প্লটের চেয়ে বুকিং বেশি

‘পুষ্পধারা’র স্বপ্ন বিক্রি

Daily Inqilab সাঈদ আহমেদ/ এম.এ. কাইয়ুম

১৮ মে ২০২৩, ১১:২২ পিএম | আপডেট: ১৮ মে ২০২৩, ১১:২২ পিএম

হাতিয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা
‘স্বপ্ন সত্যি হবেই...’ এমন চূড়ান্ত নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? জ্যোতিষশাস্ত্রী, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা কিংবা কোনো দ্বৈবজ্ঞ? না। কারও পক্ষেই এতোটা দৃঢ় প্রত্যয়ে বলা সম্ভব নয়। সর্বজ্ঞ মহান আল্লাহই বলতে পারেন পরের মুহূর্তটাতে বান্দার কি ঘটবে। অনিশ্চিত নশ্বর পৃথিবীর জীবন-কুলেহিকা মিলিয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। কিন্তু তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে। আশায় বুক বাঁধে। আর সেই স্বপ্ন এবং আশাকে পুঁজি করেই চলছে প্রতারণা। ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:’ গত ৮ বছর ধরে চালিয়ে আসছে এই প্রতারণা। সরকারি বিভিন্ন দফতরের একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা এবং চটকদার প্রচার-প্রচারণাই প্রতিষ্ঠানটির পুঁজি। বিপণনকর্মীদের মনোমমুগ্ধকর উপস্থাপনায় সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করা হয় প্লট, ফ্ল্যাট, ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স এবং কনডোমিনিয়াম ক্রয়ে। বাসস্থান নিশ্চিত করা নয়। মূল টার্গেট যেকোনো প্রকারে গ্রাহকের পকেট খালি করা। অর্থ হাতিয়ে নিতে ঢাকায় হেড অফিস, করপোরেট অফিস ছাড়াও অফিস খুলেছে খুলনায়। প্রবাসীদের অর্থ হাতিয়ে নিতে শাখা খুলেছে মালয়েশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায়। প্রতিবেদকের গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে কথিত এ আবাসন প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের প্রতারণা, অর্থ আত্মসাত, বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া, অর্থ পাচার, কৃষকের জমি দখল, প্রাকৃতিক জলাভ‚মি ভরাট, কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতিসাধনসহ বেআইনি নানা কার্যকলাপ।

বুকিং বাণিজ্য : ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:-এর যাত্রা ২০১৪ সালে। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পদ্মা সেতু সংলগ্ন এলাকায় পুষ্পধারার ‘পদ্মা ভ্যালি’ ও ‘পদ্মা ইকোসিটি’ নামে চালু করেছে ২টি প্রকল্প। মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর মৌজায় মাত্র ৭০ শতাংশ জমি নিয়ে ‘প্রকল্প’ ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। আবাসন আইন ও বিধিবিধান মেনে প্লট করা হলে এইটুকুন জমিতে সর্বোচ্চ ৫টি প্লট করা সম্ভব। এই কয়েকটি প্লট নিয়েই পুষ্পধারা প্রপার্টিজ মাঝেমধ্যেই আয়োজন করে ‘বর্ণাঢ্য আবাসন মেলা’র। ‘পদ্মা ভ্যালি’ প্রকল্পে ৩ কাঠা, ৫ কাঠা ও ১০ কাঠা আয়তনের প্লট বুকিং নেয়া হচ্ছে। ‘পদ্মা ইকো সিটি’ নামক প্রকল্পে বুকিং নেয়া হচ্ছে ৩ কাঠা, ৪ কাঠা, ৫ কাঠা, ৬ কাঠা, ১০ কাঠা ও ১ বিঘা আয়তনের প্লটের। একই প্রকল্পে ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স, ভিলা এবং কন্ডোমিনিয়ামের বুকিংও নেয়া হচ্ছে। প্রচারিত ‘লে-আউট’ অনুযায়ী ঢাকা-মাওয়া সড়কে পদ্মা ব্রিজের দিকে যেতে হাসাড়া বাসস্ট্যান্ড এবং ষোলোঘর এলাকায় হাতের ডানে অবস্থিত পুষ্পধারার ‘পদ্মা ইকো সিটি’। প্রদর্শিত ৩টি সেক্টরের ভেতর রয়েছে কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক জলাভ‚মি, নালা ও খাস জমি। এর ওপর প্লটের লে-আউট দেখানো হয়েছে ৩ হাজারের বেশি। অন্যের মালিকাধীন কৃষিজমিকেও প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেখানো হয়েছে। গুগল ম্যাপ এবং লে-আউটের কাগুজে অবস্থান দেখিয়ে নেয়া হয়েছে বুকিং মানি।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ঢাকা-মাওয়া সড়ক ধরে পদ্মা সেতুর দিকে যেতে হাতের বাঁ পাশে দেখা মেলে ‘পুষ্পধারা’ প্রকল্পের অসংখ্য সাইনবোর্ড। মূলত: সাইনবোর্ড স্থাপনের জন্য জায়গাগুলোও নেয়া হয়েছে ভাড়ায়। তবে পুষ্পধারার কাছে যারা সাইন বোর্ড স্থাপনের জন্য কৃষিজমি ভাড়া দিয়েছেন তারাও এখন রয়েছেন জমি হারানোর আশঙ্কায়।

কৃষকের জমি দখল : দৈনিক ইনকিলাবের পদ্মা সেতু উত্তর (মুন্সিগঞ্জ) সংবাদদাতা এমএ কাইয়ুম জানান, প্রকল্পের পরিধি বাড়াতে একের পর এক কৃষকের জমি দখল করছে পুষ্পধারা। মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর উপজেলার ইউনিয়নের মুন্সীরহাটি এলাকার মৃত গেন্দু শেখের ছেলে সাহাবুদ্দিন অভিযোগ করেন, গত বছর ২৬ অক্টোবর শ্রীনগর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে আমমোক্তারনামা দলিল নং-৯৬৪২/২২ মূলে ষোলঘর মৌজার আমার ১ একর ৪৩ শতাংশ নাল জমি কেয়টখালি এলাকার আজাদকে শনাক্তকারী দেখিয়ে পুষ্পধারা মালিক আলী নুর তার নিজ নামে লিখে নিয়েছেন। ভুক্তভোগী সাহাবুদ্দিন এখন মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতিপূর্বে পুষ্পধারা ও অন্যান্য কথিত কোম্পানির মধ্যে কয়েক দফা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি ঘটে। আগুন লাগানো হয়। পুষ্পধারা অফিসের পাশে আর এস দাগ নং-১০৪১ মোট জমির পরিমাণ ৩৬ শতক। জমিটির মালিক ৫ ভাই ও তিন বোন। ৫ ভাই হতে ইতোমধ্যে মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে জাকির হোসেন ও মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে মিজান বায়না মূলে ক্রয় করেন। জমিতে সাইনবোর্ড স্থাপন করার পর হতে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে পুষ্পধারায় নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী। অন্য দিকে পুষ্পধারার দাবি, তারা জমিটি বায়না করা হয়েছে। তাই জমির মালিকানা তাদের। জমির মালিক মো. জাকির হোসেন বলেন, টাকা দিয়ে জমিক্রয় করেছি। সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি। তাদের অফিসের পাশে আমার জমি হওয়ায় উক্ত জমি ছেড়ে দিতে বিভিন্নভাবে আমাদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে পুষ্পধারা আবাসন কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি, আপনার সাথে এ ব্যাপারে পরে কথা বলব।

নিজস্ব ‘নীতিমালা’ : শুভঙ্করের ফাঁকি : প্লট বিক্রির নামে পুষ্পধারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতিরই তোয়াক্কা করেনি। অথচ গ্রাহকের আস্থা অর্জনে নিজেদের মতো তৈরি করে নিয়েছে ‘প্লট বরাদ্দের নীতিমালা‘। কথিত এই ‘নীতিমালা‘ আপাত: গ্রাহকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মনে হলেও এতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। স্বআরোপিত নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, সকল প্রকার পেমেন্ট ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:’-এর অনুকূলে নগদ/ চেক/ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করে কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত মানি রিসিপ্ট সংগ্রহ করতে পারবেন। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকিটি হচ্ছে, কোম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকা নেয়া হলেও যে প্লটটি পছন্দ করে গ্রাহক বুকিং দিচ্ছেন সেটির দলিলই কোম্পানির নামে নয়। এটি কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নামে আমমোক্তার নেয়া, বায়নাকৃত কিংবা খরিদকৃত। ফলে গ্রাহক যখন প্রতারিত হয়ে আইনের আশ্রয় নেন, তখন দলিলসূত্রে সম্পত্তির মালিকগণ গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো টাকা নিয়েছেনÑ মর্মে প্রমাণ করা যায় না। অর্থাৎ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে কোম্পানির নামে। নিজেদের মতো করে মুদ্রিত মানি রিসিপ্টটি দেয়া হচ্ছে কোম্পানি থেকে। অথচ প্লটের জমি দলিল ব্যক্তির নামে। আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে ২০১৫ সাল থেকে। পুষ্পধারা সেই গ্যাস সংযোগেরও আশ্বাস দিচ্ছে ‘প্লট বরাদ্দ নীতিমালা’য়। গ্যাস সংযোগের ‘খরচ’ জোগাবেন প্লটের গ্রাহক।

আবার ‘প্রকল্পের স্বার্থে’ অথবা ‘অনিবার্য কারণবশত’ প্রকল্পের ডিজাইন এবং লে-আউটের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার ক্ষমতা রাখা হয়েছে কোম্পানির হাতে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের কোনো আপত্তিই গ্রহণযোগ্য হবে না। স্ব-আরোপিত ভয়াবহ এই ‘নীতি’ দিয়েই ঘটছে গ্রাহকের সঙ্গে সবচেয়ে বড় প্রতারণা এবং দুর্নীতিটি। অর্থাৎ লে-আউট দেখে গ্রাহক যে প্লটটি বুকিং দিচ্ছেন, কিস্তি পরিশোধ করছেন, সেটি তিনি বুঝে পাবেন নাÑ এমন ইঙ্গিতই এখানে রয়েছে। কথিত নীতির বলেই পুষ্পধারা নির্দিষ্ট প্লট বরাদ্দের নামে করছে নয়ছয়। আবার এমনটিও বলা হয়েছে, যদি কোনো কারণে সরকার প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করে তাহলে প্রথমপক্ষ (পুষ্পধারা) কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না। সে ক্ষেত্রে গ্রহিতার প্রদেয় সম্পূর্ণ অর্থ প্রথমপক্ষ কর্তৃক কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ফেরত দেয়া হবে। ‘কোম্পানির নিয়ম’ বলতে এখানে পুষ্পধারার মনগড়া নিয়মকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থফেরত দেয়ার প্রশ্নে গ্রাহকের সঙ্গে কি আচরণ করা হতে পারেÑ এতেই এটি অনুমেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনোরূপ বিলম্ব হলে তা গ্রহিতার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। গ্রাহককে যথাসময়ে প্লট, ফ্ল্যাট হস্তান্তর প্রশ্নে বিলম্ব পুষ্পধারার কথিত এই নীতিমালাকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ এবং ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে।

বুকিং বাতিল করলে কিংবা কিস্তি চালাতে অসমর্থ হলেও টাকা ফেরত না দেয়ার বিষয়টিও প্রচ্ছন্নভাবে ‘নীতিমালায়’ উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত নীতিমালা অনুযায়ী, যদিও টাকা ফেরত দেয়া হয়, তাহলে তা থেকে ‘বুকিং মানি’ কেটে রাখা হবে। বাকি টাকা ফেরত দেয়া হবে ৪ কিস্তিতে। কিন্তু কত দিন পর পর কিস্তি করা হবে, কি ফরম্যাটে ফেরত দেয়া হবে তা অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:-এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্লট গ্রহিতা বুকিংয়ের পর যথাযথ কারণ ছাড়া ৩ মাস কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হলে কোম্পানি প্লট বুকিং বাতিল করতে পারবে। স্বআরোপিত কথিত এই নীতিমালার পরতে পরতে রয়েছেÑ শুভঙ্করের ফাঁকি। পুষ্পধারাকে অর্থ প্রদান ছাড়া গ্রাহকের আর কোনো স্বার্থের কথাই কথিত এ নীতিমালায় নেই।

অবৈধ প্রকল্প : রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এবং বিধিমালা-২০১১ অনুযায়ী বেসরকারি আবাসন প্রকল্পকে অবশ্যই জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধনের মেয়াদ হালনাগাদ হতে হবে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধন নবায়নের সর্বশেষ যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে ৩৬টি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:’, ‘পদ্মা ইকো সিটি’ এবং ‘পদ্মা ভ্যালি’র নাম নেই। অথচ পুষ্পধারা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন (জাগৃক/৬২) রয়েছে মর্মে ব্রæশিয়রে উল্লেখ করছে। এমনকি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের তালিকায়ও ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:’ ‘পদ্মা ইকো সিটি’ কিংবা ‘পদ্মা ভ্যালি’র কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখা বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভ‚মি উন্নয়ন বিধিমালা,২০০৪ (সংশোধিত ২০১২-২০১৫) নিবন্ধিত উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রকাশ করে। তাতে ১৮৫টি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এ তালিকায় নাম নেই ‘পুষ্পধারা’র। অথচ পুষ্পধারা কল্পিত লে-আউট দেখিয়ে দেদারসে প্লট বিক্রি করছে।

পুষ্পধারা প্লট বিক্রি করছে ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভলপার্স এসোসিয়েশন’ (বিএলডিএ) সদস্য দাবি করে। এটি ২০০৬ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোম্পানি অ্যাক্টে নিবন্ধিত একটি বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন। ৩২৭টি প্রতিষ্ঠান এই সংগঠনের সদস্য। ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:’ এই সংগঠনের সদস্য (নং-২৪১)। ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর বিএলডিএ’র সদস্য হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির ‘পদ্ম ইকো সিটি’ এবং ‘পদ্মা ভ্যালি’ বিএলডিএ’র সদস্য নয়। বিএলডিএ’র বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন প্রদানকারী কোনো কর্তৃপক্ষ নয়। আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডাম, ট্রেডলাইসেন্স, প্রকল্প বিবরণ, ইনকরপোরেশন সার্টিফিকেট, কোম্পানির ট্যাক্স সার্টিফিকেট, উদ্যোক্তার ফটো, এনআইডি’র কথা বলা হলের সদস্যপদ লাভের জন্য রাজউক, জাগৃক’র অনুমোদন, পরিবেশ ছাড়পত্র ইত্যাদি বাধ্যতামূলক করা হয়নি। সংগঠন শুধু রিয়েল এস্টেট কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় এ সংগঠন কাজ করে।

পদস্থ ব্যক্তিরাই বিজ্ঞাপন : পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লি:-এর তার প্রতারণা ও শত শত কোটি টাকা আত্মসাতে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর‘ হিসেবে কাজে লাগান বিভিন্ন শ্রেণিপেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ, প্রশাসন ক্যাডার, ব্যাংকার, এনবিআর, কাস্টমস, দুদক, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক-সাংবাদিকদের কাজে লাগনো হয়। কাউকে ব্যবসায়িক অংশীদার করে নেন। কাউকে মাসোহারা দেন। কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেয়া হয় অন-অ্যারাইভাল পেমেন্ট। এসব ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে ‘আবাসন মেলা’ সহ বিভিন্ন ছুতোয় আয়োজন করা হয় গেট টুগেদারের। এখানে নিশ্চিত করা হয় তাদের উপস্থিতি। কখনওবা পুষ্পধারার সাইটে প্লট দেখাতে নিয়ে করা হয় ফটোসেশন। এই ফটো পরবর্তীতে ফেসবুক, ওয়েবসাইটসহ প্রচারপত্রে ব্যবহার করা হয়। প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানগুলোতে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে বেশি। এর মধ্যে রয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক গোলাম মোস্তফা, মহাব্যবস্থাপক ইউনূস আলী, মহাব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম, ইসহাক আলী এবং ইস্কান্দার আলী। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিএমদের মধ্যে মো: রফিকুল ইসলাম, বিষ্ণুপদ বিশ্বাস, সিরাজুল ইসলাম, আ: হালিম, নেসার আহমেদ ভূঁইয়া, শিকদার সিদ্দিকুর রহমান, উপ-পরিচালক মঈন উদ্দিন খান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি আনোয়ার হোসেন এবং অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব শাহ মো: আবু রায়হান আলবেরুণী। তাদের মাধ্যমে কোনো গ্রাহক প্লট বুকিং দিলে কমিশন বাবদ পেয়ে যান মোটা অংকের অর্থ। অনেক চাকরিজীবী সরকারি চাকরির পাশাপাশি পুষ্পধারার বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। তেমনই একজন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কনস্টেবল শামিমা সুলতানা। পুষ্পধারা তাকে ‘দুদক অফিসার’ হিসেবে উপস্থাপন করে। শামিমার মাধ্যমে এ যাবত ১০/১২টি প্লট বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক : রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে প্রতারণা, গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলী নূর ইসলাম এবং তার সহযোগিরা রাতারাতি বনে গেছেন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ। দেশ-বিদেশে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। জনশ্রæতি আছে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো: দেলোয়ার হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ মিয়া বুলু,মহাব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক, জিএম আব্দুল্লাহ আল মামুন, মার্কেটিং অফিসার মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান (শাশ্বত মনির) এখন টাকার জাজিমের ওপর ঘুমান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপি, মন্ত্রী, থানা-পুলিশ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক, পরিবেশ অধিদফতর, ডিসি অফিস, ভ‚মি অফিস অনেকটাই তাদের পকেটে। নির্ধারিত সময়ে মাসোহারা পৌঁছে দিয়ে তাদের রেখেছেন প্রতারণার ‘সযোগী’ করে। ফলে এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রতারিত, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া গ্রাহকের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। অসহায় একাকী গ্রাহক তখন উল্টো মামলা-হামলার ভয়ে পুষ্পধারার প্রতারণাকে নিয়তি বলে মেনে নেন।

কি বলছে সরকারি দফতরগুলো : হাউজিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় ভ‚মি ব্যবহারে অনুমোদন নিতে হয় জেলা প্রশাসন থেকে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের বর্তমান জেলা প্রশাসন পুষ্পধারা নামক কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়নি বলে জানানো হয়। এ বিষয়ে কথা বলতে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুলের সাক্ষাৎ চাওয়া হয়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তার সাক্ষাৎ মেলেনি। তবে কথা বলেন মুন্সিগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্নেহাশীষ দাশ। পুষ্পধারার প্রতারণার দায় অনেকটা গ্রাহকের ঘাড়েই চাপিয়ে তিনি বলেন, তারা (পুষ্পধারা) জমি নিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছেÑ এমন কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। এমনটি ঘটে থাকলে গ্রাহকেরও উচিৎ সচেতন হওয়া। বুঝেশুনে খোঁজ-খবর নিয়েই প্লট কেনা উচিৎ। তিনি বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক এ ধরনের কোনো আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেননি।

সিরাজদিখান সহকারী কমিশনার (ল্যান্ড) উম্মে হাবিবা ফারজানা অবশ্য স্বীকার করেন, বেশ কিছু অবৈধ হাউজিং প্রকল্প তার অধিক্ষেত্রে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এমন হাউজিং কোম্পানিও রয়েছে, যাদের আওতায় খাস জমি রয়েছে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর বেদখল হওয়া খাস জমির পরিমাণসহ তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছি।
শ্রীনগর উপজেলা এসি (ল্যান্ড) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এখন পর্যন্ত এসব হাউজিং প্রকল্পগুলোর কোনো পেপারস আমাদের হাতে নেই। তাদের কোম্পানির নামে আমাদের এখান থেকে কোনো নামজারি হয়নি।

পরিবেশ অধিদফতর, মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: আখতারুজ্জামান টুকু এ বলেন, আমাদের জনবল কম। তা সত্তে¡ও ১০/১২টি অবৈধ হাউজিং প্রকল্পকে নোটিফাই করেছি। হাউজিং কোম্পানি পরিবেশ দূষণের মতো কিছু ঘটাচ্ছে কি-না, সেটি দেখার মতো জনবল আমাদের নেই।

‘পুষ্পধারা’ সহ রাজধানীর আশপাশে গজিয়ে ওঠা অবৈধ রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো: মুনিম হাসান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ঢাকার আশপাশে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট কোম্পানি খুলে অবৈধভাবে প্লট বিক্রি করছে। অনুমোদনহীন এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরা একটি ড্রাইভ দেব।

এসব বিষয়ে কথা বলতে গত বুধবার ফোন করা হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলীনূর ইসলামকে। প্রতিবারই তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। আরেকটি নম্বরে কল করা হলে এটি ধরেন অন্য ব্যক্তি। তিনি বলেন, এটি ‘স্যার’-এর নম্বর নয়।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিতে সমন্বয় দরকার : স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী

স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিতে সমন্বয় দরকার : স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী

সরকার টিসিবির জন্য ৪৯৩ কোটি টাকার ভোজ্যতেল ক্রয় করবে

সরকার টিসিবির জন্য ৪৯৩ কোটি টাকার ভোজ্যতেল ক্রয় করবে

শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের পরম বন্ধু : প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী

শেখ হাসিনা অসহায় মানুষের পরম বন্ধু : প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী

কুমিল্লা নগরীর বিসমিল্লাহ হাউজ থেকে চীনা নারীর লাশ উদ্ধার

কুমিল্লা নগরীর বিসমিল্লাহ হাউজ থেকে চীনা নারীর লাশ উদ্ধার

ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনাল, পরিসংখ্যানে কারা এগিয়ে?

ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনাল, পরিসংখ্যানে কারা এগিয়ে?

মোরেলগঞ্জে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার স্বামী আটক।

মোরেলগঞ্জে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার স্বামী আটক।

দেশনেত্রী খালেদাকে মুক্তি দিন অন্যথায় যেকোনো পরিণতির জন্য তৈরি থাকুন : ফখরুল

দেশনেত্রী খালেদাকে মুক্তি দিন অন্যথায় যেকোনো পরিণতির জন্য তৈরি থাকুন : ফখরুল

কেমন হবে ফাইনালের পিচ

কেমন হবে ফাইনালের পিচ

বিএনপিতে এখন আতঙ্কের নাম তারেক রহমান : ওবায়দুল কাদের

বিএনপিতে এখন আতঙ্কের নাম তারেক রহমান : ওবায়দুল কাদের

মাদারীপুরে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি চরম

মাদারীপুরে লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি চরম

৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ সবসময় অগণতান্ত্রিক ও অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ সবসময় অগণতান্ত্রিক ও অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

এফবিসিসিআই’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখতে সাপ্লাই-চেইন স্থিতিশীল রাখার আহ্বান

এফবিসিসিআই’র স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখতে সাপ্লাই-চেইন স্থিতিশীল রাখার আহ্বান

শুল্ক রেয়াত কর্মকর্তা তাজুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

শুল্ক রেয়াত কর্মকর্তা তাজুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

সরকার দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া পীর সাহেব চরমোনাই

সরকার দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া পীর সাহেব চরমোনাই

‘আশা করি, তারা এবার চোক করবে না'

‘আশা করি, তারা এবার চোক করবে না'

নির্বাচন জায়েজ করতে শেখ হাসিনা দেশবিরোধী চুক্তি করেছেন : রিজভী

নির্বাচন জায়েজ করতে শেখ হাসিনা দেশবিরোধী চুক্তি করেছেন : রিজভী

কুষ্টিয়ায় পাহারাদারকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা

কুষ্টিয়ায় পাহারাদারকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা

অ্যান্টার্কটিকার বৃহত্তম হিমবাহ সরে যাচ্ছে

অ্যান্টার্কটিকার বৃহত্তম হিমবাহ সরে যাচ্ছে

স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে স্বরূপে ফেরার অপেক্ষায় ইংল্যান্ড

স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে স্বরূপে ফেরার অপেক্ষায় ইংল্যান্ড

নোয়াখালীর হাতিয়ায় মসজিদের পুকুরে ধরা পড়ল ১০ ইলিশ!

নোয়াখালীর হাতিয়ায় মসজিদের পুকুরে ধরা পড়ল ১০ ইলিশ!