তাপদাহে হিটশকের ঝুঁকিতে বোরো

Daily Inqilab রফিক মুহাম্মদ

১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৯ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:০৪ পিএম

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কৃষিখাত। খরা, বন্যা, ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ বছর চৈত্রের মাঝামাঝি থেকে দেশে তাপদাহ শুরু হয়েছে। এতে দেশের প্রধান ফসল বোরো ধান হিট ইনজুরি বা হিটশকের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে দেশের হাওরাঞ্চলের ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণা এ তিন জেলায় কমপক্ষে ৫০ হাজার হেক্টর জমির ধান হিটশকে পুড়ে গিয়েছিল। এবারও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিটশকে বোরো ধান পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে এ বিষয়ে কৃষকদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এতে কৃষকের চোখে মুখে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে শুরু হয়েছে খরার প্রভাব। বৃষ্টি না হওয়ায় ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এতে অনেক স্থানে বোরো জমিতে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সেচের অভাবে জমিতে বোরো ধানের ফলন নিয়ে কৃষকরা চিন্তিত। এমন অবস্থা যদি সপ্তাহখানেক থাকে তাহলে বোরো ধানের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে তেমনি তীব্র তাপদাহে ধানগাছও পুড়ে যায়, মরে যায়। যাকে বলা হয় হিটশক বা হিট ইনজুরি। হিটশক হলে ধানের ফুল পুড়ে দানা চিটা হয়ে যায়। মূলত ধানের ফুল ফোটার সময়ই এ ধরনের ক্ষতি হয়। বর্তমানে এ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রধান ফসল বোরো। ধান গবেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি অথবা কমা— দুই কারণেই হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। বর্তমানে দেশে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
বোরো মৌসুম শুরু হয় শীতে নভেম্বরের শেষে অর্থাৎ কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে মাসে, অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় এক-দুই ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। কিন্তু যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না, তখনই ধানের জন্য তা হিটশক ঘটে। অর্থাৎ, বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়। যে অবস্থা এখন বিরাজ করছে।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, তীব্র গরমের কারণে এবার হিটশক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সারাদেশের কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছি। হিটশক ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফুল ফোটা পর্যায়ে) হয়। আমাদের অধিকাংশ ধান এখন সে অবস্থা পেরিয়ে ম্যাচুইরিটি স্টেজে এসেছে। তাই হিটশক হলেও খুব ক্ষতি হবে না। তারপরও আমরা সবাইকে সতর্ক থাকতে বলছি।
এবার হাওরাঞ্চলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা কম। কারণ হাওরাঞ্চলের ধান এখন ফুল পর্যায় পেরিয়ে গেছে। হাওরের ধান এখন অনেকটা পুষ্ট হয়ে গেছে। হাওরে হিটশকে শঙ্কা না থাকলেও অতিরিক্ত গরমের ফলে ধান ক্ষেত বøাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। মৌলভীবাজারের খাদ্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত দেশের বৃহৎ হাকালুকি হ্ওারের ধান তড়িঘড়ি করে কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। এ হাওরের বোরো ধানে বøাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এ কারনে হাকালুকি হ্ওারের বোরো ধানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ হাওরে প্রত্যাশিত ফলন নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন বলেন, রোগের ফলে বোরো চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকে সারা বছরের খোরাক তো দুরের কথা, ফসল ফলানোর ব্যয় মিটান্ওো সম্ভব হবে না। অনেক চাষী মাঠের ধান কাটছে না। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা কৃষি অফিসার মো. জসিম উদ্দিন ও কৃষি সম্প্রসারন কর্মকর্তা বেল্লাল হোসেন বলেন, বøাস্ট রোগে শুধুমাত্র ব্রি-২৮ ্ও ব্রি-২৯ এর বেশি ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়া কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাইসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে বোরো ক্ষেতে বøাস্ট রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ এ দুটি জাতের ধানে বøাস্ট রোগের সংক্রমণ বেশি হয়েছে। এ জাতের ধান চাষ করে অনেক কৃষক এবার সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের স্বপ্ন-আশা সব শেষ হয়ে গেছে। সময় মত বৃষ্টি না হওয়ায়, অতিরিক্ত গরমের ফলে ধান ক্ষেতে এই বøাস্ট রোগের সংক্রমণ হয়েছে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। গরমে হিটশক এবং নানান রোগ বালাইয়ের সংক্রমণ কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি নতুন চ্যালেঞ্জ। গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কীটতত্ত¡ বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী বলেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া অথবা তাপমাত্রা কমে যাওয়া এ দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। কোথাও কোথাও ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত তাপমাত্র বিরাজ করছে। এতে চলতি বোরো ধানের জন্য ঝুঁকি অবশ্যই রয়েছে।
তিনি বলেন, ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থা ধরি আমরা। সে সময় গরম বাতাসের কারণে ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ফুল শুকিয়ে যায়। ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনা আগেও হয়েছে। তবে ২০২১ সালের মত এত বিস্তর এলাকায় ক্ষতি হয়নি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১২ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিটশক হয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। বড় হিটশক ২০২১ সালে প্রথম হয়। ওই বছর ৪ এপ্রিল একসঙ্গে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলাসহ কিছু অঞ্চলে হিটশক হয়েছিল। এতে কমপক্ষে ৫০ হাজার হেক্টর জমি হিটশকে আক্রান্ত হয়েছিল।
এখন সারাদেশেই তাপপ্রবাহ বইছে। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠানামা করছে। এই সময়ে কৃষি ও মাঠ ফসলের সুরক্ষায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর। বিশেষ করে যেখানে এখন ধান ফ্লাওয়ারিং স্টেজে রয়েছে, সেখানে হিটশকের আশঙ্কা বেশি। সে কারণে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে।

 

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নারী কর্মীদের নিয়ে মিথ্যাচার, ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি এনসিপি’র

নারী কর্মীদের নিয়ে মিথ্যাচার, ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি এনসিপি’র

ফুলপুরে বাসের ধাক্কায় মাহিন্দ্রের ৬ যাত্রী নিহত, আহত ১৫

ফুলপুরে বাসের ধাক্কায় মাহিন্দ্রের ৬ যাত্রী নিহত, আহত ১৫

পরিপূর্ণ হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

পরিপূর্ণ হাইড্রোগ্রাফিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

শিবচরে আশরাফুল মাদারাসার সাবেক শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলন-ছাত্র পরিষদ গঠন

শিবচরে আশরাফুল মাদারাসার সাবেক শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলন-ছাত্র পরিষদ গঠন

তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন প্রবাসে আজ বাড়ীতে ফিরছেন কপিন বন্ধি হয়ে!

তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন প্রবাসে আজ বাড়ীতে ফিরছেন কপিন বন্ধি হয়ে!

সিলেট সীমান্ত এলাকায় বিজিবি অভিযানে পৌণে ২ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

সিলেট সীমান্ত এলাকায় বিজিবি অভিযানে পৌণে ২ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

শেরপুর গারো পাহাড়ে হোটেল-মোটেল রিসোর্ট থাকলে বেশি সময়ের জন্য আসতে পারতেন পর্যটকরা: লাভজনক হবে পর্যটনখাত!

শেরপুর গারো পাহাড়ে হোটেল-মোটেল রিসোর্ট থাকলে বেশি সময়ের জন্য আসতে পারতেন পর্যটকরা: লাভজনক হবে পর্যটনখাত!

শাবিপ্রবির ধর্ষণকান্ডে জাতীয় ছাত্রদলের ক্ষোভ

শাবিপ্রবির ধর্ষণকান্ডে জাতীয় ছাত্রদলের ক্ষোভ

শিশুদের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকাদান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

শিশুদের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকাদান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ইসরাইলের আগ্রাসন ইরানকে আরো ঐক্যবদ্ধ করেছে

ইসরাইলের আগ্রাসন ইরানকে আরো ঐক্যবদ্ধ করেছে

দ্রুত গতিতে সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব: জাতিসংঘ মহাসচিব

দ্রুত গতিতে সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে বিশ্ব: জাতিসংঘ মহাসচিব

যুক্তরাজ্য বিএনপির উপদেষ্টা  মশাহিদ রোববার দেশে আসছেন

যুক্তরাজ্য বিএনপির উপদেষ্টা  মশাহিদ রোববার দেশে আসছেন

বাংলাদেশে দিনের ভোট আর রাতে হবেনা : সেনবাগে জয়নুল আবেদীন ফারুক

বাংলাদেশে দিনের ভোট আর রাতে হবেনা : সেনবাগে জয়নুল আবেদীন ফারুক

ইরানি মিসাইলের ভয়ে হার্ট অ্যাটাক ইহুদি নারীর

ইরানি মিসাইলের ভয়ে হার্ট অ্যাটাক ইহুদি নারীর

বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি: আবুল হোসেন আজাদ

বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি: আবুল হোসেন আজাদ

একসঙ্গে ২৫টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছে ইরান, দাবি ইসরাইলের

একসঙ্গে ২৫টি ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়েছে ইরান, দাবি ইসরাইলের

মানিকগঞ্জে মানবপাচার মামলায় স্বামী স্ত্রী গ্ৰেফতার

মানিকগঞ্জে মানবপাচার মামলায় স্বামী স্ত্রী গ্ৰেফতার

জবিসাসের ১৯তম বর্ষপূর্তি  সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে রাজনীতি করতে হবে :  শহীদ উদ্দীন এ্যানি

জবিসাসের ১৯তম বর্ষপূর্তি সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে রাজনীতি করতে হবে :  শহীদ উদ্দীন এ্যানি

রাজশাহীতে মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ উপলক্ষে সেমিনার অনুষ্ঠিত

রাজশাহীতে মহানবী (সা.)-এর বিদায় হজ উপলক্ষে সেমিনার অনুষ্ঠিত

ইসলামী নেতৃত্বই জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে: অধ্যাপক আবদুল জব্বার

ইসলামী নেতৃত্বই জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে: অধ্যাপক আবদুল জব্বার