ঢাকা   সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৮ আশ্বিন ১৪৩১
চলছে দ্রুত ধান কাটার কাজ দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তা

উপকূলীয় অঞ্চলে মোচা আতঙ্ক

Daily Inqilab ডিএম রেজা, খুলনা থেকে

০৭ মে ২০২৩, ১০:৫৭ পিএম | আপডেট: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলে বিরাজ করছে ঘূর্ণিঝড় মোচা আতঙ্ক। সুপার সাইক্লোন সিডর এবং ঘূর্ণিঝড় আইলা ও আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা উপকূলের মানুষ অজানা আশঙ্কায় দিন গুনছেন। আবহওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে আগামী সপ্তাহে ভূ-ভাগে আছড়ে পড়বে মোচা। যদিও এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, ঠিক দেশের কোন অংশ দিয়ে মোচা অতিক্রম করতে পারে। তারপরও এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনে চরম ভীতি কাজ করছে। ভীতির মূল কারণ দুর্বল বেড়িবাঁধ এবং মাঠের ফসল ও ঘেরের মাছ। তাছাড়া প্রবল জলোচ্ছাস ও প্রচন্ড ঝড়ে ঘরবাড়ি ভেঙে গৃহহীন হওয়ার আতঙ্ক তো রয়েছেই।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষাটের দশকে নির্মিত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ বেড়িবাঁধই খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ২০০৭ এ সিডর ও ২০০৯ সালে ঘুর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। এ মুহূর্তে সাতক্ষীরার প্রায় ৬২ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খুলনায় ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৩ কিলোমিটার এবং বাগেরহাটে ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০ কিলোমিটার বাঁধ। নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে প্রায়শঃ উপকূলীয় জনপদগুলো প্লাবিত হয়। ভেসে যায় মৎস্য ঘের, জমির ফসল। গৃহহীন হয় হাজার হাজার মানুষ। সম্প্রতি দু বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প শেষ করেছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পের আওতায় সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ১১ দশমিক ৫৩ কি.মি. বাঁধ সংস্কার ও পুননির্মাণ করে সেনাবাহিনী। গত বছর ৩০ মে খুলনার শেষ জনপদ কয়রায় আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাঁধটি হস্তান্তর করা হয়। এই বাঁধ পুননির্মাণের ফলে দুটি জেলার তিনটি উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানি মুক্ত হয়েছে। এছাড়াও তাদের ঘরবাড়ি, আবাদী জমি ও মাছের ঘের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে অন্যান্য স্থানে বাঁধ দুর্বল থাকায় এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে উপকূল জুড়ে।

জানা গেছে, গত দুই যুগে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে বাঁধ মেরামতে। কাজের কাজ তেমন হয়নি। সংস্কারের সময় ব্যাপক লুটপাট এবং পরিকল্পিতভাবে বাঁধ সংস্কার না করায় এ অবস্থা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাছাড়া, চিংড়ি নির্ভর অর্থনীতির অঞ্চল এই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অনেক স্থানে বাঁধ কেটে চিংড়ি ঘেরে নোনা পানি প্রবেশ করানোর কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের কোথাও কোথাও মাত্র দুই থেকে তিন ফুট চওড়া মাটির বাঁধ রয়েছে। এমন দুর্বল বেড়িবাঁধ ভাঙার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন উপকূলবাসী।
পাউবো সূত্র জানায়, ঘুর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর খুলনার কয়রা উপজেলার ২১টি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়। পাশাপাশি ২০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে সাত কিলোমিটারের বেশি সংস্কার কাজ চলমান। তবে এখনো ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। বর্তমানে উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকতে পারে।
উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, আমার ইউনিয়নের গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় নতুন প্রযুক্তিতে বাঁধ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, আগে থেকেই তীব্র নদী ভাঙনে সিসি ব্লক সরে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাটকাটা এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধ। উত্তর বেদকাশী থেকে দক্ষিণ বেদকাশী পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার বাঁধের ঢালে মাটি ধসে গেছে। কোথাও কোথাও দুই পাশের মাটি সরে বাঁধ সরু হয়ে গেছে।
মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, প্রতি বছর বাঁধ ভাঙছে। কেউ না কেউ নিঃস্ব হচ্ছে। বর্তমানে যে কয়েক জায়গায় বাঁধ ধসে গেছে, নদীতে জোয়ার বাড়লে বড় ক্ষতি হতে পারে।
পাউবো খুলনা শাখার উপসহকারী প্রকৌশলী মো. রোমিত হোসেন মনি বলেন, আমরা কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছি। বর্ষা মৌসুমের আগে ওই সব জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হবে।

এদিকে, মাঠের ফসল ও ঘেরের মাছ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলের মানুষ। এ মুহূর্তে মাঠে ধান কাটার কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে আঞ্চলিক কৃষি অফিস। বাকী ৩০ শতাংশ ধান কাটতে দু সপ্তাহ মত সময় লাগতে পারে। যদি এর মধ্যে ঝড় আঘাত হানে তাহলে কৃষকদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। তাই দ্রুত ধান কাটার কাজ চলছে।

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কৃষক আব্দুস সামাদ জানান, ৭ বিঘা জমির ধানের অর্ধেক কাটা হয়েছে। ১০ থেকে ১২ দিন লাগতে পারে বাকী ধান কাটতে। ঝড়ের আগে সব ধান কাটতে না পারলে সমস্যা হবে। একই সাথে তিনি বলেন, ধান হয়ত সব কাটা সম্ভব হবে, কিন্তু ঝড় জলোচ্ছাসে ঘরবাড়ি ভেসে গেলে কাটা ধান কোথায় রাখব আমরা ? একই রকম কথা জানান খুলনার দাকোপ উপজেলার কৃষক সমীরন দাস। তিনি জানান, উচ্চ সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এবার ১৬ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ধান ঘরে উঠবে। ঝড় ও জলোচ্ছাস হলে আমরা সর্বশান্ত হয়ে যাব।

শুধু ধান নয়, মাছের ঘের নিয়েও আতঙ্ক বিরাজ করছে উপকূলীয় অঞ্চলে। উপকূলীয় ৩ জেলায় লক্ষাধিক চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের ঘের রয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করেছে মাছ চাষ। দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘের প্লাবিত হলে মাছ সব ভেসে যাবে। আর মাছ ভেসে গেলে কয়েক লক্ষ ঘের ব্যবসায়ীকে পথে বসতে হবে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ঘের ব্যবসায়ী আলম দিদার শেখ জানান, তার ঘেরে ১ লাখ টাকার চিংড়ি রেণু পোণা ছেড়েছেন। মাছের খাবার ও অন্যান্য খাতে আরো প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ঘেরের চিংড়িগুলো এখন বড় হয়েছে। বিক্রি করলে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। ঘের তলিয়ে গেলে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবেন।

মোংলা উপজেলার ঘের ব্যবসায়ী সিরাজ মহালদার জানান, ধার দেনা করে তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার গলদা পোণা ঘেরে ছেড়েছেন। সেগুলো বড় হয়ে বিক্রির উপযোগি হয়েছে। প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ বাদ দিলেও কমপক্ষে লাভ হবে তিন লাখ টাকা। এখন ঝড়ের কথা শুনে তিনি চাখে মুখে অন্ধকার দেখছেন। উপকূলের মানুষ আশা করছেন, মোচা উপকূলে আঘাত করবে না।

যেকোনো ঘূর্ণিঝড় উপকূলের মানুষের জীবনযাত্রাকে স্থবির করে দেয়। সর্বস্ব হারিয়ে তাদের পথে বসতে হয়। প্রাণহানি ঘটে। গবাদি পশু হারিয়ে কৃষককে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সুন্দরবন এবং সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করা, বেড়িবাঁধের যথাযথ সংস্কার এবং দুর্যোগ পরবর্তী সাধারণ মানুষের দুর্দশা দূর করতে সরকারের আরো বেশি আন্তরিকতা প্রত্যাশা করেন উপকূলের অর্ধ কোটি মানুষ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

গোল উৎসবে বার্সার ছয়ে ছয়

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

রোনালদোর দ্রততম শত গোলের রেকর্ড ছুঁলেন হল্যান্ড

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

ঘটনাবহুল ড্রয়ে শেষ আর্সনাল-সিটি মহারণ

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

বায়তুল মোকাররমের ঘটনার জেরে ইফা মহাপরিচালক প্রত্যাহার

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

কোর্ট ম্যারেজ করা প্রসঙ্গে?

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

এখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের রেখেছেন কেন? - রিজভী

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

রাষ্ট্র গঠনে যা করা জরুরি

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রস্তাবনা

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ঈশ্বরদীতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান তুহিনসহ যুবদল নেতাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

ইসরাইল এখনো সন্ত্রাসীর মতো হামলা চালাচ্ছে

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন অতিশী

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

ওরা পার্বত্য অঞ্চলকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানাতে চায়

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

বৃষ্টির মতো রকেট নিক্ষেপ হিজবুল্লাহর পালিয়েছেন লাখ লাখ ইসরাইলি

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে অশান্তির বীজ উপরে ফেলতে হবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে : বাংলাদেশ ন্যাপ

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

শৈলকুপায় অস্ত্র ও গুলিসহ ২ জন আটক

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

অশান্ত মণিপুরে সেনা টহল

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

‘ট্রাম্প ও তার দল ভণ্ডামি করছে’

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী

হেলিকপ্টারে যেতে পারলেন না ভারতের দুই মন্ত্রী