রিফিউজি জীবন আর নয় আমরা দেশে ফিরতে চাই’
০৯ জুন ২০২৩, ১১:৩০ পিএম | আপডেট: ১০ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম
প্রায় ছয় বছর পর রোহিঙ্গারা হঠাৎ করে দেশে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ‘গো ব্যাক ক্যাম্পেইন’ শুরু করেছে ক্যাম্পগুলোতে। কেন হঠাৎ এই ক্যাম্পেইন-এমন প্রশ্নের উত্তরে রোহিঙ্গা নেতা জোবায়েরসহ বেশ কয়েকজন নেতা জানান, তারা বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে আর থাকতে চাননা। শিগগীরই নিজ দেশের ভিটে মাটিতে ফিরতে চান তারা। গতকাল উখিয়ার কতুপালং লম্বাশিয়া ও বালুখালী ক্যাম্পে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা বলেন রোহিঙ্গা নেতারা। নিজ দেশে ফিরতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযেগিতা কামনা করেন তারা। এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার উখিয়া-টেকনাফের ৮টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বতঃস্ফূর্ত মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে তারা।
জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলে আসছিল রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে মিয়ানমারে বা স্বদেশে প্রত্যাবাসন করা ঠিক হবে না। এই সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু এনজিও সংস্থা এবং মিয়ানমারের কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এতদিন পর্যন্ত সাধারণ রোহিঙ্গাদেরকে প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলার থেকে নানা কৌশলে বিরত রেখেছিল। এখন সাধারণ রোহিঙ্গারা নিজের থেকেই বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে আর নয়। এখনই সময় দেশে ফিরে যাওয়ার। বিশ্ব সম্প্রদায় তাদেরকে স্বদেশে পুনর্বাসনে উদ্যোগী হয়েছে।
আসলে রোহিঙ্গা সমস্যাটি পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের। ২০১৭ সালে সেনা নির্যাতনের মুখে আরাকান রাজ্যের নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ায় এটি এখন বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসলেও বাংলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং সার্বিক সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি তাদের নিজের দেশ মিয়ানমারের আরকানে প্রত্যাবাসনের কাজটিও করে আসছিল শুরু থেকেই। এজন্য মিয়ানমার-চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নিয়ে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতাসহ নানা কারণে এই প্রত্যাবাসন হোঁচট খেয়েছে বারবার।
দেখা গেছে যখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে এসেছে সুবিধাভোগী মহলের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোন না কোন অঘটনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক আরসা ও আল একিনের মত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো হয় গোলাগুলি নতুবা অগ্নিকা- অথবা অন্য কোন গোলযোগের ঘটনা ঘটাতে দেখা গেছে। এমনকি ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা মুখ খোলতে পারত না। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে হঠাৎ উদ্যোগী হয়েছে মিয়ানমার। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত দুইমাস আগে ইয়াঙ্গুনে নিযুক্ত আট দেশের কূটনীতিককে রাখাইনে বা আরাকানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের কূটনীতিকেরাও ছিলেন।
এরপর মিয়ানমার প্রতিনিধি দল দুই দফায় বাংলাদেশের টেকনাফ সফর করে বাংলাদেশের দেয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে গেছেন। এছাড়াও গত মাসে ২০ সদস্যের রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধির দল মিয়ানমারের মংডু সফর করে সেখানে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অগ্রগতি পরিদর্শন করে এসেছেন। মংডুতে মিয়ানমার সরকার ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য কটেজ টাইপের ঘর নির্মাণ করেছেন। রোহিঙ্গাদের সেখানে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। তবে মংডু সফরকারি রোহিঙ্গা দলের সদস্যরা সেদিন জানিয়েছিলেন তারা বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে গিয়ে সেখানে ক্যাম্পে থাকবেনা। তারা নিজেদের ভিটে-বাড়ি ও জায়গা জমি ফিরে পেতে চায়। স্বাধীন নাগরিক অধিকার নিয়ে তারা নিজ দেশে ফিরতে চায়।
উখিয়া টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজনের মতো অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতার দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে এটি একটি শুভ লক্ষণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি রোহিঙ্গাদের হাতছাড়া করা ঠিক হবেনা।
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলাদাভাবে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য ‘গো ব্যাক ক্যাম্পেইন’ করেছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পেইন শেষে বিভিন্ন ক্যাম্পে খোলা মাঠে সমাবেশের আয়োজন ও করে তারা। সমাবেশে বিভিন্ন ক্যাম্পের হাজার হাজার রোহিঙ্গা কমিউনিটির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানে নিজ দেশ মিয়ানমারে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়া, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা এবং অন্যান্যরা জাতিগোষ্ঠীর লোকজন যেভাবে অবাধে চলাফেরা করে তেমন স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়। এছাড়াও নি¤েœাক্ত দাবিগুলো নিয়েও রোহিঙ্গারা ছিল স্বরব।
‘রিফিউজি জীবন আর নয়, আমরা বাড়ি ফিরতে চাই’ শ্লোগানে ছিল সমাবেশগুলো মুখর। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যে তারা বলেন ‘আমাদের এই রেশন ব্যবস্থার দরকার নেই, আমাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করেন। সমাবেশে রোহিঙ্গারা তাদের আশ্রয় প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করে সবাই নিজ নিজ শেল্টারে চলে যায়।
এদিকে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়েরসহ বেশকিছু রোহিঙ্গারা বলেন, আমরা আর শরণার্থী জীবন চাই না। সামনের দিনগুলোতে আমরাও আমাদের জন্মভূমি আরাকানে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চাই। বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যাপারে যেন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা এতদিন সন্ত্রাসীদের ভয়ে কথা বলতে পারেনি। এখন আর ভয় নয়, তারা দেশে ফিরতে চায়।
জানা গেছে, চীনের উদ্যোগে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হওয়া এক হাজার রোহিঙ্গার সাথে মার্চে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বৈঠক করার কথা জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে মাত্র এক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে চীন মূলত মিয়ানমারের স্বার্থকে রক্ষা করবে এটিই মনে হচ্ছে। পর্যবেক্ষদের মতে যাই হউক প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া দরকার।
এদিকে মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ফিরে যাওয়া ওইসব রোহিঙ্গাদের জন্য দু‘টি আশ্রয় শিবির প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন (আরএফএ) রাখাইন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ও রাজ্যের মুখপাত্র হ্লা থেইন। সম্প্রতি ওই আশ্রয় শিবির পরিদর্শে গিয়েছিল ২০ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, “একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসিত করার একটি প্রস্তাবের বিষয়ে গত দুই-তিন বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে চীনের সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ত্রি-পক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের মধ্যস্থতায় একটি পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গার টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
২০২১ সালের অক্টোবরে এই প্রকল্পের অধীনে ৭১১ জন মুসলিম রোহিঙ্গা এবং ৩১৭ জন হিন্দু রোহিঙ্গার দুটি তালিকা পাঠানো হয়। দুই পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু করার সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া স্থবির হয়েছিল। তবে সম্প্রতি পাইলট প্রকল্পটির মাধ্যমে আরাকানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টি সামনে আসে। পর্যবেক্ষকদের মতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠী যেমন ফিরে পাবে তাদের নিজেদের ভিটে-বাড়ি। পাশাপাশি অবসান হবে তাদের বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরের দূরবীসহ জীবন। একইভাবে অবসান হবে বর্তমান রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও মাদক চোরাচালা কারবারীদের দৌরাত্ম্য।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১৪ ফিলিস্তিনি
ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপি তার বিপরীত কাজ করে সুন্দর সমাজ গড়বে- কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের নেতা ইয়াকুব চৌধুরী
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ