মোদির মদদে শক্তিশালী হচ্ছে মুসলিমদের ওপর সহিংসতার ঢেউ

ভারত ক্রমবর্ধমানভাবে কবরস্থান ও শেষকৃত্য ভূমি হয়ে উঠছে

Daily Inqilab দ্য গার্ডিয়ান

০৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:১২ পিএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

ভারতে গেল সপ্তাহে একটি মসজিদ জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এর ইমামকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একজন তরুণী ডাক্তার হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় একটি সশস্ত্র দল তাকে মারধর ও শ্লীলতাহানি করেছে। একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা ট্রেনে চড়ে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। সংঘটিত ঘটনাগুলো আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরের সাথে সম্পর্কহীন মনে হলেও, এর শিকাররা একটি ক্ষেত্রে অভিন্ন: তারা সকলেই মুসলিম। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশটির ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে মুসলিম সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাগুলি ক্রমশ ঘন ঘন হয়ে উঠেছে।

নরেন্দ্র মোদির শাসনের অধীনে উদ্বুদ্ধ ভারতের কট্টর হিন্দু চরমপন্থী গোষ্ঠী ভারতের মুসলিমানদের অব্যাহত নিপীড়ন এবং শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলিম বিরোধী ঘৃণামূলক বক্তৃতা এবং সহিংসতার জন্য গণহারে মুসলিম নিধনের আহ্বান জানিয়ে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মিছিল ও সমাবেশ করছে। বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমরা ‹অনুপ্রবেশকারী› হিসাবে অভিহিত হয়েছে, যারা ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৪শতাংশ, বৈষম্যমূলক নীতির সম্মুখীন হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারপরেও, ভারত যখন আগামী বছরে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, এই ধরনের সহিংসতা আরও খারাপ মোড় নিতে থাকবে, কারণ নির্বাচন জেতার উদেশ্যে বিজেপি দেশটির সমাজকে ধর্মীয়ভাবে আরও বিভক্ত করে তুলবে। যেমন, গত শুক্রবার বিজেপি-শাসিত রাজ্য মধ্য প্রদেশে ২৩ বছর বয়সী ফিজিওথেরাপিস্ট জারিন খান কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে চার হিন্দু পুরুষ তাকে ব্যাট এবং লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করে, তার হিজাব ছিঁড়ে ফেলে, তার শ্লীলতাহানি করতে শুরু করে এবং ধর্মীয় অবমাননা করে। তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে তারা সহাস্যে বলে, ‹তুমি কিছুই করতে পারবে না, প্রশাসন আমাদের।›

সোমবার ভোরে মোদি এবং আরকে কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা ও বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীযোগী আদিত্যনাথের নাম নিয়ে রেল কর্মকর্তা চেতন সিং মুম্বাইগামী একটি ট্রেনে চড়ে তিনজন মুসলিম পুরুষকে তাদের নাম ও দাড়ির মাধ্যমে চিহ্নিত করে গুলি করে হত্যা করেন। এটি ঘটানোর জন্য সিং প্রথমে তার উধ্বতন হিন্দু কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করেন। ঘটনার প্রচারিত একটি ভিডিওতে রক্তাক্ত একটি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে সিংকে বলতে দেখা যায়, ‹তারা পাকিস্তান থেকে কাজ চালায়।› সিং আরও হুমকি দেন, ‘তারা যদি ভারতে থাকতে চান তোদের অবশ্যই মোদি এবং যোগীকে ভোট দিতে হবে।’ নিহত এক মুসলিমের ভাই মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বলেন, ‹এটা পরিষ্কার যে তিনি মুসলিম ছিলেন বলেই তার ওপর হামলা হয়েছে। সরকার চাইলে এসব বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু তারা কি এটা বন্ধ করতে চায়? আমার এতে সন্দেহ আছে।›

এরপর, সোমবার গভীর রাতে হরিয়ানা রাজ্যের উপগ্রহ শহর গুরগাঁওয়ের নুহ এলাকাতে ১শ’ জনেরও বেশি কট্টরপন্থী হিন্দুদের একটি দল আঞ্জুমান মসজিদের ২২ বছর বয়সী ইমাম মোহাম্মদ সাদকে হত্যা করে এবং মসজিদটি পুড়িয়ে দেয়। সাদের ভাই আনোয়ার বলেন, ‹তার ওপর নৃশংসভাবে হামলা করা হয়েছে। তার বুক চিড়ে ফেলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি বুলেটের ক্ষত এবং গভীরভাবে কাটা ছিল, দেখে মনে হচ্ছে ছুরিকাঘাত। এমনকি তার হাতেও ছুরিকাঘাত ছিল। এর সবটাই ঘটেছে ভারতের রাজধানীর কাছাকাছি একটি শহুরে এলাকায় এবং পুলিশের উপস্থিতিতে।›

মসজিদ এবং মুসলিম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলাগুলোতে সহিংস হামলা সেদিনের আগের একটি ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে করা হয়েছে, যেদিন কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)’ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা নুহে তাদের বার্ষিক সমাবেশ করে, যাদের বিজেপির সাথে সম্পর্ক রয়েছে। সমাবেশে তারা সশ¯্র মিছিল বের করে মুসলিম বিরোধী ম্লেগান দিলে মুসলিমদের পক্ষ থেকে পাটকেলের আক্রমণের মুখোমুখি হয়। এটি দ্রুত সর্বাত্মক সহিংসতায় রূপ নেয়, তিনটি মসজিদ ভাংচুর করা হয় এবং দুই হিন্দু সরকারী কর্মকর্তা নিহত হন। কিন্তু, এত দাঙ্গার পরেও মুসলিম অধ্যুষিত শহরের হিন্দু মন্দিরটি ঠিকই অস্পৃশ্য রয়ে গেছে। ভিএইচপি এর সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র জৈন সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে একটি বক্তৃতায় বলেন যে, অঞ্চলটি হিন্দু ভূমি এবং মুসলিমদের গোহত্যাকারী, হিন্দু হত্যাকারী, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী এবং পাকিস্তানি গুপ্তচর হিসাবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দুরা শান্তিতে বিশ্রাম নেবে না, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।’

অবশ্য, হরিয়ানার বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের মতে, সংঘর্ষটি ছিল তাদের একটি ‘বড় ষড়যন্ত্র’, যারা তাদের ভিএইচপি মিছিলের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল। নুহের বেশ কয়েকজন অমুসলিম বাসিন্দা বলেছেন যে, তারা সর্বদা তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছেন এবং ভিএইচপির মিছিলকে বহিরাগতদের দ্বারা ইচ্ছাকৃত উস্কানি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এলাকাটির ৩৫বছর বয়সী সন্দীপ সিং বলেন, ‹তারা এখানে সমাবেশের নামে এসেছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল তারা মুসলিমদের উসকানি দিচ্ছিল। আমি যখন দলটির অনেককে তলোয়ার নিয়ে, কেউ কেউকে পিস্তল হাতে আসতে দেখলাম, আমার বাড়ির ভেতরে ছুটে পালাই। তারপর বাইরে গুলিবর্ষণ ও দাঙ্গা শুরু হয়।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘পুলিশ সংঘর্ষ শুরুর আগে ভিএইচপির মিছিলের ঠিক পিছনে হাঁটছিল।’

নুহের আশেপাশের শহরগুলোতে পরিবারগুলো জানিয়েছে যে, পুলিশ কয়েক ডজন মুসলিম যুবককে তাদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। এবং বৃহস্পতিবার রাজ্য কর্তৃপক্ষ সরকারি জমি দখলের অভিযোগে বৃহত্তর দরিদ্র অভিবাসী মুসলিম পরিবারগুলোর কয়েকশ বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে হিন্দু ডানপন্থী নেতারা মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোতে এবং মানেসারের কাছের একটি গ্রামে আরও সহিংসতার আহ্বান জানিয়েছেন। ভিএইচপি নেতারা অন্য একটি সভায় মুসলিমদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলাকা ছেড়ে চলে যেতে সতর্ক করেছেন। এরপর শীঘ্রই এই সংঘাত বহুজাতিক প্রযুক্তি কেন্দ্র এবং কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কেন্দ্রশহর গুরগাঁওয়ে আরও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে খোলা জায়গায় নামাজ পড়ার অপরাধে মুসলিমরা দীর্ঘদিন যাবৎ হয়রানির শিকার হচ্ছে।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে মসজিদের পাশাপাশি, মুসলিম রেস্তোরাঁ, দোকান এবং বাড়িঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং গুরগাঁওয়ে বসবাসকারী অভিবাসী মুসলিম পরিবারগুলোকে হিন্দুত্ববাদীরা হুমকি দিচ্ছে অবিলম্বে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের অস্বীকার করা হচ্ছে। দিল্লির সেন্টার ফর ইক্যুইটি স্টাডিজের সদস্য নীরা চন্দোকে বলেছেন, ‹এই সরকার ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই ধরনের সহিংসতা লক্ষণীয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে। আমাদের সমাজে যা ঘটছে, তাতে আমি ভীত। আমার দুশ্চিন্তা হল, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে, এটি আরও কবরস্থান ও শেষকৃত্য ভূমি হয়ে উঠবে।’


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবে না: দ্য ইকোনমিস্টকে ড. ইউনূস
কুমারখালীতে রাতের আঁধারে সড়কের অর্ধশতাধিক গাছ কর্তন
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
ধামরাইয়ে ২টি ড্রেজার মেশিন জব্দ
ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন হাফেজ কামরুল
আরও

আরও পড়ুন

রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো

রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো

জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়

জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন

বিহারিরা কেমন আছে

বিহারিরা কেমন আছে

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি

কিউবায় সমাবেশ

কিউবায় সমাবেশ