রোদই ভাটি এলাকার আশীর্বাদ হ কালবৈশাখী ঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই ধান ঘরে তুলতে চায় কৃষক হ ২০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে হ শ্রমিক সঙ্কট থাকলেও ধান কাটার জন্য সরকার কম্বাইন্ড : হারভেস্টার মেশিন দিচ্ছে হ হাকালুকির হাওরে ব্লাস্ট সংক্রমণে ফলনে ক্ষতি

হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু

Daily Inqilab ইনকিলাব রিপোর্ট

১৭ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৫ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:৪৮ পিএম

মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে...। কবির এমন আশার বাণীতেও ভাটি অঞ্চলের মানুষের অর্থাৎ হাওরবাসীর মনের ভয় কাটছে না। এখন আকাশের এক টুকরো মেঘ দেখেই ভয়ে আঁৎকে ওঠে হাওর অঞ্চলের মানুষ। এই বুঝি সর্বনাশা কালবৈশাখী ঝড়, পাহাড়ি ঢল এসে হাওরবাসীর স্বপ্ন-আশা সব কিছুকে তছনছ করে দেবে। দেশে এখন তাপদাহ বইছে। প্রচ- গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। একটু বৃষ্টির জন্য সবাই চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষা করছে। কখন একটু স্বস্তির বৃষ্টি আসবে। তবে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এসব জেলার মানুষের কাছে এ গরমটাই প্রত্যাশিত। এ রোদ এখন তাদের কাছে আশীর্বাদ। হাওর বেষ্টিত এসব জেলার মানুষ এখন বৃষ্টি চায় না। আরও অন্তত পনের দিন রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ তাদের কাম্য।

হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। চাষিরা তাদের স্বপ্নের সোনালি ধান ঘরে তুলছে। এ সময় কৃষকের প্রার্থনা একটাই আর কটা দিন যে ঝড়-বাদল না আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন তাদের সারাবছরের চলার সম্বল কেড়ে না নেয়। বোশেখের এই কাঠফাটা রোদ ভাটি অঞ্চলের কৃষকের কাছে চকচকে সোনা। হাওর এলাকার ধান কাটার সার্বিক অবস্থা নিয়ে আমাদের সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এছাড়া সারাদেশের শুষ্ক আবহাওয়া আরও কিছু দিন থাকতে পারে। আবহ্ওায়ার এ রুদ্রমূর্তি ‘শাপে বর’ হয়েছে সিলেটের বোরো চাষিদের পাকা ধান ঘরে তুলতে। তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে আতঙ্কে থাকে গ্রামের কৃষক। মৌলভীবাজারের খাদ্যভা-ার হিসেবে খ্যাত দেশের বৃহৎ হাকালুকি হ্ওারের ধান তড়িঘড়ি করে কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। একদিকে শ্রমিক সংকট অপরদিকে তীব্র দাবদাহের মধ্যে নিদারুণ কষ্টে ধানকাটা অব্যাহত রেখেছেন চাষিরা। অন্যদিকে বোরো চাষে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ কারণে হাকালুকি হ্ওারের বোরো ধানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ হাওরে প্রত্যাশিত ফলন নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন বলেন, রোগের ফলে বোরো চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিক হয়েছে। অনেকে সারা বছরের খোরাক তো দূরের কথা, ফসল ফলানোর ব্যয় মিটানোও সম্ভব হবে না। অনেক চাষি মাঠের ধান কাটছে না। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা কৃষি অফিসার মো: জসিম উদ্দিন ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বেল্লাল হোসেন বলেন, ব্লাস্ট রোগে শুধুমাত্র ব্রি-১৮ ও ব্রি-২৯ এর বেশি ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, হাকালুকি হাওরকেন্দ্রিক কুলাউড়া উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫০০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ৫৫২০ হেক্টর। প্রথম দিকে ধানের ফলন ভালো হলেও শেষ ভাগে ব্লাস্ট রোগে অনেক কৃষকের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে গেছে। অপরদিকে, সিলেটের হাওরসহ কৃষি জমিতে বোরো ধানের প্রত্যাশিত ফলন হয়েছে। জেলায় ৮৫ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এরমধ্যে গতকালের তথ্য অনুযায়ী ১৩ ভাগ জমির পাকনা ধান কর্তন সম্পন্ন হয়েছে। মোট আবাদের ২২ ভাগ বোরো আবাদ হয়েছে হাওর অঞ্চলে। এদিকে বোরো ধান কর্তন ও মাড়াই নিয়ে শংকিত কৃষকরা সেই সাথে কৃষি সংশ্লিষ্টরা। চলমান আবহাওয়া ইতিবাচক হলেও আগামী ২০ এপ্রিল থেকে সিলেট অঞ্চলে বৈশাখী ঝড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এমন বৈরী আবহাওয়া মোকাবিলা করে বোরো ধান ঘরে তোলা কৃষকদের জন্য কঠিন হবে বলে শংকিত চাষিরা।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালনক (শস্য) ও তথ্য কর্মকর্তা ফারুক হোসেন বলেন, পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। সেই সাথে মাড়ায়ে ব্যস্ত কৃষকরা। তিনি বলেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকায়, কৃষকদের মধ্যে হাসি ফুটছে। কিন্তু আগামী দিনের আবহ্ওায়া নিয়ে শংকিত আমরা। সে কারণে তাগিদ করছি দ্রুত পাকা ধান ঘরে তুলতে।

সুনামগঞ্জ থেকে মো. হাসন চৌধুরী জানান, হাওর অধ্যুষিত এ জেলার বোরো ধানই প্রধান সম্পদ। এই ধান নিয়েই সকল আশা-ভরসা এ অঞ্চলের মানুষের। জেলার ১২টি উপজেলার ১৫৪টি হাওরে চলতি বোর মৌসুমে ধান চাষ করা হয়েছে। বিস্তীর্ণ হাওরের যে দিকে চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। প্রতিটি হাওরে এখন অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করছে। হাওরজুড়ে দুলছে সোনালি ধানের শীষ। আর এ দুলায় লুকিয়ে আছে লাখ কৃষকের লালিত স্বপ্ন। পোকা-মাকড় ও রোগ বালাইয়ের আক্রমণ ছাড়াই বেড়ে ওঠা ধানের শীষে ভরে গেছে মাঠ আর মাঠ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা কোনো বিপর্যয় না ঘটলে এ অঞ্চলের কৃষকদের খলা ভরে উঠবে সোনালি ধানের হাসিতে। এর পরেই তাদের স্বপ্নের ফসল উঠবে ঘরে। শীত বিদায়ের সাথে সাথে তীব্র রোদ্রতাপে অতিষ্ঠ যখন জেলার মানুষ তখন বোরো ধানের ফলন নিয়ে জেলার কৃষকরা চিন্তিত যে কোনো সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব তছনছ হয়ে যেতে পারে, ঠিক মতো ফসল তুলতে পারবেন কি-না তা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। অবশেষ চিন্তা কাটিয়ে তাপদাহ থেকে মুক্তি দিয়েছে জেলাজুড়ে কয়েকবার বৃষ্টি নামে। এরপর মধ্য চৈত্র থেকে ৩ বৈশাখ পর্যন্ত তীব্র রোদ্রতাপে অতিষ্ঠ হলে জেলার মানুষ তবে জেলার লাখো কৃষকের জন্য এই রোদ্রতাপ আজ আশীর্বাদ। সরজমিনে দেখা যায়Ñ জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভপুর, সদর উপজেলাসহ, শাল্লা ছায়ার হাওরে কিছু অংশে ধানকাটা শুরু হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ধান শুকানোর জন্য খলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। তবে দুই একদিনের মধ্যেই পুরো দমে ধানকাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পলাশ গ্রামের কৃষক আব্দুল হেকিম বলেন, গতবার চৈত্র-বৈশাখ মাসে আগাম বন্যায়, ঝড়বৃষ্টিতে ব্যাপক ফসল হানি ঘটলেও এবার ও চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচ- খড়া তাপ জ্বলছে হাওর পাড়ের কৃষক-কৃষাণীর জীবন। এ সময়ের রৌদ্রতাপ তাদের ফসল ঘরে তোলার জন্য আশীর্বাদ। এমন রৌদ্রতাপ আরও ৭ থেকে ১০ দিন থাক এটাই তাদের কামনা।

জামালগঞ্জের উপজেলার শনি হাওরপাড়ের মাসুক মিয়া, বাবুল মিয়া ও রহমত আলী, বলেন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে বাইরে শ্রমিক ছাড়া শুধু স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে দ্রুত ধানকাটা যাবে না। এছাড়া সুনামগঞ্জ হাওর অধুষিত অঞ্চল বন্যাপ্রবণ এলাকা। রয়েছে ঝড়, আগাম বন্যা, শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা তাই এ সব জমির ধান দ্রুত কাটতে না পারলে কৃষকরা অনেক ঝুঁকিতে পড়বে।

সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ২২ হাজার ৭ শত ৯৫ হেক্টর জমিতে চাষা বাদ করা হয়েছে। চাষাবাদ অনুযায়ী ধান উৎপাদিত হলে উৎপাদিত ধান হবে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৮ শত কোটি। তিনি আরো জানান, হাওরে বোরো ফসল কর্তনে শ্রমিকের কোনো সঙ্কট নেই। স্থানীয় শ্রমিকের পাশাপাশি সরকার ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে ১ হাজার ৪০টি ধানকাটা-মাড়াই, কম্বাইন্ড-হারভেস্টার মেশিন দিয়েছে। এ মেশিনে হাওরে ধান কাটলে কম সময়েই আধিক ধান কাটা-মাড়াই শেষ হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

এখনো পুলিশে বহাল সেই ৫০ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরামের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত
একই ব্যক্তি টিভি ও পত্রিকার মালিক হতে পারবেন না, সুপারিশ জমা
নতুন সঙ্কটে রাজনীতি!
বিজিবি সদস্যসহ কয়েকজন নিখোঁজ
আরও
X

আরও পড়ুন

ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পথে কোহলির অনন্য কীর্তি

ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পথে কোহলির অনন্য কীর্তি

সল্ট-কোহলির ঝড়ে অন্যরকম শুরু বেঙ্গালুরুর

সল্ট-কোহলির ঝড়ে অন্যরকম শুরু বেঙ্গালুরুর

চ্যাম্পিয়ন বিকেএসপি

চ্যাম্পিয়ন বিকেএসপি

‘বিদেশি’ আনছে ভারতও!

‘বিদেশি’ আনছে ভারতও!

কর্ণফুলীতে বন্যহাতির আক্রমণে শিশুর মৃত্যু

কর্ণফুলীতে বন্যহাতির আক্রমণে শিশুর মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নিহত

কিশোরগঞ্জে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নিহত

ঝিনাইদহে জমে উঠেছে ঈদের বাজার ক্রেতাদের ঝোঁক দেশি পোশাকে

ঝিনাইদহে জমে উঠেছে ঈদের বাজার ক্রেতাদের ঝোঁক দেশি পোশাকে

সুশীল বিপ্লবীরা আ.লীগের পুনর্বাসন করতে চায় : রাশেদ খান

সুশীল বিপ্লবীরা আ.লীগের পুনর্বাসন করতে চায় : রাশেদ খান

ধানমন্ডিতে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের ৭ সদস্য রিমান্ডে

ধানমন্ডিতে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীরের ৭ সদস্য রিমান্ডে

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৯০% ভোট পেয়ে বিএনপি জয়লাভ করবে : কায়কোবাদ

সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ৯০% ভোট পেয়ে বিএনপি জয়লাভ করবে : কায়কোবাদ

আপন চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৪ বছরের বোনকে ধর্ষণের অভিযোগ

আপন চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে ৪ বছরের বোনকে ধর্ষণের অভিযোগ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে : মাহমুদুর রহমান মান্না

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে : মাহমুদুর রহমান মান্না

টিভিতে দেখুন

টিভিতে দেখুন

অমর একুশে হল ছাত্রদলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

অমর একুশে হল ছাত্রদলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

বিশ্বকাপে এক পা আর্জেন্টিনার

বিশ্বকাপে এক পা আর্জেন্টিনার

মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ায় হাফেজ ছেলের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নামাজরত অবস্থায় বাবা নিহত

মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ায় হাফেজ ছেলের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে নামাজরত অবস্থায় বাবা নিহত

‘‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ কিংবদন্তি জর্জ ফোরম্যান আর নেই

‘‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ কিংবদন্তি জর্জ ফোরম্যান আর নেই

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে : নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী

বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে : নাসিরউদ্দীন পাটোয়ারী

৬ এপ্রিল ক্যাম্পে ফিরছেন সাবিনারা

৬ এপ্রিল ক্যাম্পে ফিরছেন সাবিনারা

আর্জেন্টিনা ম্যাচে ‘বেকার’ আলিসনও

আর্জেন্টিনা ম্যাচে ‘বেকার’ আলিসনও