রাজধানীর খালগুলো মশার প্রজনন ক্ষেত্র
২১ জুলাই ২০২৩, ১১:০৮ পিএম | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
রাজধানীর খালগুলো ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ময়লা আবর্জনায় ভরা এসব খাল এখন মশার উৎকৃষ্ট প্রজনন কেন্দ্র। খালগুলোতে মশার ব্যাপক বংশ বিস্তারের কারণে বর্তমানে রাজধানীতে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা সম্পর্কে আগে বলা হতো, এমশা শুধু দিনে কামরায়, রাতে নয়। আর এডিস মশা শুধু স্বচ্ছ পরিস্কার পানিতে বংশ বিস্তার করে। তবে এ ধারণা এখন পাল্টে গেছে। এডিস মশার চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে। সে এখন দিনে রাতে সব সময়ই কামড়ায়। এর পিছনে রয়েছে আলোক দূষণ। আর শুধু জমানো স্বচ্ছ পানি নয়। স্বচ্ছ-ঘোলা যেকোনো ধরনের জমানো পানিতেই এডিস মশা জন্ম নেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার তার সর্বশেষ গবেষণায় বলেছেন, এডিস মশা এখন দিনে-রাতে সব সময় কামড়ায়। এর কারণ বিশ্বব্যাপী এখন আলোক দূষণ ঘটেছে। এখন রাতেও উজ্জ্বল আলো থাকে। ফলে এখন তার কাছে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য নেই। আগে আমরা দেখতাম পরিষ্কার জমানো পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। কিন্তু এখন দেখছি যেকোনো জমানো পানি, ময়লা বা পরিস্কার সবখানেই এডিস মশা হয়। এমনকি লোনা পানিতেও সে জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। এই মশা পরিবেশের সাথে খুবই আ্যডাপটিভ। সে সব অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে বলা হয় রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিতেই এডিস মশার উচ্চ ঘনত্ব পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছিলো। এবারের পরিস্থিতি তারচেয়েও খারাপ। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। আর এবার এটা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, সাধারণ এডিস মশা ছাড়াও বুনো ধরনের এডিস মশা আছে। তাদের বলা হয় এডিস অ্যালগোপিকটাস। ২০১৯ সালে এর উপস্থিতি আমরা প্রথম লক্ষ্য করি। এরা বনে গাছের কোটরে জমে থাকা পানি, ঝোপঝাড়ে জমে থাকা পনিতে জন্ম নেয়। এরাই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীতে এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতার অন্যতম কারণ হচ্ছে খালগুলো ঝোপঝাড় আর ময়লা আবর্জনা ভরা। এসব ঝোপঝাড়ে অ্যালগোপিকটাস জাতীয় এডিস মশা আরামে বংশ বিস্তার করছে এবং সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার খাল রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও এর সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। পরিস্কার বা সংস্কারের পর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে ফের ভরাট হয়ে পড়ে খাল। আর অনেক জায়গায় সেই সুযোগ কাজে লাগায় অবৈধ দখলদাররা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার খাল ভরাট ও বেদখলের ফলে জলাবদ্ধতা এবং পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। তা ছাড়া যানজট নিরসনে নৌ-রুট প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনাও ভেস্তে যাচ্ছে। ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার পর সিটি করপোরেশন নিজস্ব ফান্ড থেকে অনেক খাল পরিষ্কার করে। কিন্তু সেসব খাল আবারও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার খালগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য্যবর্ধনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে সরকার। এরই মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চারটি খাল সংস্কার এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এলাকার খালের জন্য ৬৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন অপেক্ষায় আছে। ডিএসসিসি বাকি খালগুলো নিয়েও আলাদা প্রকল্প তৈরি করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ৪৬টি খালের মধ্যে ২০টিই বিলীন হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে ২৬ খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও দখল ও দূষণে এগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর নন্দীপাড়া (জিরানি), রামপুরা, মান্ডা, কাটাসুর, লাউতলা ও ইব্রাহিমপুর খালের বেহাল অবস্থা। এসব খালে আশপাশের বাসাবাড়ির সব পয়ঃবর্জ্য গিয়ে পড়ছে।
শহীদবাগ-গুলবাগের ভিতর দিয়ে খিলগাঁও রেল গেইট পর্যন্ত খালের যে অস্তিত্ব এখনো আছে সেটাও ময়লা আবর্জনায়পূর্ণ। মাস দু’য়েক আগে পরিস্কার করা হলেও আবার সেটা ময়লা আবর্জনা ও ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে। এ খালে আশপাশের বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য গিয়ে পড়ছে।
খিলগাঁও রেলক্রসিং থেকে তালতলা মার্কেটের দিকে যাওয়ার পথে যে কারও চোখে পড়বে খিলগাঁও-বাসাবো খালের সীমানা পিলার। ঢাকা ওয়াসা এ পিলার স্থাপন করলেও সেখানে খালের কোনো অস্তিত্ব নেই। খাল ভরাট করে মাটির নিচে পাইপ ড্রেন তৈরি করে রেখেছে দখলদাররা। বাসাবো এলাকায় এ খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও খিলগাঁও অংশে তা বিলীন হয়ে গেছে।
মান্ডা খালের গুদারাঘাট এলাকার ব্রিজের দুই পাশে যতদূর দেখা যায়, ততদূর চোখে পড়ে ময়লার স্তূপ। কিছু অংশ দখল করে গোয়ালঘর, দোকান ও আবাসিক ভবনসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। নন্দীপাড়া খালও ময়লার স্তূপে মৃতপ্রায়। মাদারটেক অংশে খালের মধ্যে খুঁটি পুঁতে বিপুলসংখ্যক দোকান বসানো হয়েছে। এসব বাঁশের খুটিতেও ময়লা আটকে স্তূপ হয়ে আছে। আর বাগানবাড়ী মাদারটেক এলাকায় ওয়াসা পানির পাম্পের পাশে খালের অবস্থা খুবই করুণ। ওখানে খালে ময়লার স্তূপ দেখা গেছে।
রামপুরা খালে অবৈধ দখল তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও দূষণের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালটির মেরাদিয়া বাজার অংশে বিশাল ময়লার ভাগাড় রয়েছে। ওখানে ময়লা ফেলার সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) থাকলেও সেটি অনেকদিন ধরে নষ্ট। এ এসটিএসের সামনে খালের পাড়ে বনশ্রী ও দক্ষিণ বনশ্রীর বাসাবাড়ির ময়লা ফেলা হয়। কিছু ময়লা ল্যান্ডফিল্ডে নিলেও অধিকাংশ খালে পড়ে। এ ছাড়া খালের ডি ব্লক অংশে মূল সড়কের পাশে খাল পাড়ে ময়লা ফেলা হয়। এসব ময়লার সবটুকুই খালে গিয়ে পড়ে। এতে খালের নিচের অংশ অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। একই অবস্থা কাটাসুর খাল, রূপনগর খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল ও কল্যাণপুর খালের। বিভিন্ন সময় অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং খাল পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা আবার পুরোনো রূপে ফিরছে।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন তোড়জোর করে কিছু বর্জ্য অপসারণ করেছিল। এখন আবার পুরোনো রূপে ফিরে গেছে খালগুলো। এর অন্যতম কারণ কমিউনিটিকে এনগেজ করতে পারেনি। যদি এলাকার মানুষকে সচেতন করা হতো, তাহলে এই অবস্থা হতো না। এখন শুধু মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক রুটিন মাফিক অভিযান চালিয়ে তারা দায়িত্ব শেষ করছে। খালগুলো হাতে পাওয়ার পর সর্বপ্রথম খালের দখলদারদের তালিকা করা উচিত ছিল। ওই তালিকা অনুযায়ী উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করত, তাহলে খালের এই অবস্থা হতো না।
ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর সব খালই দখলমুক্ত করে এগুলো পর্যায়ক্রমে নান্দনিক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে দক্ষিণের চারটি খালের প্রায় ২০ কিলোমিটার দখলমুক্ত ও সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ এ প্রকল্পটি এরই মধ্যে একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৮৯৮ কোটি টাকা। যা ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ডিএসসিসির আওতাধীন খালগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে চারটি খালের একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। তা ছাড়া চলতি বছর বাজেটে খাল সংস্কার কাজে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। খালগুলো পরিষ্কার করে নান্দনিক পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, খালের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিকভাবে পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু করি। গত দুই বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন বর্জ্য অপসারণ করি। কিন্তু মানুষের সচেতনতার অভাবে আবার ময়লা জমতে শুরু করে।
ঢাকার দুই সিাটি এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ সক্রিয়। তারা অভিযান চালিয়ে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করছেন। তবে মশা মারতে প্রচলিত ফগিং পদ্ধতিতেই তারা আটকে আছে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দুই সিটি কর্পোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে খরচ করেছে ১৪৭ কোটি টাকা। কিন্তু তার কার্যকরী কোনো সুফল রাজধানীবাসী পায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ঢাকার সব খাল পরিস্কার করতে হবে। মশার এইসব প্রজনন কেন্দ্র ধ্বংস করতে হবে। তা না হলে প্রতি বছরই মশা মারতে শত শত কোটি টাকা খরচ হবে কিন্তু তাতে কোন সুফল পাওয়া যাবে না।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়
ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান