রাজস্ব ঘাটতি ৪৪ হাজার কোটি টাকা
১১ জুলাই ২০২৩, ১১:১৩ পিএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
বিদায়ি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। ওই বাজেট তৈরির সময়েই আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলেছিলেন এই লক্ষ্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এমনকি ধারণা করেছিল রাজস্ব ঘাটতি বছর শেষে ৪০ হাজার কোটি টাকা হবে। অর্থনীতিবিদদের এই শঙ্কা বছর শেষে সত্যিই হলো। শুধু তাই নয়, বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ধারণা থেকেও ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। সূত্র মতে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা কম। গত অর্থবছর কর আদায় বেড়েছে ৮ শতাংশ। ফলে টানা ১১ বছরের মতো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলো এনবিআর। অবশ্য রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি না হওয়ার যুক্তিও রয়েছে এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশি^ক মন্দার প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার পাশাপাশি কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যরোধে রাজস্ব ছাড় দেয়ায় রাজস্ব ঘাটতি বেড়েছে। ডলার সংকট ও আমদানি কড়াকড়িতে শুল্ক আদায়ে ধস নেমেছে। একই অবস্থা আয়কর আদায়েও। এদিকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতি হওয়ায় সরকারের ব্যাংকঋণে নির্ভরতা বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণ করেছে। বিদায়ি অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সকল বকেয়া মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৩১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা বিদায়ি অর্থবছরের একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ ঋণ। এর আগের মাসে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ১৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা। বিদায়ি অর্থবছরে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার ৭৮৯ কোটি এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৮ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থবছরের প্রথম দিকে এই ঋণের অঙ্ক কম থাকলেও শেষের দিকে ঋণের চাপ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে শেষ দুই মাসে অধিক হারে বেড়েছে। আর গত ২১ ও ২২ জুন দুই দিনেই ১৫ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিদায়ি অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৯৮ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছর ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। অবশ্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়েছে মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তীব্র তারল্য সংকট থাকার কারণে। বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মুখে পড়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ি অর্থবছরে সরকারকে যত ঋণ দেয়া হয়েছে এর মধ্যে ৭৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা নতুন টাকা ছাপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের যে উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানো উচিত, সেখান থেকে আয় না হওয়ার কারণে ঘাটতি বাজেট মেটাতে শেষ দিকে ব্যাংকঋণ বাড়িয়েছে সরকার। যা সার্বিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সরকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। ব্যাংকাররা বলছেন, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে; এরই মধ্যে সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ানোয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। যা আর্থিক খাতে নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাদের মতে, আগে ব্যাংকঋণ নেয়া হতো। তবে তা খুবই সামান্য। সেটা ক্যাশ না থাকার কারণে এক দিনের জন্য হতো। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত ঋণ নেয়া শুরু হয়েছে। এ ধারা চলতে থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; বরং আরও বাড়বে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ঘাটতি বিষয়ে আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তার তুলনায় ঘাটতি বেশি আছে। ৩ লাখ ৩০ থেকে ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হবে বলে ধারণা করেছিলাম। সেটাও হয়নি। রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ যত বাড়বে, মূল্যস্ফীতিও তত বাড়বে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ঋণের অর্থ টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে। এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংককে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের সূত্র হিসাবে ব্যবহার করছে সরকার। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এত পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়নি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, আমদানি-রফতানি খাত থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৯১ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ১৯ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। মূল্য সংযোজন খাত (মূসক) বা (ভ্যাট) থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ১৬ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। আর আয়কর খাত থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। ঘাটতি ৯ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। আমদানি রফতানিতে ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মূসকে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ আর আয়কর খাতে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। ওই বছর ৩ লাখ ৮৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘাটতি হলো বাড়তি ১৬ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র মতে, রাজস্ব ঘাটতি বাড়ায় অন্যান্য উৎস যেমনÑ সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক থাকায় এবং বৈদেশিক ঋণ ছাড়ে গতি না হওয়ায় সরকার শেষ সময়ে বকেয়া মেটাতে ব্যাংকিং খাতে নির্ভরতা বাড়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় শেষ মাসে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিতে বাধ্য হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত কয়েক বছরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার মধ্যে বিদায়ি বছরে নেয়া ঋণের অঙ্কই সর্বোচ্চ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১ মে পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক থেকে নিট ঋণের অঙ্ক ছিল ৯২ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। আর ২০ জুন তা বেড়ে এক লাখ ১২ হাজার ২৪১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ জুনের প্রথম ২০ দিন সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের অঙ্ক ছিল ১৯ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। তবে ২২ জুন সরকারের নিট ঋণের অঙ্ক আরও বেড়ে এক লাখ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকাতে পৌঁছায়। অর্থাৎ দুই দিনে সরকার ব্যাংক থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ১৫ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। পুরো টাকাই জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর ২৬ জুন ছিল গত অর্থ বছরের শেষ দিন। কারণ ২৭ তারিখ থেকে শুরু হয় পবিত্র ঈদুল আজহার সরকারি ছুটি। ২৬ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ, অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের অঙ্ক দাঁড়ায় এক লাখ ২৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এদিকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছে, আগামী সাড়ে তিন বছর ধরে স্বাভাবিক গতির চেয়ে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। আর সেই কৌশল প্রনয়ণ করা হয়েছে জুনেই। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আইএমএফ’র চাপে রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেটে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব হিসেবে ৫ লাখ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগ্রহ করবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে আরও ৭০ হাজার কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরে সকল উৎস মিলে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ
সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন
গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু
শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি