নকশার গলদেই বিপর্যয়
১৪ আগস্ট ২০২৩, ১১:১৪ পিএম | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৫ এএম
বন্যায় চালুর আগেই ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজার রেললাইন : রাখা হয়নি স্বাভাবিক পানি প্রবাহের ব্যবস্থা : ১৮ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে অদূরদর্শিতার ছাপ
চালুর আগেই দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের একাংশ পাথর ও মাটি সরে গিয়ে ধসে যাওয়ার কারণ হিসেবে অদূরদর্শী ও অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণ এবং নকশায় ত্রæটি থাকার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অবকাঠামো নির্মাণে গুণগতমানও অক্ষুণœ রাখা হয়নি। সর্বক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়েছে অদূরদর্শিতার ছাপ। দেশের উপক‚লীয় এলাকায় প্রথমবারের মতো রেললাইন নির্মাণ করতে গিয়ে পাহাড়ি ঢল ও বন্যার স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আর এ কারণে অতিবর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে নবনির্মিত রেললাইনটিতে এমন বিপর্যয় নেমে এসেছে। নতুন এ রেলপথ দক্ষিণ চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক নজিরবিহীন বন্যার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। প্রকল্প সংশোধন না হলে প্রতি বর্ষায় দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রবল বন্যা এবং সেই সাথে সহায়-সম্বলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা প্রকট হচ্ছে।
চলতি আগস্ট মাসের শুরু থেকে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে বন্যা দেখা দেয়। এতে সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকায় বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে যায়। পানির স্রোতে ওই এলাকার প্রায় দেড় কিলোমিটার রেললাইনের নিচ থেকে পাথর ও মাটি সরে যায়। এরপর রেললাইন উঁচু-নিচু ও বাঁকা হয়ে যায়। এ পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। স্থানীয়রা বলছেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক (আরাকান রোড) কয়েকশ বছরের পুরোনো। কিন্তু ওই মহাসড়কের কারণে সড়কের দুই পাড়ে কখনও পানিবদ্ধতা বা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। কারণ মহাসড়ক নির্মাণে পাহাড়, টিলাময় ওই এলাকায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা হয়নি।
কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে। ওই অঞ্চলে পানির স্রোত ও পাহাড়ি ঢল পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী। আর রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে উত্তর ও দক্ষিণমুখী। এতে নতুন রেললাইন পানির স্রোতের মুখোমুখি হয়ে চাপ নিতে ব্যর্থ হয়। কারণ রেললাইন নির্মাণকালে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক খাল, নালা, ছরা হয় আটকে দেয়া হয়েছে অথবা ব্রিজ-কালভার্ট বানিয়ে সংকুচিত করা হয়েছে। পানির চাপ সামাল দিতে ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানিনিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণে প্রবল বন্যায় রেললাইন ধসে গেছে এবং সেই সাথে রেললাইনের কারণে পানি প্রবাহ আটকে গিয়ে আশপাশের লোকালয়গুলোকে বানের পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে।
স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞদের মতে, যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রæত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। রেললাইন নির্মাণের সময় তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার ছিল। এখন রেললাইন করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। তাতে বিস্তীর্ণ জনপদের সহায়-সম্বলের যেমন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তেমনি রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রকল্প থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কক্সবাজার থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার অংশের কাজ বন্ধ রাখা হয়। প্রথমে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময়সীমা ঠিক করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। পরে দুই বছর সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কক্সবাজারমুখী রেল চলাচল চালুর ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে সরকারি তরফে। তবে ৩০ বছরের রেকর্ড বৃষ্টিতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় রেললাইনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
যদিও রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে। সম্প্রতি বন্যা কবলিত সাতকানিয়া সফর করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এমপি। এ সময় তার কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, নতুন রেল লাইনে পর্যাপ্ত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ না করায় বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রকল্প সংশোধন করে পর্যাপ্ত রেলব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ করা হবে কিনা? জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জনগণ চাইলেই সব কিছু করা যাবে না। রেললাইন একটি মেগা প্রকল্প। এটি নির্মাণের জন্য দক্ষ জনবল কাজ করছে। টেকনিক্যাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
চালুর আগে রেললাইনে এমন বিপর্যয়ের কারণ কী তা নিয়ে চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত রেললাইন নির্মাণসহ নানা অনিয়মের কারণে এমন বিপর্যয় হয়েছে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ও বিশিষ্ট পানি প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ড. রিয়াজ আকতার মল্লিক বলেন, পাহাড়ি ঢলে রেললাইনের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ হিসেবে নকশায় ত্রæটি বিশেষ করে হাইড্রোলিক ডিজাইনে গলদ ছিল বলা যায়। কারণ এ ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ওই এলাকার অতীতের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বৃষ্টিপাতের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া প্রকল্প এলাকায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে প্লাবিত হয়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক সময় নকশা ঠিক থাকলেও রেললাইনে ব্যবহৃত নির্মাণ সামগ্রীর মান অক্ষুণœ না রাখার কারণেও এরকম অবস্থা হতে পারে। তাছাড়া দুর্বল অবকাঠামোর কারণেও রেললাইন ধসে যাওয়া এবং দেবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারমুখী রেললাইন প্রকল্প বিশে^র সবচেয়ে ব্যয়বহুল। তিন দিনের বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে এ মেগা প্রকল্পের একাংশ ধসে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলছিল। মূলত এর মাধ্যমে মেগা প্রকল্পে মেগা লাভ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের এমন দুরাবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবে বাস্তবে তার কিছুই হবে না। হয়তো দেখা যাবে এ প্রকল্প সংশোধনের জন্য ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেয়া হবে। তাতে প্রকল্প কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হবে। আর দক্ষিণ চট্টগ্রামে মানুষের দুর্ভোগ বন্যার কবল থেকে রেহাই মিলবে না।
প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান এই মেগা প্রকল্পে নির্মাণ ত্রæটি কিংবা নকশায় গলদ থাকার বিষয়টি সঠিক নয় দাবি করে বলেন, যারা এমনটি বলছেন, তারা না জেনেই মন্তব্য করছেন। কারণ আগামী ১০০ বছরের বৃষ্টি, বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে রেললাইন এলাকায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ করার বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। তার দাবি, রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণেই সাতকানিয়ার কিছু অংশে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামত করা যাবে এবং নির্ধারিত সময়ে রেল চলাচল শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
হাজারো বিঘা জমিতে পুকুর খনন: ছোট হয়ে যাচ্ছে সালথা-নগরকান্দার মানচিত্র!
প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান, সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবি
শুধু মুর্শিদাবাদ-মালদহ নয়, শিলিগুড়িও লক্ষ্যবস্তু , রাফালের আগমনে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
হাসিনাকে ফেরত আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন
আসাদের পতন, নিজের বেঁচে থাকার গল্প বললেন এক সিরিয়ান শরণার্থী
গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক
বঙ্গতে আসছে 'ফ্যামিলি ফিউড বাংলাদেশ'
সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন
পানামা খাল দখলের হুমকি ট্রাম্পের, ভর্ৎসনা পানামার প্রেসিডেন্টের
কুমিল্লায় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তার ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার নিন্দা
পাবনা-৩ এলাকায় অ্যাডভোকেট রবিউলের গণসংযোগ ও কম্বল বিতরণ
পান্থকুঞ্জ ও আনোয়ারা পার্ক নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
নারী পুলিশের দিকে তাকিয়ে আসামির হাসি, নেটদুনিয়ায় তোলপাড়
জার্মানির ক্রিসমাস মার্কেটে হামলায় ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুতে শোকের ছায়া
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
গ্রেপ্তারের ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
নাটোরে ৬ ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত ২, আহত ৭
রাখাইনের অস্থিরতায় টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি কমেছে ৯০ ভাগ
ক্রিসমাস মার্কেট হামলা, জার্মান কর্তৃপক্ষের কাছে গত বছরেই এসেছিল সতর্কবার্তা