নদী মরে খাল
১২ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫২ পিএম
পানি হচ্ছে নদীর প্রাণ। সেই পানির জন্য হাহাকার করছে দেশের প্রতিটি নদী। অথচ কেউ শুনছে না নদীর কান্না। নদীকে জীবন্তসত্ত্বা ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দখলে-দূষণে মরছে নদী। অপর দিকে ভারতের ফারাক্কা ও গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে এবং উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করে এদেশের নদীগুলোকে কার্যত হত্যা করা হয়েছে। ভারত এখন নতুন করে আবারও ফারাক্কার উজানে আরও দুটি খাল খনন করে পানি অন্যত্র নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এতে তিস্তাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক নদী একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়ারর আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার ছাড়া নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যরে দূষণে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যও এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি নদীর পাড় দখল করে, কিংবা নদীর বুকেই চলছে অবৈধ নির্মাণ। নদী মরে যাওয়ায় নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকাও মারাত্মক হুমকির মুখে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে মৎস্যসম্পদ। সেই সাথে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- আর দখল রাজত্ব নদীকে তিলে তিলে মারছে। নদীর সঙ্গে মরছে নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। তাতে বিপদ আরও বাড়ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মাছ হয়ে উঠছে অমূল্য পণ্য। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার করা জেলে-মাঝিদের জীবনধারা বাস্তব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে শতাধিক নদী হারিয়েছে। বর্তমানে ৬৪ জেলার ১৩৯টি নদীর বিরাট অংশ দখল হয়ে গেছে। সারা দেশে মোট ৪৯ হাজার ১৬২ জন দখলদারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদী নিধনকে ‘যূথবদ্ধ আত্মহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এরপরও নদীর ধ্বংসলীলা চলছে।
সারাদেশের নদ-নদীর মরণ দশা নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন কয়েকটি পর্বে ছাপা হচ্ছে। আজ যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নদীর বর্তমান অবস্থা নিয়ে তৈরি রিপোর্ট ছাপা হলো।
যশোর থেকে শাহেদ রহমান জানান, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে এ অঞ্চলে পদ্মা ও গড়াই এর শাখা নদী মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, চিত্রা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা ও অভিন্ন নদী ইছামতি ও কোদলাসহ অর্ধ শতাধিক নদ-নদী এখন মৃত। এদের বেশির ভাগ নদ-নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। এতে কৃষি, শিল্প, বনজ, মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে।
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। যার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদীবন্দরের অবস্থাও শোচনীয়। মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকা-, সভ্যতা-সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নদ-নদীর ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ট ও নিবিড়। কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পদ্মাপাড় থেকে সমুদ্রপাড় পর্যন্ত প্রায় সকল নদ-নদীর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। নদীপাড়ের লোকজন এসব নদ-নদী শুকিয়ে মারার জন্য ভারতে সরাসরি দায়ী করে বলেন, পদ্মার শাখা-প্রশাখার সব ক’টি নদীর অবস্থা দিনে দিনে করুণ হচ্ছে।
ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জ পয়েন্ট থেকে শৈলকুপা পর্যন্ত রাস্তার ধার দিয়ে প্রবাহিত কুমার নদীর চেহারা দেখে নদীপাড়ের কয়েকজন আফসোস করলেন, ভারত এভাবে নদ-নদী গলাটিপে মারছে অথচ কোনো প্রতিবাদ নেই। একসময় কুমার নদীতে ঢেউ খেলত। এখন হেঁটে পার হওয়া যায়। নদীর বুকে চাষাবাদ হয়। ঝিনাইদহ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদীরও একই অবস্থা। ক্যাসেলব্রিজ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আরাপপুরের বাসিন্দা তকব্বর জানালেন, নদী কি আর নদী আছে প্রায় সব নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে নরেন্দ্রপুর গ্রামে যেতে হাসপাতালের সামনে চিত্রা উপর ব্রিজ পার হওয়ার সময় দেখা গেল নদীর অস্তিত্ব প্রায় মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে।
যশোরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদের চেহারা দেখলে যে কারো চোখে পানি আসবে। এমনভাবে দখল হয়েছে যে নদী হয়ে পড়েছে কোথাও খাল আবার কোথাও ড্রেন। অবশ্য বর্তমানে ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভৈরব নদ খনন হচ্ছে। খনন কাজে দুর্নীতিতে ভৈরব নদে আবার আগের মতো ঢেউ আসবে তেমন বলার সুযোগ নেই। শিল্প শহর নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে যে পানি আছে তা কালো হয়ে গেছে। শিল্পবর্জ্য ফেলার কারণে নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ঠিকাদারদের গড়িমসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
যশোরের শার্শার বেতনা নদী, যশোরের মুক্তেশ্বরী, বেনাপোলের হাকরখাল, নড়াইলের মধুমতি, মাগুরার নবগঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে দিনে দিনে খাল হয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এ অঞ্চলের গঙ্গানির্ভর নদ-নদী এবং মিনি ফারাক্কার কারণে ইছামতি, কোদলা ও সোনাই নদী মৃত্যুপ্রায় অবস্থায়।
সাতক্ষীরা থেকে আক্তারুজ্জামান বাচ্চু জানান, এ জেলার অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে। সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা সুফলা সাতক্ষীরা জেলার ২৭টি নদ-নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। ফারাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ সøুইচগেট, বাঁধ নির্মাণ, চর দখল করে ইটভাটা তৈরি এবং নদী শাসন করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, যত্রতত্র মাছের ঘের করার ফলে জেলার ছোট-বড় নদীর অধিকাংশই মরে গেছে। কয়েকটি নদী অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি অনেকগুলো মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, দখল ও দূষণে ভরে গেছে সাতক্ষীরার ২৭ নদ-নদী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা বেতনা, মরিচ্চাপ, পরলাম সায়ের ও যমুনা নদী। নদীর পাশাপাশি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেলার ৪২৯টি খাল। খালের উপর নির্মিত ২১৬টি সøুুইস গেটের বেশির ভাগই অকেজো। ২৭টি নদীর অন্তত ২০ টি নদী পলিপড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী থেকে প্রবাহিত চার শতাধিক খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। মাত্র কয়েকটি খাল পানিউন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে, নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও নদীর জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরার অধিকাংশ নদী তার গতি প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে। কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, মরিচ্চাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, গুতিয়াখালি, সাপমারা, প্রাণ সায়ের নদীসহ অধিকাংশ নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে বসতঘর, বেড়িবাঁধ দিয়ে মৎস্য চাষের কারণে সাতক্ষীরা ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে সংলগ্ন খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েকটি নদী এরই মধ্যে মরে গেছে। কয়েকটি নদী অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি অনেকগুলো মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে ।
বেতনা নদীর বিনেরপোতার দুই তীর দিয়ে নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ২৫টির মতো ইটভাটা। চরভরাটিয়া জমি দখল করে স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে কাগজপাত্র তৈরি করে ব্যক্তি মালিকানার নামে গড়ে তুলছে স্থাপনা।
উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, অপরিকল্পিত সøূইচগেট ছাড়াও এ অঞ্চলের নদীর ওপর ৪৮টি সেতু নদীমৃত্যুর অন্যতম কারণ। এছাড়া, ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে উজানে পানির চাপ কমে যাওয়াও নদী মৃত্যুর অপর কারণ। নদীগুলো ও সংযোগ স্থাপনকারী খালে অপরিকল্পিত নির্মাণ এবং চিংড়ি চাষের নামে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ গতি হ্রাস করাও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
গত কয়েক বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আর আগের মত জোয়ার-ভাটা হয় না। কোনোভাবে নদীটি মরা খালের মতো বেঁচে আছে। কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে বেতনা নদীসহ মরিচ্চাপ ও যমুনা খনন করা হলেও দখল দারিত্বের কারণে নদী আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে মরিচ্চাপ ও প্রাণ সায়েরের। এসব নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য বারবার জনগণের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না। একইভাবে সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী ইছামতি ও সোনাই নদী পলিযুক্ত হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে এই নদীতে বিশাল বিশাল চর জেগেছে। ভারতীয় ভূখ-ের নদ-নদীর সাথে সংযুক্ত এই দুটি নদী বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত বিভাজন করে আছে। সুন্দরবনের নদী আড়পাঙাসিয়া, মাদার, মালঞ্চ, চুনা, ও খোলপেটুয়া নদীর মাঝেও জেগে উঠছে বড় বড় চর। এরই নিকটস্থ যমুনা নদী মারা গেছে তিন দশক আগেই। সুন্দরবনের দুর্গবাটি, বুড়িগোয়ালিনীসহ একাধিক গ্রাম রয়েছে ঝুঁকিতে। বিশেষ করে দীপ অঞ্চল গাবুরা রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে কটুক্তিকারী ড. সৈয়দ জামিল আহমেদকে অপসারণ করতে হবে
সাইবারট্রাক ‘অচল’ করে দেয়ার জন্য মাস্ককে দুষলেন কাদিরভ
ফিরেই পান্তের সেঞ্চুরি, তিন অঙ্কে গিলও
মুখে সুন্নী বললে সুন্নী হওয়া যায়না, আমলের মাধ্যমে সুন্নী হতে হয় -ছারছীনার পীর ছাহেব
রাঙামাটি পৌঁছেছে তিন উপদেষ্টাসহ সরকারের প্রতিনিধি দল
'কাজ না করলে বেতন বন্ধ’, ধর্মঘটকারী ভারতীয় কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিল স্যামসাং
অফ-স্পিনে ৩৯ বার আউট: কোহলিকে যে দাওয়াই দিলেন শাস্ত্রী
মাগুরায় ৮ বছর আগে কেড়ে নেয়া মাইক্রো উদ্ধার মালিককে ফেরত দিলেন যুবদল নেতা
পার্বত্য এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হয়নি: নাহিদ
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তার রহস্যজনক মৃত্যু
সুনামগঞ্জে ২২ লাখ টাকার ইলিশ জব্দ
ছাত্রজনতা হত্যার নির্দেশদাতা বিতর্কিত পুলিশ সদস্যরা এখনো লাপাত্তা
রোগীদের সুস্থ করে তুলতে ‘রোবটের মতো’ কাজ করেছে লেবাননের যে চিকিৎসক
মোদীর সফরের আগে ভারত সরকারের নামে যুক্তরাষ্ট্রে মামলা পান্নুনের
মিয়ানমার থেকে মণিপুরে অনুপ্রবেশ ৯০০ জঙ্গির, দাবি ভারতের
৪৩ দিন পর কাজে ফিরলেন আর জি করের জুনিয়র চিকিৎসকরা
গিল-পান্তের ব্যাটে পিষ্ট বাংলাদেশ
ফের মৃত্যুর খেলা! ‘স্কুইড গেম সিজন ২’র টিজারে বিপদের বার্তা
অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি কচুয়ায় যুবলীগ নেতার ৪টি দোকান পুড়েছে দুর্বৃত্তরা
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপির দু’পক্ষে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক