ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

শেরপুরে কফি ও কাজু বাদাম চাষের অপার সম্ভাবনা

Daily Inqilab এস. কে. সাত্তার, ঝিনাইগাতী (শেরপুর) থেকে

২৫ জুন ২০২৩, ১১:০৩ পিএম | আপডেট: ২৬ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম

সীমান্তবর্তী শেরপুরের ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়িসহ গারো পাহাড়ি অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফি চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কফি পানীয় হিসেবে বিশ্বজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও কফি জনপ্রিয় পানীয়। শহর, বন্দর ও গ্রামাঞ্চল সর্বত্রই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশে যে কফি পাওয়া যায় তার বেশীর ভাগ আমদানিকৃত। আশার কথা, পার্বত্যাঞ্চলে চাষ হচ্ছে কফি। যা শেরপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যক্তি, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই বান্দরবানের চাষিরা সফলতা পেয়েছেন।

গারো পাহাড়ের মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশ কফিও কাজুবাদম চাষের জন্য উপযোগী। গারো পাহাড়ে ছিল নানা প্রজাতির পাহাড়ি ফলদ গাছ। সুতরাং এখানে কফি ও কাজু বাদাম চাষযোগ্যই হবে। কেননা বান্দরবান ও গারো পাহাড়ের মাটি, আবহাওয়া একই ধরনের। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে কফি চাষ হচ্ছে, কৃষকরা সফলতাও পাচ্ছেন। একই ধরণের মাটি ও আবহাওয়া গারো পাহাড়েও কফি এবং কাজুবাদাম চাষ সম্ভব বলে শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী, আলহাজ্ব শরীফ উদ্দিন সরকার, আলহাজ্ব গোলাম মোস্তফাসহ প্রবীণ লোকজনদের সাথে আলাপকালে তারা ইনকিলাবকে বলেন, চিম্বুক পাহাড়ে কফির চাষ হলে গারো পাহাড়ে হবে না কেন? মাটি ও আবহাওয়াতো একই। সুতরাং পাহাড়ে কফি-কাজুবাদাম চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ের কফি চাষ সরেজমিন ঘুরে এসে একটি বেসরকারি কোম্পানী বাজাজের রংপুর বিভাগীয় কর্মকর্তা শেরপুর শহরের বাসিন্দা আরিফুর রহমান সুজন ইনকিলাবকে বলেন, সেখানকার কফি চাষিদের সাথে আলাপ করে জেনেছি, চারা রোপনের ২ বছর থেকে ফলন দেয়। ৩য় বছর দেয়া শুরু হয় ফল। গাছ ৭০/৮০ বছর বাঁচে। জানুয়ারীতে ফুল আসে, সপ্তাহান্তেই ফলে পরিণত হয়। নভেম্বরে ফল পাকে। ফল সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। তিনি বলেন, আম-জাম, জাম্বুরাসহ ফলদ বাগানে সাথী ফল হিসেবে কফি চাষ হচ্ছে। চারা বর্ষায় রোপণ করতে হয়। ছায়া ও মাটির আদ্রতা লাগে। বেশি ছায়া হলে ফলন কম হয়, তাই রোদ প্রয়োজন। সেখানে রোবস্ট ও অ্যারিয়েন নামে ২ ধরণের কফি চাষ হচ্ছে। কফির খোসাসহ প্রতি কেজি দুই-আড়াই শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রত্যেক গাছ থেকে বছরে ৫ থেকে ১৫ কেজি ফল পাওয়া যায়। ফলন শুরু থেকে টানা ৪০-৫০ বছর কফি পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, চাকুরি শেষে তিনি বাড়ী এসে গারো পাহাড়ে কফির চাষ করবেন। সে জন্যই তিনি সব বিষয়ে জেনেছেন। তিনি জানান, দেশে চাহিদার তুলনায় কফি উৎপাদন হয় কম। ফলে ইথিওপিয়া, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অথচ পাহাড়ে চাষের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। এদিকে শেরপুর উত্তরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু হয়েছে কাজুবাদামের। ইতোমধ্যে বাগানগুলোয় কাজুবাদাম পরিপক্বও হতে শুরু করেছে। চাষিদের মুখে হাসিও ফুটতে শুরু করেছে। ভারত সীমান্তঘেঁষা প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের এ সীমান্তে হাতির আক্রমণ এবং পানির অভাবে অনেক জমি পতিত থাকে।

শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, পাহাড়ি অঞ্চলে ৩ বছর আগে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পর আওতায়’ তিন উপজেলায় সাড়ে ১৮ একর জমিতে ৩৬টি প্রদর্শনী প্লটে কম্বোডিয়ান এম-২৩ জাতের কাজুবাদামের চারা বিতরণে কাজুবাদাম চাষ শুরু করেছে। তিন বছরেই প্রদর্শনী বাগানে ফুল ও ফল এসে বাদাম পাকতে শুরু করেছে। থোকায় থোকায় ঝুলছে কাজুবাদাম। এসব গাছ থেকে ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যাবে। প্রতি কেজি বাদাম বিক্রি হচ্ছে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়। প্রসেসিং ছাড়াও ৪-৫শ’ টাকা কেজিতে বিক্রি করা যায়। পাকার পর ওপরের অংশ আপেলের মতো খাওয়া যায়। নিচের অংশ নির্ধারিত যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় বাদাম বের হয়। শেরপুরের পাহাড়ি মাটি উৎকৃষ্ট। অল্প সময়েই গাছেগুলোতে বাদাম আসতে শুরু করেছে এবং আগামীতে ফলন বাড়বে আশা বাগানমালিকদের। এদিকে কাজু বাদাম চাষ হচ্ছে খবরে অনেক উদ্যোক্তা ও বেকার যুবক বাগান দেখতে আসছেন এবং তারাও কাজুবাদাম চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। অনেকেই বন্যহাতির আক্রমণের শঙ্কাও করছেন। তাদের মতে কাটা তারের বেড়া দিয়ে হাতির আক্রমণ ঠেকানো গেলে, কাজুবাদাম চাষে তারা লাভবান হতে পারবেন বলে কৃষি বিভাগ ও জানিয়েছেন।
ঝিনাইগাতি উপজেলার গজনীর বাগান মালিক সোয়েব হাসান সাকিল ইনকিলাবকে বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি বিভাগের এ পাইলট প্রকল্পে চাষ হচ্ছে কাজুবাদাম। আমার বাগানে গত বছর থেকে ফুল আসতে শুরু করে। এবার ফুল ও ফল পাকতে শুরু করছে। ৫০ শতক জমিতে ২শ’ গাছ রয়েছে। তিন বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছি, আগামী বছর থেকে ফলন বাড়বে এবং প্রতি গাছে ১৫-২০ কেজি করে বাদাম পাওয়া যাবে। ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে এই বাদাম বিক্রি করা যাবে।

শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের খামার বাড়ি উপপরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ ) হুমায়ুন কবির ইনকিলাবকে বলেন, উচ্চ মূল্যের কাজুবাদাম দেশে একটি নতুন অর্থকরী ফসল। কৃষি বিভাগ কাজুবাদামের উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ ফসলের অনেক ঘাটতি রয়েছে। প্রতি বছর আগাম আমদানি করতে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করতে এ ফসল শেরপুরের পাহাড়সহ পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে কৃষি বিভাগ কাজ করছে। হাতির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কৃষকদের মাঝে কাজুবাদাম চাষে ব্যাপক সাড়া জাগাবে।

ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার ইনকিলাবকে বলেন, কৃষি বিভাগ কফি ও কাজুবাদাম প্রদর্শনী প্লট করে ইতোমধ্যেই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ে কফির চাষ হলে গারো পাহাড়ে হবে না কেন? মাটি ও আবহাওয়াতো একই। সুতরাং পাহাড়ে কফি ও কাজুবাদাম চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু, মাটির ধরণ অনুযায়ী পাহাড়ি অঞ্চল কফি ও কাজুবাদাম চাষে উপযোগী। পাহাড়ে ব্যাপকভাবে কফি ও কাজুবাদাম চাষ করে প্রয়োজনে এখানে কফি ফ্যাক্টরী করা সম্ভব। এ জন্য শুধু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, সাহায্য-সহযোগীতা ও পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন।

ঝিনাইগাতী নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফারুক আল মাসুদ বলেন, সারা দেশের যেসব অঞ্চলে কাজুবাদাম এবং কফির চাষের সম্ভাবনা রয়েছে, তা চাষের আওতায় আনতে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। গারো পাহাড়কে এ প্রকল্পের আওতায় এনে কাজুবাদাম ও কফির চাষ করা যেতে পারে এবং ব্যাপক চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত কফি ও কাজুবাদাম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ছাড়াও অনেক বেকার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির অপার সম্ভাবনা রয়েছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ফের মৃত্যুর খেলা! ‘স্কুইড গেম সিজন ২’র টিজারে বিপদের বার্তা

ফের মৃত্যুর খেলা! ‘স্কুইড গেম সিজন ২’র টিজারে বিপদের বার্তা

অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি কচুয়ায় যুবলীগ নেতার ৪টি দোকান পুড়েছে দুর্বৃত্তরা

অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি কচুয়ায় যুবলীগ নেতার ৪টি দোকান পুড়েছে দুর্বৃত্তরা

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপির দু’পক্ষে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বিএনপির দু’পক্ষে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

লেবানের বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

লেবানের বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

রাঙামাটিতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের টহল, পরিস্থিতি শান্ত

রাঙামাটিতে সেনা, বিজিবি ও পুলিশের টহল, পরিস্থিতি শান্ত

পরমাণু দূষিত পানি নিয়ে চীন ও জাপানের কিছু ঐকমত্য

পরমাণু দূষিত পানি নিয়ে চীন ও জাপানের কিছু ঐকমত্য

ঝিকরগাছায় বিএনপি নেতা খায়রুজ্জামান মিনুসহ ২১ নেতাকর্মী বহিষ্কার

ঝিকরগাছায় বিএনপি নেতা খায়রুজ্জামান মিনুসহ ২১ নেতাকর্মী বহিষ্কার

হিজবুল্লাহর ভয়ে ইসরাইলিদের আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে থাকার নির্দেশ

হিজবুল্লাহর ভয়ে ইসরাইলিদের আশ্রয়কেন্দ্রের কাছে থাকার নির্দেশ

ভারতের ঘুম হারাম করে পাকিস্তানকে ভয়ঙ্কর হেলিকপ্টার দিচ্ছে চীন

ভারতের ঘুম হারাম করে পাকিস্তানকে ভয়ঙ্কর হেলিকপ্টার দিচ্ছে চীন

পাকিস্তানে সেনানিবাসে আত্মঘাতি হামলা, সেনাসহ নিহত ১৮

পাকিস্তানে সেনানিবাসে আত্মঘাতি হামলা, সেনাসহ নিহত ১৮

জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১৪২৩, আহত ২২ হাজার

জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১৪২৩, আহত ২২ হাজার

নড়াইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল গ্রেফতার

নড়াইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুয়েল গ্রেফতার

বিচারবিভাগ নিয়ে আজ রোডম্যাপ দেবেন প্রধান বিচারপতি

বিচারবিভাগ নিয়ে আজ রোডম্যাপ দেবেন প্রধান বিচারপতি

নেছারাবাদে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার নিহতদের স্মরণে বিএনপির আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল

নেছারাবাদে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনা ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার নিহতদের স্মরণে বিএনপির আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় চীন: শি জিনপিং

নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় চীন: শি জিনপিং

পতিত স্বৈরাচারের দোষর মিডিয়া আর স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে

পতিত স্বৈরাচারের দোষর মিডিয়া আর স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে

পাকিস্তান-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্টও মুলতানে

পাকিস্তান-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় টেস্টও মুলতানে

৭০টির বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইআইই-তে অংশ নেবে

৭০টির বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইআইই-তে অংশ নেবে

সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা

সুস্থতার জন্য দোয়া কামনা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে আজ প্রতিনিধিদল যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে আজ প্রতিনিধিদল যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে