ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ
১২ আগস্ট ২০২৩, ১১:২১ পিএম | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
মদিনা মুনাওয়ারায় মসজিদে নববী সংলগ্ন তিনটি জাদুঘর ও প্রদর্শনী বিদ্যমান। এর মধ্যে একটি বিশেষায়িত মসজিদে নববী নির্মাণের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কিত। আরেকটি নবী করীম (সা.)-এর সিরাতের ওপর। জাদুঘর ও প্রদর্শনী তিনটি মাত্র কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতঃপূর্বে আমরা শুনে এসেছি, মক্কা-মদিনার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে র্শিক-বিদআত আবিষ্কার এবং এগুলো বিলুপ্ত করার একটা প্রবণতা সউদী আলেমদের পেয়ে বসেছিল। সে কারণে মদিনায় নবীজির স্মৃতিবাহী কুয়াসমূহ, নবীজির প্রথম আবাসস্থল বাবে জিব্রিল সংলগ্ন হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়ি, জান্নাতুল বাকীতে শীর্ষ সাহাবিদের কবরের চিহ্ন প্রভৃতি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এর পেছনে সউদী আলেমগণের যুক্তি থাকতে পারে; তবে আমাদের সামনে কুরআন মজীদের একটি আয়াত আছে যার মর্মবাণী আল্লাহর মহিমা প্রকাশের নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের তাগাদা দেয়। আয়াতটি হলো:
‘ইহাই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে তা তো তার হৃদয়ের তাকওয়ার বহিঃপ্রকাশ’। -(সূরা হজ, আয়াত-৩২)
কোনোরূপ বিতর্কে না জড়িয়ে বলব যে, সউদী আরব বর্তমানে মসজিদে নববী এলাকায় জাদুঘর ও প্রদর্শনী স্থাপন এবং মসজিদের দোতলায় সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপন করে প্রমাণ করেছে যে, তারা সংকীর্ণ মনোভাবের ঊর্ধ্বে, ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্মারকগুলো সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। কোনো জাতির ইতিহাসকে একটি বৃক্ষের শিকড়ের সাথে তুলনা করা যায়। শিকড় যত মজবুত ও দৃঢ় হয় বৃক্ষটি ঝড়তুফানের মোকাবিলায় ততই মজবুত লড়াকু হয়। অনুরূপ যে জাতির ইতিহাস যত সমৃদ্ধ, গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ হয় বিশ^ সমাজে সেই জাতির উপস্থিতি ততই বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় হয়। কুরআন মজীদের বিশাল অংশজুড়ে অতীত জাতিসমূহ ও নবী রাসূলগণের ইতিহাস বর্ণনার হাকিকত এখানেই নিহিত।
একটি বিশাল দালানের নিচের গাঁথুনি ও পাইলিং যত গভীর ও মজবুত হয় দালানের স্থায়িত্বও তত মজবুত হয়। গাঁথুনিবিহীন দালান বা শিকড়হীন বৃক্ষ যেমন ঝড়ের ঝাপটায় টিকে থাকতে পারে না তেমনি সমৃদ্ধ অতীত ও ইতিহাস বিহীন জাতিও সভ্যতা ও রাজনীতির সংঘাতে নিজের অস্তিত্ব অবিচল রাখতে পারে না। এ জন্যেই বিশে^র উন্নত জাতিসমূহ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার ও জাদুঘরের পেছনে অকল্পনীয় মাত্রায় অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। আবার যদি নানা গবেষণার দোহাই দিয়ে কোনো জাতির ইতিহাস বিকৃত করতে পারে বা জাতীয় ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে তার প্রভাবে জাতির মধ্যে বিভাজন ও হানাহানি লাগিয়ে দেয়া সম্ভব। মুসলমানদের ইতিহাস গবেষণায় বিজাতীয়দের ঘুম হারাম হওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য এটাই। দুঃখজনক সত্য হলো, বিজাতীয়রা যেখানে প্রতœতাত্মিক নিদর্শন গবেষণায় নিজেদের অর্থ ও প্রতিভা উজাড় করছে সেখানে মুসলমান সমাজে এক শ্রেণির শায়খ তথাকথিত শিরক বিদআতের জিকির তুলে ইসলামের নিদর্শনসমূহ ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর।
যাই হোক মদিনা মুনাওয়ারায় জাদুঘর ও প্রদর্শনা স্থাপনে সউদী সরকারের দূরদর্শী পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই, সাধুবাদ জানাই।
আসলে চার দেয়ালের জাদুঘর বা প্রদর্শনী নয়, পুরো মক্কা মদিনাই বিশাল বিস্তৃত জাদুঘর এবং দুনিয়াবাসীর সামনে ইসলামের সত্যতার জীবন্ত প্রদর্শনী। সউদী সরকার যদি আরো একটু উদারতার পরিচয় দেন, এক শ্রেণির আলখেল্লাধারীর মনের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসেন তাহলে অন্যান্য জাতির সামনে ইসলামের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য তুলে ধরা সম্ভব হবে এবং মক্কা ও মদিনা বিশ^বাসীর হেদায়তের বাতিঘর হিসেবে আলো বিকিরণ করবে।
আমাদের মতে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত মক্কা নগরি ও কাবাঘরের পরিচয় ও গুরুত্ব সম্বলিত আয়াত ও বাণীগুলো বিলবোর্ডের মাধ্যমে অথবা শিল্পির তুলির আঁচড়ে ক্যালি’গ্রাফির মাধ্যমে তরজমাসহ দর্শনীয় স্থানগুলোতে স্থাপন করা যেতে পারে। সাফা ও মারওয়ার কথা কুরআন মজীদে আছে। সেই আয়াতটি সাফায় ওঠার সময় স্ক্রিনে দেখা যায়। কিন্তু সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে ৭ বার হাঁটতে বা সবুজ বাতি চিহ্ণিত স্থান কেন দৌড়ের গতিতে পার হতে হবে কেউ জানে না। জানানোর ব্যবস্থা আছে কিনা তাও অজানা।
ইব্রাহীম (আ.) স্ত্রী হাজেরাকে শিশুপুত্র ইসমাঈলসহ কাবাঘরের স্থানে রেখে গিয়েছিলেন আল্লাহর হুকুমে। সামান্য পানি ও খেজুর শেষ হওয়ার পর বুকের দুধও শুকিয়ে যায় হাজেরার। শিশুর জীবন বিপন্ন দেখে পানির আশে সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে দৌড়িয়েছিলেন। বর্তমান সবুজ বাতি চিহ্ণিত স্থানটি ছিল নিচু। সাফা ও মারওয়ার মাঝে আসা-যাওয়ার সময় হাজেরার দৃষ্টি থাকত খোলা জায়গায় রেখে আসা শিশু ইসমাঈলের দিকে। নিচু স্থানে নামলে শিশুকে দেখা যেত না তাই তিনি দৌড়ে পার হতেন। আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পন করে মা হাজেরা এমন চরম পরীক্ষার সম্মুখীন ও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তার এই চেষ্টা, হাঁটা ও দৌড়ানো আল্লাহর পছন্দ হয়। সে কারণে হাজেরার অনুকরণে পরবর্তী যত নবী রাসূল ওলি, আলেম, দ্বীনদার মুসলমান হজ করতে এসেছেন তাদের সাফা মারওয়ায় দৌড়াতে হয়েছে, দৌড়াতে হবে কেয়ামত অবধি।
ইসলাম নারী জাতিকে কতখানি মর্যাদা দিয়েছে সাফা মারওয়ার সায়ী তার অন্যতম প্রমাণ। দুঃখজনক হলো, এই ইতিহাস জানার বা জানানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। হজের মূল কার্যক্রম আরাফাত মুযদালিফা মীনায়। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কিত বহু আয়াত ও হাদিসে বিস্তর বর্ণনা আছে। এই বর্ণনাগুলো সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড আকারে শোভা পেতে পারত। ৩০ লাখ মানুষের মুখে যদি নিখুঁতভাবে খাবার ও পানি পৌঁছানো সম্ভব হয় কুরআন ও হাদিসের বাণী ও ইতিহাস পুস্তক আকারে পৌঁঁছানো কি অসম্ভব হবে।
মীনায় হজের আগে একদিন ও পরে তিন দিন অবস্থান করতে হয়। চারদিনের অবস্থানকালীন দু’টি কাজ মীনায় আঞ্জাম দিতে হয়। একটি কুরবানি অপরটি শয়তানকে পাথর মারা। কুরবানি এখন কৃত্রিম হয়ে গেছে। এখন ব্যাংকে টাকা জমা দিলে বা হজ এজেন্সির অদৃশ্য লোকদের হাতে টাকা জমা দিয়ে কুরবানির এতবড় ইবাদতকে অবহেলা করা হয়। কারণ কুরবানির জায়গা নিয়ে যাওয়া হয়েছে মীনার সীমানার বাইরে। প্রশ্ন হলো, হাজীরা নিজ হাতে কুরবানি দেয়ার ইবাদতটি পালন করার মতো পরিবেশ কী সউদী সরকার চাইলে সৃষ্টি করতে পারে না। শয়তানকে পাথর মারার জন্য তিন দিন মীনায় বসে বসে কাটানোর উদ্দেশ্য কী। মানুষ যাতে আত্ম-পর্যালোচনা করে এবং জীবন সংগ্রামে শয়তানকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে।
যে তিন জায়গায় পাথর মারতে হয় তার নাম জামারা। উপমহাদেশের লোকেরাই জামারাকে শয়তান বলে অভিহিত করে। তিন জামারায় পাথর কেন মারতে হবে তার ইতিহাস হাদিসে আছে। ইব্রাহীম (্আ.) স্বীয় পুত্রকে যেভাবে জবাই করতে যাচ্ছিলেন তার ইতিহাস তো সূরা সাফফাতে কুরআন মজীদে আছে। এ সময় শয়তান তিন জায়গায় বা মা হাজেরা পুত্র ইসমাঈল ও স্বয়ং ইব্রাহীম (আ.) তিন জনকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। তিন জামারার পেছনে এই ইতিহাস মানুষকে জানতে দিলে শিরক বেদাতের কোনো প্রসঙ্গ আসবে কিনা মদিনা ইউনির্ভাসিটির শিক্ষক ছাত্রদের কাছে জানতে চাই।
মক্কা ও মদিনায় দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শনে নিয়ে গিয়েছিলেন হজ এজেন্সির লোকেরা। মক্কায় গারে হেরা, গারে সউর, নহরে জুবাইদা, জবলে রহমত, তায়েফ এবং মদিনায় মসজিদে কুবা, মসজিদে যুল কিবলতাইন, খন্দক যুদ্ধের সাত মসজিদ, আরাফাতে জবলে রহমত প্রভৃতি। এসব স্থান ইসলামের ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী ও প্রত্যেকটির পেছনে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু এসবের বর্ণনা সম্বলিত কোনো সাইনবোর্ড আমাদের নজরে আসেনি।
হাদিস-কুরআন ও ইতিহাসের পাতা থেকে এ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সাইনবোর্ড বা পুস্তক আকারে তুলে ধরা উচিত ছিল। তবে সরকার কোনো কোনো স্থানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করছেন বলে কিছু আলামত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আশা করি আমাদের প্রস্তাবগুলো এর সঙ্গে সংযোজিত হবে।
মদিনায় পৌঁছার প্রথম দিন আল বারাকা ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস এর স্বত্বাধিকারী কামাল ভাই মসজিদে নববীর পশ্চিম দিকে বর্ধিত আস্তর-করা মাঠের মাঝখানে এক টুকরা বাগান দেখালেন। তাতে মদিনার ঐতিহ্যের স্মারক খেজুর গাছসহ একগুচ্ছ সবুজের সমারোহ। বললেন, এই জায়গাটুকু ‘সকীফায়ে বনি সায়েদার স্থান। নবী করিম (সা.)-এর ওফাত লাভের পর আনসার ও মুহাজীরগণ এখানে সমবেত হয়েই হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে খলিফা নির্বাচন করেছিলেন। অবশ্য এর কোনো বর্ণনা কোথাও লেখা ছিল না।
তবুও মনটা আনন্দে ভরে উঠল এবং এই আশাবাদের সঞ্চার হলো যে, সউদী আরবে ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এখন অনেক উদার ও দূরদর্শী এবং মুসলিম উম্মাহর মনের কথাগুলো পড়ার ও বুঝার চেষ্টা করছেন। তাদের এই চিন্তা ও উদ্যোগের প্রতি আমরা প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড
গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক
জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ
বিহারীরা কেমন আছে