ওয়েবিনারে বিচারপতি এম এ মতিন

গায়েবি মামলা অসাংবিধানিক, পরবর্তী প্রজন্ম কি জঙ্গলে বাস করবে?

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:০৩ পিএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

দেশে আইনের শাসন নেই এবং গায়েবি মামলা অসাংবিধানিক মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন বলেছেন, এটা চরম আকারে আইনের অবমাননা। এছাড়া দেশে আইনের শাসন নেই জানিয়ে তিনি বলেছেন, ব্রিটিশ আমলেও তো এর চেয়ে ভালো ছিলাম, তখন আইনের শাসন ছিল। গতকাল রোববার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে ‘গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, গায়েবি এসব মামলার প্রধান কাজ হচ্ছে ভুয়া নির্বাচন সাধন করা। এতে সরকার অবাধে কারচুপি করতে পারে। এজন্য নির্বাচনের আগে গায়েবি মামলা দেয়া হয়। এই মামলা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র আইন কর্মকর্তা ড. রিদওয়ানুল হক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক জাহেদ-উর রহমান।

সাবেক বিচারপতি এম. এ. মতিন বলেন, আমরা তো একটি শাসনতন্ত্রের মধ্যে আছি। আমরা তো জঙ্গলে নেই। এই শাসনতন্ত্রে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো কাগজে লেখা থাকলেও বাস্তবে কিছু থাকলো না। এই দেশে তাহলে আমাদের সন্তানরা কীভাবে থাকবে? যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো রক্ষাকবচ থাকলো না। আমরা তো তাহলে এর চেয়ে ব্রিটিশ পিরিয়ডেই ভালো ছিলাম। যেখানে আইনের শাসন ছিল। আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের শাসন নাই। আইনের শাসন যদি না থাকে তাহলে এই আইন দিয়ে আমরা কি করবো? এই আইন দিয়ে তো পূজা করবো না। আমাদের রক্ষার জন্যই এই আইন। সময় এসেছে আইনের সঠিক প্রয়োগ করার। তিনি বলেন, সভা করার অধিকারের কথা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এখানে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে কেন? এগুলো নিয়ে সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না।

সাবেক এই বিচারপতি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম কী জঙ্গলে বাস করবে? এটার প্রতিকার দরকার। জনগণকে জাগতে হবে। যদি প্রতিবাদ না হয়, সেমিনার না হয় তাহলে উত্তরণ সম্ভব নয়। জনগণকে জাগিয়ে দেয়া গেলে পুলিশ সাহস করবে না। তিনি বলেন, গায়েবি মামলা আসলে গায়েবি জানাজার সমান। একটি মানুষকে যদি দেশে থাকতে না দেয়া হয়, ঘরে থাকতে না পারে, তাহলে নির্বাচন তো দূরের কথা সে তার পরিবার-পরিজনকেই দেখতে পারবে না। সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে পারবে না। এমএ মতিন আরও বলেন, দেশে ভালো জজ আছে। কিন্তু তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, গায়েবি মামলা এক ধরনের মিথ্যা মামলা যেটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে করা হয়। কখনো এটি মিথ্যা মামলা কখনো এটি অতিরঞ্জিত করে করা হয়। অধিকাংশ মামলা করা হয় একেবারেই বানিয়ে। এই মামলাগুলো করে পুলিশ কিংবা তার সোর্স। সরকারি দলীয় নেতাকর্মীরাও এগুলো করছে। এই মামলা শুধুমাত্র বিরোধীদলের বিপক্ষে করা হয়। এতে বিপুল সংখ্যক লোককে আসামি করা হয়। এমন ঘটনাও হয় যে একজনকে ১২০ জন মিলিয়ে পিটিয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়া করা এবং ভীত সন্ত্রস্ত রাখা। এই মামলাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নির্বাচনের আগে বেশি বেশি করা হয়। তাহলে সরকারি দল অবাধে নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। এই ধরনের মামলা সরকারি দলের কারো উপর করা হয়েছে এমন নজির মেলেনি। তিনি বলেন, অধিকাংশ মামলা হয় নির্বাচনের আগে কিংবা বিরোধী দল বড় বড় কর্মসূচি দিলে। গত বছর নভেম্বর ডিসেম্বরে যখন বিরোধীদল কর্মসূচি দিচ্ছিল তখন অনেকগুলো গায়েবি মামলা দেয়া হয়। এই মামলাগুলোতে দুটো কারণে অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা শঙ্কায় থাকে যে, আমার নাম না থাকলেও এতে আমাকে যুক্ত করা যাবে। আবার পুলিশ যদি কাউকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে যদি কোন মামলা নাও থাকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি হিসেবে কোন একটা মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া যায়।

আসিফ নজরুল বলেন, ২০১৮ সালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম ২০ দিনে ৩৭৩৬টি মামলা দায়ের করে আইন শৃংখলা বাহিনী। এটা হাইকোর্টের তথ্য বানিয়ে বলার সুযোগ নাই। এতে আসামি করা হয় ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে। আসামিদের মধ্যে মৃত, বিদেশে থাকা এবং গ্রেপ্তার হওয়া লোকও ছিল। এই মামলায় আদালত মন্তব্য করে, এই ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী রিটটি আমলে নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশের আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। এসব গায়েবি মামলায় কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানাতে রুল জারি করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অপর বিচারপতি রিটটি আইন বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে তা খারিজ করেন।

জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের রেফারেন্স দিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৫০টি মামলা করা হয়, শুধু ঢাকা মহানগরে। ৪৫টি মামলাই করা হয় গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তখন বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ হচ্ছিল এবং প্রচুর লোকসমাগম হয়। এখানে ১৭০১ জনের নাম উল্লেখ করে ২৫৭৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলা যারা দায়ের করেছেন তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা। প্রত্যেকটা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হয়। এর মধ্যে ১৭টা মামলার মধ্যে দেখা যায় ১৫টা মামলায় আওয়ামী লীগের ওপর কোন হামলাই হয়নি। ককটেল বিস্ফোরণের কথাও শোনেনি এলাকাবাসী। আর দুটা মামলায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়। এলাকার প্রতিবেশী বলছেন, কে করেছে তারা জানেই না। সূত্রাপুর থানায় একজন মামলার বাদী বলছেন, উনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগ করলে পুলিশ আলামত হিসেবে ককটেল উদ্ধার করে। সেখানে বাদী জানায়, ককটেল বিস্ফোরণের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আরেকটি মামলার প্রসঙ্গে বলেন, ককটেল জব্দ তালিকার স্বাক্ষী বলেন, ককটেল বিস্ফোরণের কোন ঘটনা ঘটে নাই। বাদী কাগজে সই দিতে বললে তিনি দেন। এই মামলা করেছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা। প্রতিটা মামলার বিএনপির লোকেরা আওয়ামী লীগের ওপর হামলা করে, একপর্যায়ে ককটেল বিস্ফোরণ করেছে বলে বলা হয়।
গেন্ডারিয়া থানায় দায়ের হওয়া একটা মামলার প্রসঙ্গে বলেন, এজাহারে বলা হয় গেন্ডারিয়া থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি হামলায় আহত হন। কিন্তু তিনি নিজে গণমাধ্যমকে বলেন, ওই দিন তার উপর কোন হামলা হয় নাই। ৪৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উনার উপর হামলা হয়েছে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং মামলার বাদীকে চেনেন না বলে জানান। প্রত্যেক মামলায় ককটেল ঢুকানো হয়, কারণ বিস্ফোরক আইনের অধীনে মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় এবং জামিন অযোগ্য মামলা। দুই ধারার মামলা করা হয়। এগুলোর সর্বোচ্চ শাস্তি ১২ ও ২০ বছরের কারাদ-। আবার বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। এই কারণে এই মামলার আসামিরা ভীত থাকেন। কারণ গ্রেপ্তার হলে জামিন মিলবে না, দ্রুত সাজা হয়ে যেতে পারে। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গায়েবি মামলা করা হলে চলাচল, সমাবেত হওয়া, সভা সমাবেশ, বাক স্বাধীনতা নষ্ট হয়, জীবন জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে এবং নির্বাচনের সমতল ভূমি বিপর্যস্ত হয়। সংবিধান অনুযায়ী এই ধরনের মামলা প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবে না: দ্য ইকোনমিস্টকে ড. ইউনূস
কুমারখালীতে রাতের আঁধারে সড়কের অর্ধশতাধিক গাছ কর্তন
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
ধামরাইয়ে ২টি ড্রেজার মেশিন জব্দ
ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন হাফেজ কামরুল
আরও

আরও পড়ুন

রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো

রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো

জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়

জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

বিহারিরা কেমন আছে

বিহারিরা কেমন আছে

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

কিউবায় সমাবেশ

কিউবায় সমাবেশ