পুলিশের প্ররোচনায় কিশোরীর আত্মহত্যা
২৫ জুলাই ২০২৩, ১১:৩৬ পিএম | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০৩ এএম
চোখের সামনে মাকে নির্যাতন ও টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে পুলিশকে বাধা দেন কিশোরী কন্যা বৈশাখী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ ওই কিশোরীকে একটি কক্ষে আটকে রেখে বাইরে তালা লাগিয়ে দেয়। এ সময় কিশোরীটি চিৎকার করে বলতে থাকে, মাকে ছেড়ে না দিলে সে আত্মহত্যা করবে। এর কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে দেখা যায় কিশোরী সত্যিই ঝুঁলে আছে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে। যখন তাকে নামানো হলো ততক্ষণে তার দেহে প্রাণ নেই। এ আত্মহত্যার জন্য পুলিশের প্ররোচনাকে দায়ী করেছে তার পরিবার।
রাজধানীর হাতিরঝিল থানা হেফাজতে চুরির মামলার অভিযুক্ত আসামি রুম্মন শেখের আত্মহত্যা, উত্তরা পূর্ব থানায় মারামারি মামলার আসামি হিরনের মৃত্যু, মারামারির আরেক মামলায় হাজারীবাগ থেকে গ্রেফতারকৃত আসামি মিজানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং সন্দেহজনক আসামি হিসেবে তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া বাঁধের বাসিন্দা আলাউদ্দিন দেওয়ানের হাসপাতালের মৃত্যুর ঘটনার পর এবার খোদ রাজধানীর পল্লবীতে মাদক মামলার আসামির বাসায় অভিযানকালে পুলিশের সামনেই এক তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার মধ্যরাতে পল্লবীর আদর্শনগরের ওই বাড়িতে পুলিশ সদস্যদের আটকে রেখে ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে এলাকাবাসি। এ সময় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে বিক্ষুদ্ধরা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পল্লবী থানাধীন আদর্শ নগর এলাকার একটি বাড়িতে মাদক কারবারির অভিযোগে এক নারীর কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। রাজী না হলে ওই নারীকে পুলিশ বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে। এরই প্রতিবাদে পল্লবী থানা পুলিশের সামনে ওই কিশোরী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ভুক্তভোগী কিশোরীর নাম বৈশাখী (১৬)। তার মায়ের নাম লাভলী বেগম। যে কক্ষে কিশোরী আত্মহত্যা করে সে’টি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ ছিল। অভিযানের সময় ওই কিশোরীকে পুলিশ গলাটিপে হত্যা করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা পুলিশকে অবরুদ্ধ করে। কিশোরীর মৃত্যু আত্মহত্যা হলেও তাতে প্ররোচনার জন্য পুলিশকেই দায়ী করেছে তার স্বজনরা।
পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ মর্গে প্রেরণ করে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সেখানে ময়না তদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে মর্গ কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, গত সোমবার রাত ৯ টার দিকে পল্লবী থানাধীন কালশি আদর্শ নগর ১১ নম্বর রোডের ২১ নম্বর বাড়িতে প্রবেশ করে থানা পুলিশের একটি টিম। এলাকাবাসীর দাবি ২১ নম্বর চারতলা ওই বাড়িটির মালিক লাভলী বেগম। তার বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা আছে। মাঝে মধ্যেই পল্লবী থানা পুলিশ ওই বাড়িতে গিয়ে তল্লাশী চালিয়ে টাকা দাবি করে।
বাড়ির মালিক লাভলী বেগম নামের ওই নারীর ভাষ্য, গত সোমবার রাত ৯ টার দিকে পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক জহির, ওহিদ, আনোয়ারসহ তার কয়েকজন সোর্স ও এক নারী কনস্টেবলসহ আমাদের বাসায় মাদক আছে বলে অভিযান চালায়। কিন্তু তারা কোনো মাদক পায়নি। এক পর্যায়ে তারা আমার কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হলে তারা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালায়। তখন আমার মেয়ে বৈশাখী আক্তার এসে বাধা দেয়। কিন্তু এরপরেও তারা আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তখন আমাকে ও মেয়েকে তারা পাশের বাসায় নিয়ে আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর শুনতে পাই যে, তারা বলছে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরে আমাদের বাসার নিচতলার রুমে গিয়ে দেখতে পাই আমার মেয়ের লাশ ঝুলছে।›
বৈশাখীর মামা সুজন বলেন, লাভলী ৫০ হাজার টাকা দিলেও তাকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করে পল্লবী থানার এস আই জহির, পুলিশের স্থানীয় সোর্সরা। এ দৃশ্য দেখে আমার ভাগ্নী কষ্টে পুলিশের সামনেই আত্মহত্যা করেছে।
তবে নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার জসীমউদ্দীন মোল্লা বলেন, পল্লবী থানার একটি দল এক মাদক কারবারি লাভলীকে ধরতে যায়। তার ওখান থেকে কিছু গাঁজা ও ইয়াবা উদ্ধার হয়। এরপর তাকে ছাড়িয়ে রাখার জন্য তার মেয়ে ও পরিবারের লোকজন টানা হেঁচড়া করে। একটা পর্যায়ে লাভলীকে নিয়ে পুলিশ নিচে নেমে আসে। এই সময়ে তার মেয়ে দরজা আটকিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিতে থাকে পুলিশকে। বাই দিস টাইম, সে দরজা আটকিয়ে আত্মহত্যার অ্যাক্টিং করতে গিয়ে সে ভেতরে মারা গেছে। পরে পাবলিক দরজা ভেঙে তাকে বের করেছে। সেই ভিডিও আছে। তিনি জানান, লাভলীর বিরুদ্ধে সাতটি এবং বৈশাখীর বিরুদ্ধে চারটি মাদকের মামলা আছে। এরা পুরো পরিবারটিই মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, এ ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হবে।
বৈশাখীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশের পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, আমরা গিয়ে দেখলাম, যেই রুমটা থেকে লাভলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই রুমেই বৈশাখী আত্মহত্যা করেছে। মাকে নিয়ে গেলে বৈশাখী আত্মহত্যা করবে বলে যে হুমকি দিচ্ছিল, ওখানকার কিছু মানুষ কিন্তু এরকম ভিডিও ধারণ করেছেন। নিচে লাভলীকে আনা হলে আমাদের এক মহিলা পুলিশসহ চারজনকে আটকে রাখা হয়। আর মেয়েটির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পাঁচ-ছয় হাজার মানুষ বেরিয়ে এসে পুলিশকে কর্ডন করে ফেলে। তারা পুলিশের ওপর ইট ছুড়েছে। আমাদের লোক আহতও হয়েছে। পরে আমরা তাদের বুঝিয়ে শান্ত করি। এমনকি বৈশাখীর লাশ উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে আনার সময় কিছু মানুষ লাশ নামিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। থানায় জানিয়েই এসআই জহির এই অভিযানে গিয়েছিলেন। থানার ছত্রছায়ায় মাদক কারবারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরাও এরকম অনেক কথা শুনেছি। বিষয়টির তদন্ত হবে। কেউ যদি অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কর্তব্য পালনে কোনো ত্রুটি থাকলেও অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লাভলীকে বিবস্ত্র অবস্থায় নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা ঘটনারই ফুটেজ আছে স্থানীয়দের কাছে। প্রচুর গুজব ছড়ানো হয়েছে।
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, বছর খানেক আগে বৈশাখী বিয়ে করে। স্বামীর বাড়িতে বসবাস করলেও গত সোমবার বিকেলে মায়ের বাসায় বেড়াতে আসে।
বৈশাখীর ভাই আতাউর রহমান বলেন, মায়ের সঙ্গে তার বোনকেও পুলিশ চারতলা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়েছে। তিনি রাত ১১ টায় তিনতলার একটি কক্ষের জানালা দিয়ে তার বোন বৈশাখীকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন। তখন ঘরটির দরজায় বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। গতকাল বিকেলে ময়না তদন্তে শেষে বৈশাখীর লাশ দাফনের জন্য নিয়ে গেছেন তার স্বজনরা। গত রাত ৮টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো ধরনের মামলা হয়নি থানায়।
এদিকে আসামি গ্রেফতারকালে পুলিশের এ ধরনের বাড়াবাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এর আগে গত বছরের ২০ আগস্ট রাতে একটি চুরির মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি রুম্মন শেখ ওরফে সুমন নামে এক যুবক হাতিরঝিল থানা হাজতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। পুলিশের নির্যাতনের অভিযোগে এ ঘটনায় থানার সামনে তখন বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসি। গত বছরের ৩০ নভেম্বর রাতে উত্তরা পূর্ব থানায় পুলিশ হেফাজতে থাকা হিরন (৫১) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। হিরনের ভাই বাদল মিয়া তখন এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন।
গত ৬ জুন তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া উত্তর পাড়ায় বাসা থেকে আলাল উদ্দিন দেওয়ান (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। ১০ জুন আদালতকে জানিয়ে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং গত ১৬ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। ওইদিন রাতেই জাতীয় হৃদরোগ থেকে ফোনে স্বজনদের জানানো হয় তিনি মারা গেছেন। আলালের স্বজনদের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে সুস্থ আলালকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি উত্তরা বিভাগের পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান। ডিবি আটকের পর তার ওপর নির্মম নির্যাতন করে পা ভেঙে দেয়। কিন্তু অসুস্থতার বিষয়ে আলালের পরিবারকে কিছুই জানায়নি ডিবি। হাজারিবাগেও মিজানুর রহমান নামে এক আসামির মৃত্যু হয়।
শুধু রাজধানীতেই নয়, সম্প্রতি বরিশালের গৌর নদীতে তাস খেলারত যুবকদের ধরতে পুলিশের তাড়া খেয়ে এক যুবক মারা গেছেন। গত ২৫ জুন নাটোরে পুলিশের ধাওয়ায় খেয়ে দিঘীতে ডুবে শিহাব হোসেন নামে এক যুবক মারা যায়। এছাড়াও চট্রগ্রাম, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযানে হতাহতের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ