ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯ আশ্বিন ১৪৩১
হুমকিতে মুহুরী সেচ প্রকল্প : বিপাকে কৃষক-মৎস্যজীবীরা

বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফেনীর নদীগুলো পানিশূন্য মুহুরি ও সিলোনিয়া

Daily Inqilab ছাগলনাইয়া (ফেনী) উপজেলা সংবাদদাতা

০৭ মে ২০২৩, ১০:৪৮ পিএম | আপডেট: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

বাঁচানো যাচ্ছে না ফেনীর নদ-নদীগুলো। এতদিন ফেনীবাসী জানতো দাগনভূঞার একটি অংশে ছোট ফেনী নদী বিলীনের পথে। এবছর দেখা যাচ্ছে ফেনীর ফুলগাজীর মুহুরি নদী ও সিলোনিয়া নদীও রয়েছে বিলীনের পথে। ভারতের উজান থেকে পানি না আসায় ও বেশ কয়েকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে মুহুরি ও সিলোনিয়া নদী।

ফেনী নদীর পানির ওপর নির্ভর করছে মুহুরী, কহুরা, কালিদাস পাহাড়িয়াসহ অসংখ্য ছড়া ও খাল। এগুলোর অস্তিত্ব ফেনী নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এসব নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদী তীরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ইরি-বোরো চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার ও বর্ষা মৌসুমে একতরফা পানি ছেড়ে দিয়ে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টিসহ নানা দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর মুহুরী সেচ প্রকল্পের ইরি-বোরো আবাদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

ফেনী সীমান্তের ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ওইসব এলাকায় বারো চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের নামে পাকা দেয়াল নির্মাণ, বড় বড় ২৭টি পাইপ বসিয়ে পাকা রাস্তা ও কালভার্ট তৈরি করে তার ওপর তিন স্তরবিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করে পানির উৎসমুখগুলো ভরাট করে দেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশে পানি প্রবাহ একেবারে কমে গেছে। এতে নদীতে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে কৃষকরা জানান।

ভারত একতরফাভাবে পানি আটকে রেখে নিজেরা চাষাবাদ করলেও শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করছে বলে সীমান্তবর্তী কৃষকদের অভিযোগ। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে সব পাইপের মুখ খুলে দিয়ে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি করে। তারা ৫৪টি নদীর প্রত্যেকটিতে একই কাজ করে আসছে। ভারত সীমান্তবর্তী ফুলছড়ি খাল, ছাগলনাইয়া খাল ও যশপুর খালসহ বিভিন্ন ছড়ার উজানে ভারত বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে রাখায় শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের নদীগুলোতে দেয়া স্লুুইস গেটগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতায় ফেনী নদী, মুহুরী ও কহুয়া নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমে ইরি-বোরো আবাদ হয়নি পানির অভাবে।

এদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য পাম্প বসিয়ে ফেনী নদীর পানি নিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের দ্বিতীয় মুহুরী সেচ প্রকল্প। ফেনী নদীর পানির ওপর চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। তীরবর্তী কয়েক লাখ লোক ফেনী নদীর পানির ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। চাষাবাদ ছাড়াও কয়েক হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস ফেনী নদী। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে কয়েক হাজার মৎস্য খামার।

ফেনী নদীর পানি ভারতের সাথে চুক্তি করায় সমগ্র অঞ্চলে দেখা দেবে মরুকরণ। ধ্বংস হবে প্রকৃতি ও প্রতিবেশ-পরিবেশ। ফেনী নদী মুহুরী নদীর শতকরা ৮০ ভাগ পানি সরবরাহ করে থাকে। অপরদিকে কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি নেই। ভারতের উজান থেকে পানি আসা বন্ধ দীর্ঘদিন। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে ফেনীর মুহুরী ও সিলোনিয়া নদী। ফলে বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাড়ছে ব্যয়। সঙ্কটে পড়েছেন মৎস্যজীবীরাও।

কৃষি অফিসের তথ্য মতে, ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় চলতি বছর ৩ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে আর ফুলগাজীতে ৪ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু নদীর পানি সঙ্কটে অন্তত ১ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হয়েছে। আরও আবাদকৃত জমি পানির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃষ্টি না হওয়ায় ও ভারতের উজান থেকে পানি না আসায় মুহুরী নদীর ফুলগাজী উপজেলার দেড়পাড়া গ্রাম থেকে পরশুরাম পর্যন্ত পানি শুকিয়ে গেছে। নদীর কিছু অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক বোরো ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। অপরদিকে সিলোনিয়া নদীর ফুলগাজী উপজেলার বন্দুয়া সেতু অংশের পূর্ব-পশ্চিম পাশে দেড় কিলোমিটার এলাকা ছাড়া বাকি অংশে পানি নেই। পানির অভাবে মাঠে ধান শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। কোথায় কোথাও গরমে ধান ক্ষেত পুড়ে গেছে। নদীর দুপাশে নিলক্ষী, গোসাইপুর, করইয়া, শ্রীবউরা, নোয়াপুর, কামাল্লা, রাজেশপুর, মনতলা, গাবতলা, মান্দারপুর ও পৈথারা গ্রামের হাজারও কৃষক বোরো ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ছেন। নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় এবং খনন না হওয়ায় নদীর পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতিতল নিচে নামছে।

স্থানীয়রা জানান, পলি মাটি, বালি ও ময়লা পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীগুলো মরা খালের মতো হয়ে গেছে। এরপরও বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর পানি উপচে আশপাশের এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের কৃষক রবিউল হক টিটু বলেন, দীর্ঘ ৫০ বছর এ জায়গায় আমরা জমি আবাদ করছি। পাঁচ বছর আগেও সিলোনিয়া নদীর পানি দিয়ে আমরা সেচ পানি দিতাম। এবার মাঠের কৃষি জমির ধান শুকিয়ে গেছে। এ মৌসুমে দুই একর জমিতে বোরো ধান চাষ করছি। ফসল পাবো কি-না দুশ্চিন্তায় আছি। কৃষক আবু মিয়া বলেন, নদী মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। বর্তমানে মাটিতে গর্ত করে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি উত্তোলন করে দিতে হচ্ছে। মাটির নিচ থেকেও ঠিকমতো পানি ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে ডিজেলের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।পরশুরাম পৌর এলাকার কোলাপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল খায়ের বলেন, বাংলাদেশ অংশে বাজারের পোলট্রি খামারের ময়লা আবর্জনা ফেলাসহ নানা কারণে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নদী শুকিয়ে গেছে।

পরশুরাম উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের বাগমারা এলাকার সেচ পাম্প মালিক মো. মোস্তফা শামীম বলেন, গ্রামের বেশিরভাগ জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে নদীতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরাও সঙ্কটে পড়ছেন। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা জমির হোসেন বলেন, বাড়ির পাশেই সিলোনিয়া নদী। কয়েক বছর আগেও এ নদী থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি। কিন্তু এখন আর নদীতে পানি নেই। ফলে মাছও পাওয়া যায় না। আমি এখন মাছ ধরা বাদ দিয়ে অটো চালাই। এভাবে আমার মতো অনেকেই পেশাবদল করেছেন।

ফুলগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। আবার নদীতে নাব্যতাও কম, খনন জরুরি। মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান ভুট্টু বলেন, কৃষকদের পানি সঙ্কটের বিষয়টি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। পানি সঙ্কটে বোরোর ফলন ব্যাহত হচ্ছে। ফেনীস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আখতার হোসেন বলেন, মুহুরী নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি। পানি সঙ্কটে এবারের বোরোর ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল বলেন, জেলা প্রশাসন ও কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জাতিসংঘ মহাসচিবের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ড. ইউনূস

জাতিসংঘ মহাসচিবের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ড. ইউনূস

এবার প্রকাশ্যে এলো চবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক

এবার প্রকাশ্যে এলো চবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক

আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি পঞ্চগড়ে

অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি পঞ্চগড়ে

সেনা কর্মকর্তা হত্যাকারীদের অবিলম্বে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে

সেনা কর্মকর্তা হত্যাকারীদের অবিলম্বে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে

সকল অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে -চকরিয়ায় নারী সমাবেশে বক্তারা

সকল অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে যার যার অবস্থান থেকে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে -চকরিয়ায় নারী সমাবেশে বক্তারা

সাগরে লঘুচাপ, চার সমুদ্রবন্দরে বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত

সাগরে লঘুচাপ, চার সমুদ্রবন্দরে বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত

বান্দরবানে জামাতুল আনসারের ৩১ সদস্য কে ৪ মামলায় জামিন

বান্দরবানে জামাতুল আনসারের ৩১ সদস্য কে ৪ মামলায় জামিন

হামজাকে পাওয়ার আরও কাছে বাংলাদেশ

হামজাকে পাওয়ার আরও কাছে বাংলাদেশ

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য চায় পবিপ্রবির গ্রাজুয়েটবৃন্দ

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য চায় পবিপ্রবির গ্রাজুয়েটবৃন্দ

সোনারগাঁওয়ে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা, আহত ৮

সোনারগাঁওয়ে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা, আহত ৮

ভারতীয় সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেলেন ড. ইউনূস

ভারতীয় সাংবাদিকদের এড়িয়ে গেলেন ড. ইউনূস

প্রকৃত আসামি ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হবে না : ডিএমপি

প্রকৃত আসামি ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হবে না : ডিএমপি

কুষ্টিয়ায় ভূমির অফিস সহায়ককে তুলে নেওয়ার অভিযোগ সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

কুষ্টিয়ায় ভূমির অফিস সহায়ককে তুলে নেওয়ার অভিযোগ সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হতে হবে: ববি হাজ্জাজ

হাসিনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হতে হবে: ববি হাজ্জাজ

রাজশাহী মহানগরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষণকারী সন্ত্রাসী রবি গ্রেপ্তার

রাজশাহী মহানগরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষণকারী সন্ত্রাসী রবি গ্রেপ্তার

দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাস ত্রাণ উপদেষ্টার

দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আশ্বাস ত্রাণ উপদেষ্টার

বিদেশে যেতে অনুমোদন লাগবে না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের: আসিফ নজরুল

বিদেশে যেতে অনুমোদন লাগবে না প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের: আসিফ নজরুল

বিদেশে যেতে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে না

বিদেশে যেতে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে না

চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ০.৫ শতাংশ কমানোর ঘোষণা

চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ০.৫ শতাংশ কমানোর ঘোষণা