ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
ইসির অফিস সহায়ক পদের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি

মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম

দেড় কোটি টাকার চুক্তিতে পরীক্ষা না দিয়েই পাস ১৪ প্রার্থী
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘অফিস সহায়ক’ পদে নিয়োগের এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষা না দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার অভিযোগে ১৪ জন প্রার্থীকে আটক করেছে নির্বাচন কমিশন। এ জালিয়াতির ঘটনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. নাজমুল কবীর মোট আটটি মামলা করেছেন। নির্বাচন কমিশনের করা মামলাগুলোর কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে ১৪ নিয়োগপ্রার্থী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা তাঁদের স্বীকারোক্তিতে এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নাম ও মুঠোফোন উল্লেখ করেছেন। কত টাকার চুক্তি হয়েছে, কত টাকা দিয়েছেন, তা ও তারা বলেছেন। তবে জালিয়াতে যুক্ত এসব ব্যক্তির কেউ এখনো ধরা পড়েননি।

১৪ নিয়োগপ্রার্থীর স্বীকারোক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য তারা মোট ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। এর মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ টাকা পরিশোধও হয়েছে। কোনো কোনো প্রার্থী সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

এ বিষয়ে নাজমুল কবীর বলেন, ‘নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও যেসব চাকরিপ্রার্থী টাকার বিনিময়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, এমন ১৪ জনকে আমরা ধরেছি। তাঁদের আটক করে পুলিশে দিয়েছি। মামলা করেছি। এমন আরও কেউ আছেন কি না, তা শনাক্তের কাজ চলছে। এ ছাড়া এর সাথে যারা জড়িত আছেন তাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।’

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, অফিস সহায়কের ১৭৮টি পদে লোক নিয়োগের জন্য ৩ বছর আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আবেদনের ন্য‚নতম যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক পাস। এই পদে নিয়োগ পেতে অনলাইনে ১ লাখ ৩১ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেন। রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ৩১ মার্চ। নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে লিখিত পরীক্ষা হয় গত ১৯ মে। নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় জুলাই থেকে। মৌখিক পরীক্ষা চলমান আছে।

নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া কিছু প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। এমন নিয়োগ প্রার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। এভাবে ১৪ নিয়োগপ্রার্থী ধরা পড়েন। তারা প্রত্যেকে লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। তারা বলেন, তারা টাকা দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের হয়ে অন্য কেউ নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষা না দিয়েই উত্তীর্ণ হওয়া একজন প্রার্থী দিনাজপুরের মোবারক হোসেন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে তিনি গত ২০ জুলাই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে হাজির হন। মৌখিক পরীক্ষার নিয়োগ বোর্ডে তিনি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। তখন নিয়োগ বোর্ডের সন্দেহ হয়। বোর্ডের সদস্যরা মোবারককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। একপর্যায়ে মোবারক বলেন, স্যার, আমি কোনো (এমসিকিউ-লিখিত) পরীক্ষা নিজে দিইনি। আমার হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষা দিয়েছেন।

মোবারক লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে এই জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। লিখিত স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষায় নিজে অংশ নেবেন না, কিন্তু উত্তীর্ণ করিয়ে দেবেন, এমন শর্তে তিনি এক ব্যক্তির সঙ্গে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, তিনি এমসিকিউ ও লিখিত কোনো পরীক্ষায় নিজে অংশ নেননি। তার হয়ে অজ্ঞাত কেউ অংশ নিয়েছেন। এভাবে উভয় পরীক্ষাতেই তিনি উত্তীর্ণ হন। তিনি ইতিমধ্যে চুক্তির সাড়ে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ২০ জুলাই মোবারকের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে নির্বাচন কমিশন। মামলায় মোবারকের ভাই মোবাশ্বেরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। মোবাশ্বেরুল নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (ইটিআই) মালি পদে কর্মরত। পরে নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ মোবারক ও মোবাশ্বেরকে পুলিশে সোপর্দ করে।

মোবারক লিখিত স্বীকারোক্তির তথ্যে বলেছেন, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি রাজু নামের একজনের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন। ধরা পড়া আরেক নিয়োগপ্রার্থী হাফিজুর রহমান তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, পল্লব হোসেন ও সোহাগের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দেন। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি এই পরীক্ষা দেন। নিয়োগপ্রার্থী পলাশ চন্দ্র তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, বাচ্চু ও ফারুকের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেন। সেই ব্যক্তির সঙ্গে ১৬ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। নিয়োগপ্রার্থী ন‚র মোহাম্মদ তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, শাহাজাহানের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দেন। সেই ব্যক্তির সঙ্গে তার সাত লাখ টাকার চুক্তি হয়। আবদুল্লাহ নামের নিয়োগপ্রার্থী তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, মোতালেবের মধ্যস্থতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দেন। ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। তিনি ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন। নিয়োগপ্রার্থী তরিকুজ্জামান তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, রংপুরের ন‚র নবী ও সরোয়ারের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ইতিমধ্যে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। সিরাজগঞ্জের সাথী খাতুন নামের নিয়োগপ্রার্থী স্বীকারোক্তিতে বলেন, জয়নাল ও নাজিমের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেন। এ জন্য আট লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। তিনি ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। কুড়িগ্রামের রকিবুল ইসলাম নামের নিয়োগপ্রার্থী তার স্বীকারোক্তিতে বলেন, শামসুল আলমের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার হয়ে পরীক্ষা দেন। ১৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। বরিশালের নিয়োগপ্রার্থী শাহ আলম বলেন, তার হয়ে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি চুক্তির ১০ লাখ টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁওয়ের নিয়োগপ্রার্থী জহিরুল ইসলাম ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন। ১৪ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন কুড়িগ্রামের রতন কুমার। পটুয়াখালীর শাকিল উদ্দিন ১৪ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেন। ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন নীলফামারীর মশিউর রহমান। রিপন ইসলাম পাস করেছেন ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে।

 

 

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা