বিশেষ অভিযানের মধ্যেও বেপরোয়া ছিনতাই
২১ জুলাই ২০২৩, ১১:১৫ পিএম | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
ঈদের ছুটি শেষে গত ১ জুলাই শেরপুর থেকে ট্রেনে তেজগাঁও রেলস্টেশনে নামেন পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামান তালুকদার। ভোরে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ফিরছিলেন মোহাম্মদপুরের কর্মস্থলে। পথে ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টে ছিনতাইকারীরা মনিরুজ্জামানকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর তার কাছে থাকা মালামাল ছিনিয়ে নেয়। এর একদিন আগে হাতিরঝিল এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া দুই সাংবাদিকের একজন রাকিবুল হাসান রানা ছুরিকাঘাত অবস্থায় ভর্তি হন পঙ্গু হাসপাতালে।
এ দু’টিসহ একাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রাজধানীতে বিশেষ অভিযানে নামে পুলিশ। বিশেষ কিছু এলাকায় চলে র্যাবের বিশেষ রোবাস্ট পেট্রোলিং টহল, সাথে গোয়েন্দা নজরদারি এবং জোরদার নিরাপত্তা । ঢাকার ৫০টি থানায় বিশেষ টিম ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে অভিযানে নামে। গঠন করা হয় ছিনতাই প্রতিরোধী বিশেষ টিম। অনেক থানায় আবার কুইক রেসপন্স টিমকে ছিনতাইবিরোধী অভিযানে যুক্ত করা হয়। অতীতে যারা ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে, তাদের তালিকা ধরে চলে অনুসন্ধান। বিশেষ অভিযানে প্রত্যেক থানা এলাকা থেকেই কম বেশি ছিনতাইকারী গ্রেফতার করে পুলিশ। সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংরক্ষিত অপরাধীদের চিহিৃত করে তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু কিছুতেই যেন নিযন্ত্রনে আসছে না ছিনতাই। বিশেষ অভিযানের মধ্যেই গত ১৭ জুলাই রাতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আদনান সাঈদ রাকিব (১৭)।
পুলিশ দাবি করছে, এসব ঘটনায় জড়িত ছিনতাইকারীদের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। যদিও এর আগে ডিএমপি পুলিশ কশিনার জানিয়েছিলেন, পলিশ ঝুঁকি নিয়ে ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে। কিন্তু অপররাধীরা জামিনে এসেই ফের একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তিনি ছিনতাইরোধে এসব অপরাধীদের জামিন না দেয়ারও অনুরোধ করেছিলেন।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তখন বেশ কিছু এলাকায় রিকশা ও হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য এটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশীয় অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীর সঙ্গে প্রতিবাদ করাও কঠিন। একটু বলপ্রয়োগ করতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় থাকে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বাস কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে ওত পেতে মোবাইল টান দিয়েও দৌড়ে পালাচ্ছে ছিনতাইকারীরা।
বিশেষ অভিযানের মধ্যে কথা হয় ঢাকার বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের(ওসি) সঙ্গে। তারা ছিনতাইকারীদের হিং¯্রতার কথা তুলে ধরেন। লালবাগ থানার ওসি বলেন, তার থানার একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি স্পটে ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করে। ছিনতাইকারীরা কিছুটা সরে গিয়ে পুলিশের প্রতিই মারমুখী হয়। এমনকি পুলিশের দিকে সুইচ গিয়ার ছুরি তাক করে আক্রমনের চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাদের ধারালো অস্ত্রসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
রাজধানীতে এমন ঘটনা শুধু সন্ধ্যা বা রাত নয়, এখন দিনদুপুরেও ঘটছে। সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার কিংবা মোটরসাইকেল। এদের টার্গেট ভ্যানিটি ব্যাগ, হাতব্যাগ, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোনসেট।
ঈদকালীন সময়ে জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং ছিনতাই রোধে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, শ্যামপুর, ওয়ারী, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও মাওয়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে র্যাব। নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি বিশেষ রোবাস্ট পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে টহলসহ সাদা পোশাকে র্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু এত অভিযানের মধ্যেও ছিনতাই হয় হরহামেশা। ছিনতাইকারীরা সাধারণত মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত তৎপর থাকে। তারা ভোরে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল ও রেলস্টেশন থেকে বাসামুখী রিকশাযাত্রী অথবা বাসা থেকে স্টেশনমুখী যাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানায়।
ডিএমপির কয়েকটি থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের অভিযোগে যেসব আসামিকে গ্রেফতার করা হয় তারা পুনরায় কারাগার থেকে বেরিয়ে ফের ছিনতাইয়ে নেমে পড়েন। ডিএমপি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ কনস্টেবল মনিরুজ্জামানকে খুন করাসহ সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই জামিনপ্রাপ্ত। পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় জড়িত এমন একজন আছেন, যিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে ৮ বার জেল খেটেছেন। এরমধ্যে ১৫ দিন, এক মাস থেকে শুরু করে একবার সর্বোচ্চ ২৬ মাস তিনি জেলে ছিলেন। এছাড়া রাকিবুল হাসান রানাকে ছুরিকাহত করা ছিনতাইকারীও জামিনে বেরিয়ে অপরাধে জড়িয়েছেন। সবশেষ আইডিয়াল কলেজের ছাত্র রাকিব খুনের সাথে জড়িতরাও ছিনতাই অপরাধে এর আগে জেল খেটে জামিনে বের হয়।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, ছিনতাই ঠেকাতে ‘এসআইভিএস’ সিস্টেম চালু করা হয়েছে। অনেক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের রহস্যের জট খুলতে এই তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান জানান, গত ১২ মে ভোরে একটি ডাকাত দলের কবলে পড়েন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) নারী কনস্টেবল নার্গিস আক্তার। রিকশা থামিয়ে তার কাছ থেকে সোনার চেইন, নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায় ডাকাতরা। একই রাতে ধানমন্ডিতে আরেকটি ডাকাতি করে একই চক্র। পরদিন ১৩ মে তেজগাঁও ও বনানী থানা এলাকায় আরও দুটি ডাকাতি করে তারা। ডাকাতির ঘটনায় পল্টন থানায় মামলা করেন নার্গিস আক্তার। তদন্ত করতে গিয়ে সিসি ক্যামেরার শতাধিক ফুটেজ থেকে ডাকাত চক্রকে চিহ্নিত করা হয়। পরে এসআইভিএসের সঙ্গে ছবি মিলিয়ে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ১৫ মে মহাখালী থেকে ডাকাত দলের চারজনকে গ্রেফতার করে পল্টন থানা পুলিশ।
এর আগে গত বছরের ২৭ মার্চ ভোরে মিরপুরের শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দন্তচিকিৎসক আহমেদ মাহী । এ ঘটনায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ছুরি ও ছিনতাই হওয়া মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের নাম এসআইভিএসে ছিল। এ তথ্যভান্ডারের কারণে রাজধানীতে ছিনতাই ও ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছেন ডিএমপির কর্মকর্তারা।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে চলা বিশেষ অভিযানে ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৬৭৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪৪ জনকে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া ডিএমপির মিরপুর বিভাগ ১০৪ জন, লালবাগ বিভাগ ৮৬ জন, রমনা বিভাগ ৫০ জন, মতিঝিল বিভাগ ৬৩ জন, উত্তরা বিভাগ ৬৯ জন, গুলশান বিভাগ ৩৩ জন ও ওয়ারী বিভাগ ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঈদ পরবর্তী নিরাপত্তা প্রদানের অংশ হিসেবে র্যাব প্রত্যেক এলাকায় দুটি শিফটে বিশেষ রোবাস্ট পেট্রোলের মাধ্যমে পর্যাপ্ত টহল ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের ডিউটিতে মোতায়েন করা হয়। গ্রেফতার করা হয় অসংখ্য ছিনতাইকারীকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশকে রাজনৈতিক কাজে বেশি ব্যবহার করার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তারা সময় দিতে পারছে না। পুলিশ ছাত্রদের আন্দোলন দমনে, আইনজীবিদের দমনে এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচালে ব্যাপক ভ’মিকা পালন করলেও তাদের আসল দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি সঠিক ভাবে করতে পারছে না।
অপরাধ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন প্রফেসর খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ছিনতাইকারিরা ধরাও পড়ছে আবার জেলেও যাচ্ছে। কিন্তু কারাগারে তাদের প্রোপারলি সংশোধন করানো হচ্ছে না। তাই এরা বের হয়ে আবারো ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। এদেরকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনির নজরদারির মধ্যে রাখার কোনা সিস্টেম নাই। ছিনতাইয়ের সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছেও। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে ২০২২ সালে এসব ঘটনায় হারানো সাধারণ ডায়েরি হয়েছে সাড়ে ৮ হাজারের বেশি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব
দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা
দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ