থামছে না পাহাড় নিধন
১০ জুন ২০২৩, ১১:০৩ পিএম | আপডেট: ১১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
চট্টগ্রামে থামছে না পাহাড় নিধন। সরকারি দলের নেতা আর ভূমিদস্যুরা নির্বিচারে কাটছে পাহাড়-টিলা। পরিবেশ বিধ্বংসী এ অপতৎপরতা রোধে কিছুই করতে পারছে না প্রশাসন। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। পাহাড় দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। খোদ সরকারি সংস্থাই কাটছে পাহাড়। তাতে পাহাড় ধসে বেঘোরে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রাকৃতিক ভারসাম্য সেই সাথে জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। বিগত ২০০৭ সালের আজকের দিনে (১১জুন) মহানগরী ও আশপাশের ১৩টি এলাকায় পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ২৪৮ জন।
তবে পাহাড় সুরক্ষায় কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি প্রশাসন। ২০০৭ সালের গণমৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিনের নির্দেশে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। ওই কমিটি পাহাড় রক্ষায় বেশকিছু সুপারিশ পেশ করে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন তথা পাহাড় নিধন রোধে গঠন করা হয় শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ওই কমিটি এ পর্যন্ত ২৬টি সভা করেছে। তবে বেশিরভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। বন্ধ হয়নি পাহাড়-টিলা নিধন, দখল। থামেনি পাহাড়ে মৃত্যু।
পাহাড়-টিলা ঘেরা চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। একের পর এক পাহাড় নিধন করা হচ্ছে। পরিবেশবাদি সংগঠনগুলোর হিসাবে গত চার দশকে চট্টগ্রামের শতাধিক পাহাড়-টিলা ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে জমি দখল করা হয়েছে। পাহাড় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ বসতি। পাহাড় কাটার ফলে মহানগরীর প্রাকৃতিক খাল, ছরা আর নিচু এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। পাহাড় কেটে নিচু এলাকা ভরাট করে বসতি আর নানা স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। তাতে নগরীতে পানি নিষ্কাশনের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর এই কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে দেশের বাণিজিক রাজধানী। পানিবদ্ধতা এখন এই মহানগরীর প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও পানিবদ্ধতার সঙ্কট থেকে নিস্তার মিলছে না।
পাহাড় সুরক্ষা যাদের দায়িত্ব তারাও পাহাড় কাটছে। বিগত ২০০৭ সালে গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটি স্পষ্ট জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরও পাহাড় কেটেছে। এখনও এসব সংস্থা পাহাড় নিধন করে চলেছে। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিং রোড নির্মাণ করতে গিয়ে ১৬টি পাহাড় কেটেছে সিডিএ। সিডিএ একই এলাকায় আরো পাহাড় কাটার প্রস্তুতি নিছে। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে আগে কাটা পাহাড় খাড়াখাড়ি করে কাটায় ধসের ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। ধসের আশঙ্কায় গত বছর বর্ষায় সড়কের একাংশ দীর্ঘদিন বন্ধ রাখতে হয়। এখন ধস ঠেকাতে এসব পাহাড় আরো কেটে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে।
নগরীর আকবর শাহ এলাকায় আবাসিক প্রকল্পের জন্য পাহাড় কাটছে সিটি কর্পোরেশন। একজন কাউন্সিলরও সেখানে পাহাড় নিধন চালিয়ে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে অভিযান পরিচালনা করে। জরিমানা করা হয়, তবে পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। গত এপ্রিলে সেখানে পাহাড় ধসে এক শ্রমিক নিহত এবং আরো তিনজন আহত হন। কয়েকটি আবাসিক এলাকার জন্য সেখানে পাহাড় নিধন করা হচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটার ফলে থামছে না পাহাড় ধসে প্রাণহানি। সবশেষ ৭ এপ্রিল আকবরশাহ থানাধীন বেলতলীঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান মো. মজিবুর রহমান খোকা (৪৫) নামে এক শ্রমিক। ওই এলাকায় সড়ক নির্মাণে ব্যাপকহারে পাহাড় কাটার সময় এ ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও তিনজন আহত হন।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওইদিন ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ভারি বর্ষণে বৃষ্টিতে লেডিস ক্লাব, শহরের কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝরনা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মা মেয়ে। ২০২২ সালে ১৭ জুন পাহাড়ধসে নিহত হয় আরও চার জন। ওইদিন রাত ২টায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যমতে, নগরীর ২৫টি পাহাড়ে এক হাজারের বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, মহানগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এর মধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে। ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাত পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। প্রতিবছর বর্ষায় ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস দেয়ার পর এসব বসতিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয় নিরাপদে। কিন্তু ভারি বর্ষণ থেমে গেলে সবকিছু চলে আগের মত।
পাহাড়ে অবৈধ বসতিতে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ। সরকারি দলের নেতা, স্থানীয় কাউন্সিলর এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট পাহাড়ে অবৈধ বসতির সাথে জড়িত। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে তারা মোটা অংকের ভাড়া আদায় করে চলেছে। লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করা হলেও এসব বসতি থেকে যায় অক্ষত। দখলমুক্ত হয়না পাহাড়-টিলা। এদিকে ২০০৭ সালে পাহাড় ধসে গণমৃত্যুর পর থেকে ওইদিনটিকে জাতীয় পাহাড় রক্ষা দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পিপলস ভয়েস’। আজও একই দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে সংগঠনটি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
রাইখালীতে পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা
বাঘায় রত্নগর্ভা হাসনা-হুদা দম্পতির ১২ সন্তান উচ্চ শিক্ষায় সফল
শহীদ জিয়ার মিঠাছড়া খাল খননে হাজারো কৃষকের ভাগ্য খুলেছিল ' - মীর হেলাল
ঝিনাইগাতীতে আইন শৃঙ্খলা কমিটিসহ ৪ কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
গফরগাঁওয়ে ভিজিডির ৫১ বস্তা চুরি
গোলাপগঞ্জে মাদক সেবনের অপরাধে দুই জনকে জরিমানা ও কারাদণ্ড
ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ন থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নেয়নি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
ঢাকাকে উড়িয়ে আসর শুরু রংপুরের
নিজ জমিতে যাওয়া হলো না সিলেটে এক ব্যবসায়ীর : হামলা করলো যূবদলনামধারী ভূমিখেকো চক্র
প্রতারণার দায়ে অনন্ত জলিলের বিরুদ্ধে সমন জারি
রেকর্ড পুনরুদ্ধার করে শাহিদির ২৪৬, রেকর্ড গড়ল আফগানিস্তানও
‘ইসলাম প্রচার প্রসারে সউদী সরকার ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে’
টেলিটকের দুটি স্পেশাল ডাটা প্যাকেজের উদ্বোধন করলেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরি করবে সরকার: প্রেস সচিব
এসিআই লিমিটেড ২০ শতাংশ নগদ এবং ১৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে
এবার ছাত্রদল সভাপতির পাশে দাঁড়ালেন হাসনাত আব্দুল্লাহ
কোয়ালিফাইয়ারের বাধা টপকাতে চায় রংপুর
খুশদিলের শেষের ঝড়ে রংপুরের বড় সংগ্রহ
চোখের চিকিৎসায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও ইস্পাহানী চক্ষু হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগ
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য প্রকাশ করা হবে: প্রধান উপদেষ্টা