বিশাল বাহিনীর মোকাবিলার শক্তি মক্কাবাসীর নেই।
নবীিিজ আরেকটি নির্দেশ রাতের নির্দেশের বিপরীত। বললেন, সকালে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে সৌচাগার নির্মাণ কর। সৌচাগার হবে সমান তফাতে এবং সংখ্যায় কম। ফলে সকাল থেকে সৌচাগারের জন্য মুসলমানদের দীর্ঘ লাইন। দিনের বেলার কুরাইশ গুপ্তচররা দেখে অবাক। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা বিপুল বিশাল না হলে সৌচাগারের এত দীর্ঘ লাইন কেন। এই রিপোর্ট কুরাইশদের কাছে পৌঁছালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা প্রতিরোধ করার মনোবল সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে।
এদিকে মুসলমানদের গতিবিধি নিরীক্ষণের জন্য কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান রাতে এসেছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে। এক পর্যায়ে হযরতের চাচা আব্বাস (রা.) সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় এবং তিনি আবু সুফিয়ানকে নবীজির কাছে নিয়ে যান। পরদিন সকালে অনেকটা বাধ্য হয়ে আবু সুফিয়ান ঈমান আনয়ন করে। আব্বাস (রা.)-এর প্রস্তাবে নবীজি চিরশত্রæ আবু সুফিয়ানকে শাস্তির পরিবর্তে এমন সম্মান দিলেন, যা মক্কা বিজয়কে একেবারে সহজ করে দিলো। বললেন, মক্কার বাসিন্দাদের যারা কাবাঘরে প্রবেশ করবে তারা আক্রমণ থেকে নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।
৮ হিজরির ২০ রমজান নবীজি বিজয়ের বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। কাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিগুলো ভেঙে ছুড়ে ফেলে দেন। তিনি মক্কার কুরাইশদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। শত্রæকে বাগে পেয়েও ক্ষমা করে দেয়ার এই দৃষ্টান্ত এবং রক্তপাত এড়ানোর এমন রণকৌশল দুনিয়ার মানুষের সামনে অনন্তকাল বিস্ময় হয়ে থাকবে ।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী ও এমপিরা তাদের কৃত কর্মের জন্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে
ব্রাহ্মণপাড়ায় ট্রাক্টরের চাপায় কলেজ ছাত্রের মৃত্যু, আহত ২
কুরআন শিক্ষা বোর্ড ঢাকা মহানগর উত্তরের নগর সম্মেলন অনুষ্ঠিত
এবি ব্যাংক পিএলসি. এর "বিজনেস রিভিউ মিটিং" অনুষ্ঠিত
উথ এশিয়ান বিজনেস এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেল সোনালী লাইফ
নেতাকর্মীদের রেখে লক্ষণ সেনের মত পালিয়ে গেছে স্বৈরাচার: ব্যারিস্টার সালাম
অভিনেতা অপূর্বকে নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মিথ্যাচার
বরিশালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অংশীজন সভায় প্রধান প্রকৌশলী
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতিতে সাধারণ ক্রেতাদের নাভিশ্বাস
সংস্কারোত্তর পিআর পদ্ধতিতেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে
‘শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে’
‘রাষ্ট্রের সকল স্তরে ইসলামী সংস্কৃতির অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে’
মেট্রোকে থামিয়ে ফাইনালে রংপুর
৪৩ বছর পর কুয়েতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারতে: দুলু
মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল, কানাডায় কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন ট্রুডো?
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ
ভারতের সেবাদাসী হাসিনাকে পুনর্বাসনে এবার জঙ্গি মিশনে তারা!
মাহফুজকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া উচিত? যা বললেন ড. জাহেদ
৬ বছরের মধ্যেই চীনের হাতে হাজার পরমাণু বোমা! উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের