ডলারের বিপরীতে টাকার বড় দরপতন
০৪ জুলাই ২০২৩, ১১:৩৪ পিএম | আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে দেশের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ’র শর্তপূরণে গত সোমবার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে ১০৮ দশমিক ৮৫ টাকা আন্তঃব্যাংক হারে মার্কিন ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে আমদানি ও অন্যান্য প্রয়োজনে ডলার খরচ যত বাড়ছে, তত টান পড়ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার ছিল রিজার্ভে। এরপর কমতে কমতে তা আজ বুধবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের পর ৩০ বিলিয়নের ঘরে নেমে আসছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আইএমএফ’র হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করায় বেশ কয়েকটি তহবিলের অর্থ বাদ দিয়ে হিসাবায়নে গেলে রিজার্ভ কমবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। অর তাহলে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ দাড়াবে ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
এতে একদিনে স্থানীয় মুদ্রার ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৮৫ পয়সা অবমূল্যায়ন হয়। যদিও ধাপে ধাপে টাকার অবমূল্যায়ন করাটাই যথাযথ পদক্ষেপ বলেও মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তা না হলে এটা বাজারে এক ধরণের শক বা চাপ তৈরি করবে, মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে বেড়ে যাবে এবং মানুষ এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এতো দিনে জোর করে ডলারের দাম টাকার বিপরীতে কমিয়ে ধরে রেখেছিল। কারণ ডলারের দাম বাড়লে তা আমদানির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তাদের ধারণা ছিল। সেটি ঠিক নয় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ডলারের দাম ধরে রেখে কাঙ্খিত মাত্রায় রেমিট্যান্স এবং রফতানি আয় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। একই সাথে রয়েছে আইএমএফ’র শর্তও। যার কারণে সেই অবস্থান থেকে তাদেরকে সরে আসতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুদ্রা, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম-এ দেশগুলোর তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত ছিল। এখন হঠাৎ করেই ছেড়ে দেয়ার কারণে টাকার মান দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এটা আরো আগে করা উচিত ছিল। তাহলে এটা ধীরে ধীরে সহ্য হয়ে যেতো।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, টাকার এই মান পড়ে যাওয়াটা কিছু দিন ধরে চলবেই। এটা ততদিন চলবে যতক্ষন পর্যন্ত না ডলারের প্রাপ্তি, ডলারের সরবরাহ এবং অন্যান্য মুদ্রার সাথে ডলারের কেমন সম্পর্ক, এক্সচেঞ্জ রেট কত- এই সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে থামবে। কিন্তু কিছুদিন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। মার্কেট স্থিতিশীল হওয়া পর্যন্ত টাকা অবমূল্যায়িত হবে।
আর্থিকখাত নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম ইনকিলাবকে বলেন, যে হারে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে সেটা বাড়তে দিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। এর পরে যদি মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ে, তাহলে নিম্নবিত্ত অনেক সমস্যায় পরে যাবে।
সূত্র মতে, একাধিক বিনিময় হার-ভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে, বাজার-ভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে গত জানুয়ারিতে আইএমএফ’র অনুমোদিত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণেরও অন্যতম শর্ত ছিল একক বিনিময় হার চালু। আর সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা অনুসারে, বিনিময় দর ঠিক করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা)। ফলে আন্তঃব্যাংক ডলার বাজারের ব্যবস্থাপনা এখনও তাদের হাতেই রয়েছে। গত সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফেদা আমদানিকারকদের জন্য ডলারের দর বাড়িয়ে ১০৯ টাকা নির্ধারণ করে। বাফেদার কর্মকর্তারা জানান, গত ২৬ জুনের সভায় ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা দরে আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলার ক্রয়-বিক্রয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু, অনেক ব্যাংকই আমদানিকারকদের কাছে ১০৯ টাকার বেশি দরে প্রতি ডলার বিক্রি করছিল। এখন আমদানি ব্যয় পরিশোধেও তাই একই দর কার্যকর করা হলো। বাফেদার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলার ব্যাংকগুলো ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনতে পারবে। রফতানি আয়ের প্রতি ডলার কিনতে পারবে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায়।
গত সোমবার রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক পেমেন্টের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ৭২ মিলিয়ন ডলার নতুন আন্তঃব্যাংক দরে বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিক্রি করা ডলারের দর আগের ১০৬ টাকা থেকে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যাংকগুলোর কাছে নতুন আন্তঃব্যাংক হারে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৯৩ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে ১৬ শতাংশ বা ১৫ দশমিক ৪ টাকা অবমূল্যায়ন হয়েছে স্থানীয় মুদ্রা টাকার।
চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার-ভিত্তিক একটি একক বিনিময় হার চালুর ঘোষণা দেয়। এই ব্যবস্থায় ডলার বা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় মান নির্ধারিত হবে বাজার-চাহিদার ভিত্তিতে। মুদ্রানীতি বিবৃতিতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। যার আওতায়, বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় বা বিক্রয়ের নির্দিষ্ট কোনো দর ঘোষণা করবে না। এর আগে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের শর্ত হিসেবে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি একক বিনিময় হার চালুর পরামর্শ দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় দর কমল ১ দশমিক ৫ টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, আন্তঃব্যাংক হারে ডলার বিক্রির মাধ্যমে আইএমএফ’র শর্তপূরণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফের একক হারের ধারণার সাথে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায়, তাদের শর্তপূরণ হয়েছে। তবে এখনও বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা বাকি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে কার্যকর কোনো বাজার নয়। বর্তমানে এই বাজারে দৈনিক ১-২ মিলিয়ন লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু, যখন একাধিক বিনিময় হার ছিল না, তখন বাজারটি ছিল আরও সক্রিয়। আমি একদিনেই ৬০০ মিলিয়ন লেনদেন হতে দেখেছি। তাই আন্তঃব্যাংক হারকে বাজার-ভিত্তিক দর বলা যাবে না। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ডলার কেনার দরে সীমা থাকায়, আন্তঃব্যাংক হারের বাজার-ভিত্তিক চালিকাশক্তির অভাব রয়েছে। যেমন ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার কিনছে, তার ওপর সর্বোচ্চ ১ টাকা মুনাফা করতে পারে, এতে ডলার কেনার ওপর একটা সীমা আরোপ হয়ে যাচ্ছে, যা আন্তঃব্যাংক হারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার চালুর দিকে একটি ছোট উদ্যোগ বলে মনে করছেন তিনি।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, নতুন আন্তঃব্যাংক হারের কারণে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো লোকসান হবে না। আন্তঃব্যাংক পর্যায়ে নিম্ন দরে বিক্রি হওয়ায় এপর্যন্ত প্রতি ডলারে অন্তত ২-৩ টাকা লোকসান হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু, এই পরিবর্তনের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বাফেদাকে রফতানি, আমদানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিনিময় হার নির্ধারণের নির্দেশ দেয়।
ডলারের দর উল্লম্ফন করে ১১৫ টাকায় দাঁড়ালে, মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে আনতে একাধিক বিনিময় হারের এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। ডলারের উচ্চ দর প্রশমিত করতে এই ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হলেও, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিম্ন দরে ডলার কিনতে শুরু করলেÑদ্রুত পতনের মুখে পড়ে ফরেক্স রিজার্ভ। অন্যান্য বাজার দরের চেয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির দর উল্লেখযোগ্যভাবে কম থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নের পদক্ষেপ নেয়।#
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রোটিয়াদের হোয়াইট ওয়াশ করে পাকিস্তানের ইতিহাস
৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়
বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক