ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১
অর্থবছরের শেষ তিন মাস

অসম্ভব লক্ষ্যমাত্রায় চাপে এনবিআর

Daily Inqilab অর্থনৈতিক রিপোর্টার

০৬ মে ২০২৩, ১০:২৩ পিএম | আপডেট: ০৭ মে ২০২৩, ১২:০৩ এএম

অর্থবছর শেষ হতে বাকি ২ মাসেরও কম। যদিও রাজস্ব আয়ের হিসাব বাকি রয়েছে ৩ মাসের। আর তাই চলতি অর্থবছরের শেষ তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) গড়ে প্রতি মাসে ৪৮ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে হবে। যদিও আগের নয় মাসে সংস্থাটির মাসিক গড় আহরণ ২৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী তিন মাসে দ্বিগুণ কর আহরণ করতে হবে এনবিআরকে। এদিকে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর সুবিধা কমাতে শুরু করেছে সংস্থাটি। এ লক্ষ্যে ভোজ্যতেলের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা নবায়ন করেনি এনবিআর। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে চিনির ওপর শুল্ক অব্যাহতি সুবিধাও। এদিকে ভোজ্যতেল বা চিনি থেকে রাজস্ব সুবিধা অব্যাহতির ফলে আগামী কয়েক মাসে মাত্র ১ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বাড়তি রাজস্ব আহরণে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না। তাদের মতে, রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামী অর্থবছরকে ধরে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং এনবিআরের নানাবিধ সংস্কার করতে হবে। এদিকে ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফের লক্ষ্য পূরণে কঠিন চাপের মুখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহে করছাড় কমিয়ে দেওয়াসহ নানা উপায় খুঁজছে সংস্থাটি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আগামী কয়েক মাসে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ এখন আর নেই। চিনি বা ভোজ্যতেল থেকে কর সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে হয়তোবা ১ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ বাড়তে পারে। এতে এনবিআর’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে খুব একটা সুবিধা হবে না। তিনি মনে করেন, এনবিআর’র আগামী অর্থবছরের রাজস্ব আহরণকে টার্গেট করা উচিত। এজন্য সংস্থাটিকে সুচিন্তিতভাবে দেখতে হবে কোন কোন জায়গায় শুল্ক অব্যাহতি সুবিধা তুলে দেয়া যায়। এনবিআরকে সংস্কার কার্যক্রমে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পুরো কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। পলিসি প্রশাসনকে আলাদা করতে হবে। এছাড়া এখন কর আদায় করা হয় ভৌগোলিক দিক বিবেচনা করে, এখানেও সংস্কার জরুরি।

এদিকে এনবিআর’র চোখ যেন পড়ছে না ধনীর আয়ে। আসছে বাজেটে শুধু উচ্চ ধনীর সম্পদে সারচার্জ বাড়ানো হতে পারে। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হতে পারে। পাশাপাশি আয়কর রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতার ব্যাপ্তিও বাড়তে পারে। বিবিএসের হিসাবে, যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে আয় বৈষম্য এখন বেশি। করোনার মধ্যে উচ্চ ধনী বৃদ্ধির শীর্ষ দেশের তালিকায়ও উঠে আসে বাংলাদেশ।

এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. আলমগীর হোসেনের মতে, এমন বৈষম্যের পেছনে বড় কারণ ধনীদের থেকে সঠিক কর আদায় করতে না পারা। তবে ধনীদের সম্পদে আরোপিত সারচার্জে কিছু পরিবর্তন আসছে। বর্তমানে সম্পদ তিন কোটি টাকা পর্যন্ত হলে সারচার্জ দিতে হয় না। আসছে বাজেটে এই সীমা বাড়িয়ে চার কোটি করা হতে পারে। আর সম্পদের পরিমাণ এক শ কোটি টাকার বেশি হলে কর ৩৫ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হতে পারে।

ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ করা হতে পারে। একইভাবে নারী, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়বে। চলতি বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবার বিপরীতে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়। আসছে বাজেটে সেবার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আরও কিছু খাত। আগামী বাজেট নিয়ে ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবে এনবিআর। সেখানেই এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

একই সঙ্গে কয়েক হাজার এসআরওর (স্ট্যাটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার) মাধ্যমে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া রয়েছে। এসব এসআরও পর্যালোচনা করে কিছু বাতিল করতে হবে। আবার কিছু এসআরওর সময় কমিয়ে ১০ বছর থেকে পাঁচ বছরে আনতে হবে। এছাড়া যেগুলোতে শতভাগ কর মওকুফ সুবিধা দেয়া আছে সেখান থেকে অর্ধেক করে আনতে হবে।

চলতি অর্থবছরে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, সঙ্কট ও এলসিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে সবচেয়ে কম রাজস্ব আয় হয়েছে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে (কাস্টমস)। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মোট রাজস্ব ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে আমদানি পর্যায় (কাস্টমস) থেকে। এ খাতে ঘাটতির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এছাড়া মার্চ পর্যন্ত মোট রাজস্ব ঘাটতি ২৯ হাজার ৮ কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে যা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক (ভ্যাট) থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। তবে গত মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে কাস্টমস থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩ হাজার ১৮৭ কোটি, স্থানীয় পর্যায়ে মূসক (ভ্যাট) থেকে ৯৫ হাজার ১৪৫ কোটি এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ৭৬ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের সব খাতেই মার্চ মাস পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি এনবিআর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি কাস্টমস রাজস্বে। এর পরই রয়েছে ভ্যাটের রাজস্ব ঘাটতি, যা ৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ করে ঘাটতির পরিমাণ ৪ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, অর্থবছরের বাকি তিন মাসেও রাজস্ব আয়ে ঘাটতি অব্যাহত থাকবে এবং এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। বরং বছর শেষে এ খাতে বড় ঘাটতি দেখা দিতে পারে, যার প্রভাব পড়বে বাজেটের অন্যান্য খাতেও। বিশেষ করে নতুন শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যেতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ভ্যাট ও আয়করের ওপরও তার প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনেক জায়গায় ও বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া আছে। এসব কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিলে কী পরিমাণ রাজস্ব আহরণ বাড়বে তা এনবিআর জানে। এসব জায়গায় সতর্কতার সঙ্গে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ডলার সংকটের কারণে সরকার অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার একটা চেষ্টা করেছে। সেজন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানারকম কড়াকড়ি এসেছে, সেটলমেন্টও কমেছে। ফলে আমদানি ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ায় এ খাত থেকে শুল্ক আয়ও কমেছে। এ অর্থবছরে আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক রয়েছে এবং শেষেও এটা নেতিবাচকই থাকবে বলে মনে হচ্ছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

মার্কিনিদের লেবানন ছাড়ার আহ্বান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

সংঘাতের মধ্যে নতুন অস্ত্র সামনে আনলো ইরান

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স

ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন আন্ডারওয়াটার ড্রোন দেবে ফ্রান্স