নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারই সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায়
১৫ জুলাই ২০২৩, ১১:৪৩ পিএম | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারই দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন সাবেক আমলাগণ। তারা বলেন, বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অবৈধ ঘোষণা এবং এই রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকট তৈরি করা হয়েছে।
দেশকে এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, গণতন্ত্রে ফিরে আসা, প্রকৃত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা নিশ্চিত করা। আর এটা সম্ভব একটি ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার মাধ্যমে। বক্তারা আরো বলেন, দলীয় সরকারের অধীন এদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। কারণ দেখা গেছে ১৯৭৩ সাল থেকে দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা কখনও পরাজিত হয়নি। অন্যদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত ৯১, ৯৬, ২০০১ এর ৩টি নির্বাচন দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছে। সেমিনারে বক্তাগণ দেশের এই গভীর রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে ও জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার একমাত্র সমাধান হলো ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার’ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন। সেটা যে কোন নামেই হোক।
গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণামূলক সেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘পলিসি ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিসার্চ সোসাইটি’-পিএমআরএস এর উদ্যোগে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং বিদ্যমান সঙ্কট উত্তরনের উপায়’ শীর্ষক এক সেমিনার বক্তারা এসব কথা বলেন।
পলিসি ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিসার্চ সোসাইটির চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক সচিব মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ’র সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. বোরহান উদ্দিন খান। আলোচক ছিলেন- বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি মো. আব্দুল কাইয়ুম, সুপ্রীম কোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার জেনারেল ইকতেদার আহমেদ, নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার এবং সভা পরিচালনা করেন অবসরপ্রাপ্ত কর কমিশনার কাজী ইমদাদুল হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক সংগঠনের মহাসচিব এবং সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. আবদুল বারী।
সেমিনারে আলোচকবৃন্দ বলেন, হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধন আইন তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ মর্মে ঘোষণা করেন। সুপ্রিম কোর্টে আপীলের শুনানীতেও ৮ জন এমিকাস কিউরির মধ্যে ৭ জনই তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রয়োজন মর্মে কোন না কোনভাবে অভিমত প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা এটার্নি জেনারেল ও তাঁর সহযোগীগণও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রয়োজন মর্মে আদালতে তাঁদের যুক্তি তুলে ধরেন। প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এসকল অভিমত, যুক্তি, ব্যাখ্যা, পরামর্শ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কোন কিছুই আমলে না নিয়ে একটি বিতর্কিত রায় প্রদান করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে নিষ্পত্তিকৃত রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে রাতারাতি ওলট-পালট করে দেন। এতেই দেশ মহাসংকটে নিমজ্জিত হয়।
তারা বলেন, এ বিতর্কিত রায়ের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তদানীন্তন এটার্নি জেনারেল বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধন আইন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পরবর্তী দুটি নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে।
সভায় বক্তারা উল্লেখ করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল ১৯৯৬ সালে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রচিত একটি রাজনৈতিক সমঝোতার ফসল। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা-দাবী-আন্দোলন এবং সর্বোপরি জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলনই হচ্ছে “নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার” ব্যবস্থা।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বিজন কান্তি সরকার বলেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক একটি বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আদেশ প্রদান করে জাতিকে মহাসংকটে নিপতিত করেছেন। বিচারপতি খায়রুল হক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের ইচ্ছা এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ফসল হিসেবেই সংবিধানে স্থান পেয়েছিল। তিনি আরো বলেন, বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে ত্রয়োদশ সংশোধন আইন অবৈধ ঘোষণা এবং রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে চরম রাজনৈতিক সংকট তৈরী করা হয়েছে।
ইকতেদার আহমেদ বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ে চারজন বিচাপতি দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীন হতে পারে মর্মে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন এবং ৩ জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো ৭জন বিচারপতিই অন্তত দুই টার্ম অর্থ্যাৎ দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে একমত ছিলেন। অথচ এ বিবেচনা উপেক্ষা করে একই বছর ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করায় এ বাতিল আদেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। মূলত: এখান থেকেই সংকটের জন্ম। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বিষয় হলো প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পরে (২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর) লিখিত রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার বিষয় থেকে সরে এসে সংসদের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেন।
এখানে আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, আদালত এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নির্দেশনা দেয়নি। আদালত সুরাক্ষামূলকভাবে শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অথাৎ দুটি নির্বাচন (দশম ও একাদশ) এ ব্যবস্থায় হওয়ার পর বাতিল হবে মর্মে আদেশ দিয়েছেন। অথচ আদালতের এ আদেশকে বিভ্রান্তিমূলকভাবে উপস্থাপন করে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে জাতির সাথে প্রতারনা করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রত্যক্ষ প্রভাব জনগণ দেখতে পেয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ এর মতো নৈরাজ্যকর, প্রহসনমূলক ও মধ্যরাতের ভোটের মাধ্যমে যা জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর দেখতে চায় না।
সেমিনারে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব এএসএম আব্দুল হালিম, সাবেক সচিব আব্দুর রশিদ সরকার, মনিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মকসুমুল হাকিম চৌধুরী, মো. আব্দুল জাহের, যুগ্ম সচিবগণরে মধ্যে- এবিএম আব্দুস সাত্তার, ড. একেএম জাহাঙ্গীর, তপন চন্দ্র মজুমদার, মুন্সি আলাউদ্দিন আল আজাদ, মোস্তাইন বিল্লাহ, ড. মো. আব্দুস সবুর, মো. আব্দুল খালেক, ড. মোহাম্মদ ফেরদৌস হোসেন, সাবেক উপ-সচিব নেয়ামতুল্লাহ ভূঁইয়া, মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী, কাজী মেরাজ হোসেন, ড. মো. মশিউর রহমান, মোঃ আফতাব আলী, মোহাম্মদ জাকির হোসেন কামাল, মো. আব্দুল মতিন, একেএম এহসানুল হক, ড. মো. সুরাতুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত কর কমিশনার ড. মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ভূঁইয়া, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, মেজবা উন নবী, মাহফুজুল হক, সাজ্জাদ হোসেন, সাবেক সিনিয়র এএসপি মো. শোয়েব, সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা সামসুল আলম, এডভোকেট নুরুল ইসলাম জাহিদ, তারেকুল ইসলাম মঈন, গাজী ইব্রাহিম প্রমুখ। এছাড়াও সেমিনারে অবসরপ্রাপ্ত শতাধিক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীতে নিখোঁজ দুই কিশোরের মরদেহ উদ্বার
পশ্চিম তীরে ইসরাইলের ড্রোন হামলা, নারীসহ ৮ ফিলিস্তিনির মৃত্যু
সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় নয়: আসিফ মাহমুদ
ভারতে শঙ্করাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে হস্তক্ষেপ চাইলেন একদল বাংলাদেশি হিন্দু
অবশেষে সচিবালয়ে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে
হাসিনাকে ভারত কি ফেরত পাঠাবে, আলজাজিরার প্রতিবেদন কি বলছে
সচিবালয়ে সেনাবাহিনী-বিজিবি মোতায়েন
কানু দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে, দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি
বাংলাদেশ থেকে নথি না আসাতেই জামিন পিকে হালদারের?
সময় টিভির সাংবাদিক বরখাস্ত: এএফপির প্রতিবেদন নিয়ে যা বললেন হাসনাত
আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট ও নয়তলা
লক্ষ্মীপুরে পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিলো স্থানীয়রা
গাজীপুরে ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ গ্রেফতার
সচিবালয়ের আগুন এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস
ফ্যাসিবাদের সময় উত্তরবঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে: নীলফামারীতে উপদেষ্টা আসিফ
সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত ফায়ার ফাইটার সোহানুর
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০ ইউনিট
গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা
বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই