ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ : দ্য ডিপ্লোম্যাট

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক :

০২ জুলাই ২০২৩, ১১:৫১ পিএম | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’। ম্যাগাজিনটিতে গত শনিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দল ও মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে দমনপীড়নের নজিরবিহীন ট্র্যাক রেকর্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে নানা তৎপরতা চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জনগণের জন্য একটি আধুনিক, প্রগতিশীল ও মুক্ত গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিন্তু তা না করে ক্ষমতাসীন সরকার গত ১৪ বছরে ব্যাপক দুর্নীতি ও ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর তার দখলকে সুসংহত করার পথ বেছে নিয়েছে। আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে বিজয়ী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে নির্বাচনকে ঘিরে সরকার একটি দীর্ঘ প্রতিশ্রুত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দর কষাকষিতে প্রচ- চাপের মধ্যে রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি, ওলিগার্কদের পক্ষে (ওলিগার্ক : ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বা ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে বেড়ে উঠা অতি ধনী শ্রেণি) ঝুঁকে পড়া নীতি ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার ফলে এমনটি আশা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের জিডিপি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। সেই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি বর্তমান আকারের দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের হিসাবে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে ৭২ দশমিক ৪ বছর, উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে শিশুমৃত্যুর হার। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ও মহিলাদের অসাধারণ অগ্রগতি হয়েছে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এখন বেশি মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে ভর্তি হচ্ছে এবং সমস্ত শিশুর ৯৮ শতাংশ অন্তত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর মেগা অবকাঠামো উন্নয়নগুলো বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের পোস্টার উপাদান।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান বৈষম্যে এই ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, গত ছয় বছরে দেশে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। ২০২২ সালের বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে সম্পদের এই একত্রীকরণ একটি ওলিগার্ক শ্রেণী তৈরি করে যা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে হয়ে থাকে।

২০২০ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে এবং সরকারের মানহানি করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মামলা করে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো তখন অভিযোগ করেছিলো যে, রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ঢাকার বাইরের এক ব্যবসায়ীর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকার কারণে কিশোরকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়। পরে ১০ মাস কারাভোগের পর তিনি জামিন পান। কিশোরের সাথে জেলে একই সেলে ছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় অভিযুক্ত মুশতাক আহমেদ যিনি ২০২১ সালে কারা হেফাজতে মারা যান।

প্রতিবেদনে উল্লেখ হয়, ওলিগার্কদের ক্ষমতার খেলার আরেকটি ঘটনা সামনে আসে যখন অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিআরপি) মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া নামের এক ব্যক্তির উপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যিনি নিউইয়র্কে চার মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের রিয়েল এস্টেটের মালিক বলে প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়।
আবদুস সোবহান মিয়া বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। ওসিসিআরপি জানায়, শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী থাকা অবস্থায় আবদুস সোবহান মিয়া এই সম্পদ করেন। এই ধরনের ঘটনা সরকারের প্রকৃত উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ক্ষুণœ করে, অর্থনৈতিক সাফল্যকে ছাপিয়ে দেয় এবং তাতে বাংলাদেশে ব্যাপক ও বৃহত্তর দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক (সিপিআই) অনুসারে, তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের পরে বাংলাদেশ বিশ্বের ১২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। গড়পড়তা বাংলাদেশিদের অর্থনৈতিক দুর্দশা যেমন বাড়ছে তেমনি দুর্নীতি ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে জনগণের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে।

বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন: দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও দুর্নীতি একপাশে রাখলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নি¤œগতি আসন্ন নির্বাচনের আগে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। শেখ হাসিনার অধীনে গত ১৪ বছরে সরকার বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে দমনের একটি কুখ্যাত অভ্যাস গড়ে তুলেছে যার কিছুটা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারণে সংগঠিত হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনগুলো নির্বাচনী জালিয়াতি, ভীতি প্রদর্শন এবং গণগ্রেফতারের গুরুতর অভিযোগে বিতর্কিত ছিল যদিও সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে এবং নির্বাচনে একতরফা ফলাফলের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবকে দায়ী করেছে। বিরোধীরা অবশ্য, সরকার ভয় দেখানোর কৌশল অবলম্বন করছে বলে অভিযোগ করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সিনিয়র নেতারা দাবি করেছিলেন যে ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্য বিএনপি সদস্যদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২০ হাজার দায়ের করা হয়েছে। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় পুলিশ, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও প্রায় ৫০ জন আহত হন। আর ১০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ স্থানীয় পুলিশের সমর্থনে বিরোধী দলের সমর্থকদের ওপর সহিংসভাবে আক্রমণ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে একটি দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দেয় সরকার। বর্ধিত সাজা নিয়ে ২০২০ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তবে বেগম খালেদা জিয়া ও অনেক বিরোধী দলীয় নেতা যে ন্যায়বিচার পাননি সে বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অবশ্য অভিযোগ করেছে। এছাড়া বিরোধীদের লক্ষ্য করে বাংলাদেশে দমনপীড়ন, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের একটি ঢেউ দেখা যায়, যার বেশির ভাগই বিতর্কিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‌্যাব দ্বারা পরিচালিত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ডগসের মতে, বাংলাদেশের বিশেষ আধাসামরিক বাহিনী ২০০৯ সাল হতে কমপক্ষে ৬শ’টি জোরপূর্বক গুম এবং ২০১৮ সাল থেকে অনেকগুলো বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা এবং সমালোচকদের উদ্বেগের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও তার সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাংলাদেশ সরকার এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা এবং র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিন্দা করে ‹আমেরিকানদের শেখানো উপায়ে› সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব লড়াই করে যাচ্ছে বলে জানায়।

পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে কাজ করছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ডগস এবং এক্টিভিস্টদের মতে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসার আগে ২০১৮ সালে জোরপূর্বক গুমের ৩৪টি ঘটনা ঘটেছে। নিষেধাজ্ঞা আসার পর ২০২২ সালে জোরপূর্বক গুমের সংখ্যা কমে ৪টিতে নেমে আসে। সরকারের বারবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও র‌্যাবের কুখ্যাত কর্মকা- বেশ সুপরিচিত ছিল। জনসাধারণের কাছে এটি আরো পরিষ্কার হয় যখন ২০২৩ সালের এপ্রিলের জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে (ডিডব্লিউ) র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং হেফাজতে নির্যাতনের ওপর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাতে দুই হুইসেলব্লোয়ার এবং একজন বেঁচে থাকা ভিকটিমের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।

মুক্ত বাক-স্বাধীনতার যুদ্ধ: প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সম্ভবত ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে কুখ্যাত যুদ্ধ দেশের মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস এর ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৭৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম। এটি বাংলাদেশের জন্য সর্বকালের সর্বনি¤œ স্কোর হিসাবে চিহ্নিত এবং এটি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনি¤œ স্কোরকারী দেশে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের বড় দুটি সংবাদপত্র প্রধানমন্ত্রীর অপছন্দের তালিকায় রয়েছে। তিনি প্রায়শই প্রকাশ্যে সংবাদপত্র ও তাদের সম্পাদকদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতির জন্য তাদেরকে ‹জাতির বিশ্বাসঘাতক› হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রধান বিরোধী দলের সংবাদপত্র দৈনিক দিনকাল সরকারি নির্দেশে এই বছরের শুরুতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল যাতে মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ পায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে কার্যকরভাবে ভিন্নমতাবলম্বীদের পক্ষে বাকস্বাধীনতার চর্চা অসম্ভব করে তুলেছে। কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণের ফলে সম্পাদক এবং তাদের মিডিয়া হাউজগুলো প্রতিশোধের ভয়ে স্ব-নিয়ন্ত্রণ (সেল্ফ সেন্সর) করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। যারা এটা করতে ব্যর্থ হয় তারা ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে পারে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে প্রথম আলো প্রকাশিত একটি গল্প থেকে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল। পর্যবেক্ষক ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ডগসের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে অন্তত ৪ হাজার ৫শ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তার আগের তথ্য প্রযুক্তি আইন -২০০৬ এর অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি সংস্থাগুলির দ্বারা সাংবাদিকদের হয়রানি : একটি সাধারণ ঘটনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম একটি প্রতিবেদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হন। পরে তাকে মন্ত্রণালয় থেকে চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১৫ জুন সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার উত্তরে ময়মনসিংহে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দ্বারা অতর্কিত হামলা এবং নিহত হন। এই রাজনীতিবিদ এর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নাদিমের বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা গেছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস রিপোর্ট করেছে যে ক্ষমতাসীন দল প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ১৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই অমীমাংসিত রয়ে গেছে। নাদিমের হত্যাকা-ের পর সংখ্যাটা ১৯ এ গিয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও সরকারের প্রতিক্রিয়া: প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে, সরকারের কার্যকলাপ, বিশেষ করে বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কঠোর সমালোচনা করেছে। কিন্তু র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান সংকটের জন্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই সিদ্ধান্তের ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেছে। তবে এটি বাংলাদেশে কার্যকর বলে মনে হয়েছিল কারণ এর ফলে র‌্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং জোরপূর্বক গুমের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেন টুইটারে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসানীতি ঘোষণার সময় সবচেয়ে আলোচিত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। নতুন ভিসা নীতির অধীনে ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যারা আসন্ন নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার সঙ্গে জড়িত থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশকে জবাবদিহিতার আহ্বান অব্যাহত রাখার জন্য ছয়জন কংগ্রেসম্যান ব্লিঙ্কেনকে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।

ঠিক একই ধরনের বিষয় উঠে এসেছিলো যখন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পার্লামেন্টের উচ্চ প্রতিনিধির কাছে একটি যৌথ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

প্রতিবেদনে ওঠে আসে যে, মার্কিন ভিসা নীতিতে স্পষ্টভাবে ক্ষুব্ধ ঢাকা বিদেশি কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রদূতদের জন্য বিশেষ প্রটোকল এবং পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছেন। প্রকাশ্যে ওয়াশিংটনকে তার সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাম্প্রতিক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য আমি যে উন্নতি করেছি তা হয়তো যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারছে না। বাংলাদেশের ‹অভ্যন্তরীণ বিষয়ে› ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনার পরেও এই চেষ্টাগুলো তাদের লক্ষ্য পূরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ গত ১৪ বছর ধরে প্রায় পুরোটাই কোণঠাসা থাকার পর পুলিশ বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের কোনও বড় রিপোর্ট ছাড়াই বিএনপি এ বছরের মে মাসে ৯টি শহর এবং ২৭টি জেলায় তাদের প্রথম দেশব্যাপী সমাবেশ করেছে। প্রায় একইভাবে দীর্ঘ ১০ বছর পর ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে গত ১৩ই জুন রাজধানীতে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ তাদের তিন দফা দাবি জানায়। এই সংঘর্ষহীন বিরোধী সমাবেশ বাংলাদেশে একটি বিরল ঘটনা। এতে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে জল্পনার জন্ম দিয়েছে যে মার্কিন ভিসা নীতি এবং নিষেধাজ্ঞাগুলি আওয়ামী লীগ সরকারকে নির্বাচনের আগে তার কৌশলগুলি পুনর্বিবেচনা করতে প্ররোচিত করেছে।

প্রতিবেদনের শেষ অংশে বলা হয়, দমন পীড়নে অতিষ্ঠ একটি বিরোধীদল, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবং ওলিগার্কদের সমন্বয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নারী প্রধানমন্ত্রী টানা চতুর্থ মেয়াদে ফিরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে শক্তিশালী গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু পরিবর্তনের আশা সম্ভবত শুধুমাত্র ইচ্ছাপূর্ণ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শপথ নিলেন অতিশী, মমতার পর দ্বিতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেল ভারত

শপথ নিলেন অতিশী, মমতার পর দ্বিতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেল ভারত

মালয়েশিয়ায় নাইট ক্লাবে স্ফূর্তি করতে গিয়ে আটক ৫ বাংলাদেশি

মালয়েশিয়ায় নাইট ক্লাবে স্ফূর্তি করতে গিয়ে আটক ৫ বাংলাদেশি

নতুন রেকর্ড সোনার দামে, ভরি ১৩৩০৫১ টাকা

নতুন রেকর্ড সোনার দামে, ভরি ১৩৩০৫১ টাকা

সিলেটে একদিনে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু

সিলেটে একদিনে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু

কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহুরুল হক

কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহুরুল হক

শেখ হাসিনা সকল দপ্তরের টাকা লুট করে আমানত খেয়ানত করেছে : নোয়াখালীতে শিবির সভাপতি

শেখ হাসিনা সকল দপ্তরের টাকা লুট করে আমানত খেয়ানত করেছে : নোয়াখালীতে শিবির সভাপতি

ইসলামী ছাত্র মজলিসের নির্বাচন সম্পন্ন--রায়হান সভাপতি ও ইমরান সেক্রেটারি নির্বাচিত

ইসলামী ছাত্র মজলিসের নির্বাচন সম্পন্ন--রায়হান সভাপতি ও ইমরান সেক্রেটারি নির্বাচিত

হাজীগঞ্জে বিএনপি'র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চিকিৎসাধীন কিশোরের মৃত্যু

হাজীগঞ্জে বিএনপি'র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চিকিৎসাধীন কিশোরের মৃত্যু

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই-ধর্ম উপদেষ্টা

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই-ধর্ম উপদেষ্টা

নয়ন মিয়ার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না : যুবদল সভাপতি মুন্না

নয়ন মিয়ার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না : যুবদল সভাপতি মুন্না

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে  ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে