ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১১ আশ্বিন ১৪৩১
চট্টগ্রামে আলোচিত সূত্রবিহীন সালাহউদ্দিন হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই

খুন করতেও অন্তর কাঁপেনি অন্তর মিয়ার!

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

১৩ জুন ২০২৩, ১১:২৩ পিএম | আপডেট: ১৩ জুন ২০২৩, ১১:২৩ পিএম

অন্তর মিয়া। বয়স ২৫। এই বয়সেই জড়িয়ে পড়েছেন অপরাধে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতাসহ অনেক অপরাধ করেছেন। সর্বশেষ পাঁচ হাজার টাকার জন্য খুন করেন সহকর্মী রুমমেটকে। একই বিছানায় ঘুমাতেন তারা। ঘুমের মধ্যেই রুমমেট সালাউদ্দিনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন অন্তর। আলোচিত এ হত্যাকা-ের সাড়ে তিন মাস পর পিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়েন আত্মস্বীকৃতি এ খুনি। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে আলোচিত খুনের বর্ণনা দেন অন্তর। পিবিআই কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য সহকর্মীকে খুনের পরও তার মধ্যে নেই কোন অনুশোচনা। কারণ খুনের মত অপরাধেও তার অন্তর কাঁপে না। তিনি একজন ঠা-া মাথার খুনি।
ছোটবেলা থেকেই নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া অন্তর একজন পেশাদার অপরাধী। সোমবার সন্ধ্যায় মহানগর হাকিম কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্তরের স্বীকারোক্তির মধ্যদিয়ে সূত্রবিহীন ওই হত্যাকা-ের পূর্ণাঙ্গ রহস্য উদঘাটন হয়েছে বলে দাবি করেন তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানিয়েছেন, খুনের শিকার সালাহউদ্দিন তাদের মজুরি আত্মসাৎ করেছিলেন। এর প্রতিশোধ নিতে অন্তরসহ দুই সহকর্মী পরিকল্পিকভাবে তাকে নৃশংসভাবে খুন করেন।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর টাইগারপাস আমবাগানে তালাবদ্ধ ছেনোয়ারা বেগমের ভাড়া ঘর থেকে মুখ ও হাত-পা বাঁধা সালাহউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে সেসময় পুলিশ নিহতের কোনো পরিচয় পায়নি। ছেনোয়ারা বেগম শুধুমাত্র তার নাম ‘সালাহউদ্দিন’ এবং পেশায় টাইলস শ্রমিক বলে জানিয়েছিলেন। এ ঘটনায় খুলশী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছিলেন। তদন্তে নেমে পিবিআই লাশের আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত করে। এরপর ৩ মার্চ ঢাকার ধানম-ি থেকে হত্যাকা-ে জড়িত আবদুর রহমান (৩২) নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যে ঘটনায় জড়িত স্বপন নামে একজনের বিষয় জানতে পেরেছিল পিবিআই।
সেই ‘স্বপনই’ অন্তর মিয়া বলে নিশ্চিত হয় পিবিআই। পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান জানান, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। এরপর শনিবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে অন্তর মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতের নির্দেশে তাকে দুইদিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে সবকিছু অকপটে স্বীকার করে। এর আগে গ্রেফতার আবদুর রহমান হত্যাকা-ের বিষয়ে পিবিআইকে যে তথ্য দিয়েছিল, অন্তর মিয়াও প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, তারা তিনজন একইসঙ্গে একই কাজ করতেন। সালাহউদ্দিন তাদের কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মজুরির বিষয়ে অসত্য কথা বলে তাদের টাকা আত্মসাৎ করতেন সালাহউদ্দিন। এজন্য তারা সালাহউদ্দিনকে খুন করেছে বলে জানিয়েছেন।
দীর্ঘ জবানবন্দিতে অন্তর মিয়া জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে প্রথমে রিকশা ও পরে অটোরিকশা চালাতেন। এরমধ্যে অটোরিকশা চুরির চক্রে জড়িয়ে পড়েন। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে সিএনজি অটোরিকশা চুরির একটি মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ২০ দিন পর জামিনে মুক্তি পেয়ে সিলেটে চলে যান। সেখানে কিছুদিন হযরত শাহজালালের মাজারে দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। পরে একটি ফুচকার দোকানে কাজ নেন। ওই দোকানে কাজ করতে গিয়ে সালাহউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সালাহউদ্দিন তার নাম জানতো- স্বপন। কারণ জেল থেকে বেরিয়ে অন্তর নিজেকে স্বপন নামেই সবার কাছে পরিচয় দিত। বেতন কম হওয়ায় সালাহউদ্দিন ও অন্তর মিলে ফুচকার দোকান থেকে একটি ড্রিল মেশিন চুরি করে চট্টগ্রামে চলে আসে। এরপর তারা রবি অপারেটরের অধীনে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেয়। আরেক শ্রমিকের সঙ্গে মারামারি হওয়ায় সালাহউদ্দিন সেখানেই কাজ ছেড়ে দেন। তার সঙ্গে অন্তরও কাজ ছেড়ে দেন। তারা মাসিক ২২০০ টাকা ভাড়ায় টাইগারপাসে ছেনোয়ারা বেগমের টিনশেড ঘরে থাকতেন।
পরবর্তীতে সালাহউদ্দিন পলোগ্রাউন্ডে চিটাগাং চেম্বারের বাণিজ্যমেলায় স্টল তৈরি, আসবাবপত্র আনা-নেওয়াসহ দিনমজুর হিসেবে ঠিকাদারের অধীনে কাজ নেন। অন্তর এবং আবদুর রহমানও সালাহউদ্দিনের সঙ্গে একই কাজে যোগ দেন। তারা প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করতেন। সালাহউদ্দিন তাদের কাজ পাইয়ে দেন। তাদের দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি দিতেন। কিন্তু একদিন তারা ঠিকাদারের কাছ থেকে জানতে পারেন সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত দুই শিফট ধরা হয় এবং প্রতি শিফট ৭০০ টাকা হিসেবে তাদের মজুরি আসে ১৪০০ টাকা। তারা বুঝতে পারেন তাদের এক শিফটের টাকা সালাহউদ্দিন আত্মসাৎ করে আসছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা সালাহউদ্দিনকে মজুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। এ নিয়ে সালিশ বসে তাতে সালাহউদ্দিন অন্তরকে পাঁচ হাজার ও আবদুর রহমানকে চার হাজার টাকা করে ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু সালাহউদ্দিন পরে টাকা না দিয়ে উল্টো তাদের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে অন্তর ও আবদুর রহমান তাকে খুনের পরিকল্পনা করেন।
পিবিআই জানায়, খুনের এক সপ্তাহ আগে অন্তর ও আবদুর রহমান মিলে সালাহউদ্দিনকে ‘উচিৎ শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারা একটি ধারালো ছোরা কিনেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সালাহউদ্দিন বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন। তার পাশে বসে আবদুর রহমান ও অন্তর কিছুক্ষণ লুডু খেলে শুয়ে পড়েন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত ১টায় তারা জেগে যান। এরপর অন্তর ঘুমন্ত সালাহউদ্দিনের গলায় ছুরি চালিয়ে দেন। তখন আবদুর রহমান সালাহউদ্দিনের দুই হাত চেপে ধরেন। আবদুর রহমান তার হাত থেকে ছুরি নিয়ে আবার গলায় আঘাত করেন। সালাহউদ্দিন তখন সর্বশক্তি দিয়ে ছুরি কেড়ে নিতে চাইলে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয় এবং আবদুর রহমানের হাতের কবজির ওপরে জখম হয়। তবে গলা কেটে যাওয়া সালাহউদ্দিন দ্রুত নিস্তেজ হয়ে পড়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়। তখন আবদুর রহমান রুমে থাকা গামছা দিয়ে সালাহউদ্দিনের দুই হাত এবং স্বপন দুই পা ওড়না দিয়ে বেঁধে কম্বল দিয়ে লাশের মুখ ঢেকে দেন। রাতে তারা লাশের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েন।
সকালে দরজায় তালা দিয়ে পালিয়ে যান। সালাহউদ্দিনের মানিব্যাগ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে নিজেরা ভাগ করে নেন। বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে অলঙ্কার মোড়ে যান। সেখান থেকে বাসে ফেনী। ফেনী থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হয়ে সিলেট চলে যান। সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল, সেখান থেকে আবার নরসিংদী গিয়ে রাত পার করেন। পরদিন নরসিংদী থেকে মাধবদী যান। সেখানে পৌঁছে আবদুর রহমান তার মামার কাছ থেকে টাকা আনার কথা বলে অন্তরের কাছ থেকে চলে যান। আবদুর রহমান আর না ফেরায় অন্তর সিলেটে চলে যান। সেখানে ছয় হাজার টাকা বেতনে একটি গরুর ফার্মে কাজ নেন। ১৫ দিন কাজ করার পর আবার মৌলভীবাজারে চলে যান। সেখান থেকে তাকে পাকড়াও করা হয়। অন্তরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফুলবাড়ীতে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ৪

ফুলবাড়ীতে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ৪

কৃষিকেই প্রধান অবলম্বন করতে হবে

কৃষিকেই প্রধান অবলম্বন করতে হবে

দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে

দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে

বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন ড. ইউনূস

বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন ড. ইউনূস

জবিতে ট্রেজারার পদে আলোচনায় বিবিএর তিন শিক্ষক

জবিতে ট্রেজারার পদে আলোচনায় বিবিএর তিন শিক্ষক

এভাবে চলতে দিতে পারি না আমরা : জাতিসংঘ

এভাবে চলতে দিতে পারি না আমরা : জাতিসংঘ

নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন মুফতি রুহুল আমীন উলামা পরিষদ গোপালগঞ্জ

নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন মুফতি রুহুল আমীন উলামা পরিষদ গোপালগঞ্জ

পশ্চিমা নৈতিকতার মৃত্যু ঘটেছে গাজায় : এরদোগান

পশ্চিমা নৈতিকতার মৃত্যু ঘটেছে গাজায় : এরদোগান

ঝাড়খন্ডে বিজেপি জিতলে এনআরসি

ঝাড়খন্ডে বিজেপি জিতলে এনআরসি

তথ্য সংশোধন ও সংযোজনের জন্য বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদদের খসড়া তালিকা প্রকাশ

তথ্য সংশোধন ও সংযোজনের জন্য বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদদের খসড়া তালিকা প্রকাশ

ইসরাইল-হিজবুল্লাহ সংঘর্ষ কেবল যুক্তরাষ্ট্র থামাতে পারবে : লেবানন

ইসরাইল-হিজবুল্লাহ সংঘর্ষ কেবল যুক্তরাষ্ট্র থামাতে পারবে : লেবানন

গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বনেতাদের হুঁশিয়ারি

গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বনেতাদের হুঁশিয়ারি

অভ্যুত্থানবিরোধীদের মৃত্যুদ- কার্যকর করছে মিয়ানমার জান্তা, উদ্বেগ

অভ্যুত্থানবিরোধীদের মৃত্যুদ- কার্যকর করছে মিয়ানমার জান্তা, উদ্বেগ

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন

১৫তম বিসিএস ফোরামের আহবায়ক কমিটি গঠন

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ভুঁইয়া পরিবারের

ইসলামে মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ইসলামে মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ওলিদের আল্লাহপ্রেম

ওলিদের আল্লাহপ্রেম

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষে জেলা জামায়াতের সাথে পূজা কমিটির মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

বিদ্রোহী সীমালংঘনকারীদের জন্য কেউ কাঁদে না

বিদ্রোহী সীমালংঘনকারীদের জন্য কেউ কাঁদে না

প্রশ্ন: চিরদিন কাহারও কি সমান যায়?

প্রশ্ন: চিরদিন কাহারও কি সমান যায়?