‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ আতঙ্কে সারাদেশ
১৯ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ২০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
কোন ধরনের অস্ত্র কিংবা ভয়ভীতি না দেখিয়েই টার্গেট ব্যক্তির সব কিছু লুটে নিতে অপরাধীরা এখন ব্যবহার করছে স্কোপোলামিন বা ভয়ঙ্কর ডেভিলস ব্রেথ। যা শয়তানের নিঃশ্বাস নামে পরিচিত। পাউডার কিংবা তরল জাতীয় এ পদার্থ কোনোভাবে কারও নিঃশ্বাসে নিতে পারলেই ভুক্তভোগী সম্পূর্ণরুপে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান। তাদের কথামতোই রোবটের মতো কাজ করেন। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন ডেভিল ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস জাতীয় পদার্থ দিয়ে অপরাধীরা সাধারণের সর্বস্ব লুট করছে। মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টিসহ বিভিন্ন চক্রের পর সারা দেশে এটি এখন এক আতঙ্কের নাম। এর প্রয়োগে ১৫ মিনিট থেকে ৩দিন পর্যন্ত মানুষ তার নিয়ন্ত্রনের বাইরে থাকেন। প্রতারণার জন্য নতুন আসা ডেভিল ব্রেথকে অনেকে নেশা কিংবা মাদক দ্রব্য বললেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, এটি মাদক হিসেবে অন্তভূক্ত নয়। এটি কোনো ওষুধ কিনা সেটিও তারা নিশ্চিত করছে না। সূত্র বলছে, ২০১২ সাল থেকে এটি দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত দেশের ৩২ জেলায় সাধারণ মানুষ শয়তানের নিঃশ্বাসের শিকার হয়ে টাকা পয়সা খুঁইয়েছেন। এ ধরনের প্রতারক চক্রে বিদেশিরাও জড়িত। পুলিশ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর বলছে এটি নিয়ে গবেষনার সময় এসেছে। তবে আপাতত জনসাধারণকে এটির অপব্যবহার করে কেউ যাতে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য সকলকে সচেতন হতে হবে।
কেস স্ট্যাডি (এক) ঃ ভুক্তভোগীর নাম প্রিয়া আক্তার। রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী। ঘটনাটি গত বছরের ১১ অক্টোবরের। ওইদিন বিকেলে স্থানীয় বাজারে বিকাশ থেকে টাকা তুলে পায়ে হেঁটে ফিরছিলেন বিনোদপুরের বাসায়। রেলগেট এলাকায় এক যুবক তার মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে প্রিয়ার কাছে আর্থিক সাহায্য চায়। তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এরই মধ্যে আরও এক যুবক সেখানে আসেন। প্রিয়া বলেন, আমি সেখান থেকে চলে আসার সময় আরও এক যুবক এসে আমার মুখের সামনে জাষ্ট এক টুকরো কাপড় ধরে। এর পরই আমি সব শুনতে পারছিলাম, দেখতে পারছিলাম কিন্তু আমার মধ্যে যেন নিজস্ব কোন সেন্স কাজ করছিল না। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। আমিও বিনা বাক্যে হেঁটে হেঁটে তাদের সঙ্গে চলে যাই। প্রিয়া বলেন, আমি তাদের কথামতো আমার সবকিছু স্বেচ্ছায় দিয়ে দেই। সবকিছু নেয়ার পর তারা আমাকে বলে, আপনি সোজা যান। সোজা মিষ্টি বাড়ি দোকানের সামনে যাবেন। তখন আমি তাদের কথামতো সোজা হেঁটে মিষ্টি বাড়ি দোকানের সামনে যাই। পেছনে একবারের জন্যেও তাকাইনি। মিষ্টি বাড়ি দোকানের সামনে আসার পর আমার কিছুটা বোধশক্তি কাজ করে। আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে গেলে দেখি ব্যাগে ফোন নেই। তখন আমি বুঝতে পারি যে আমার সবকিছু নিয়ে গেছে তারা।
কেস স্ট্যাডি (দুই)ঃ গত ৪ আগস্ট বিকেলে বগুড়ার শিবগঞ্জের উপজেলা সদরে হৃদয় টেলিকম নামে একটি দোকানে ঢুকে পড়ে একটি চক্র। তারা অডিট করবেন মিথ্যা অযুহাতে দোকানে সময় ক্ষেপন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা প্রতিষ্টানের মালিক দুলাল মিয়া ও দোকানে থাকা তার ভাগ্নের চোখে কিছু একটা লাগিয়ে দেন। এরপরই তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। পরে প্রতারকদের কথামতো ক্যাশবা´্র থেকে প্রায় এক লাখ টাকা বের করে দেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর দুলাল ও তার ভাগ্নের সম্বিৎ ফিরলে তারা প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। এ ঘটনায় মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ দুই ইরানি নাগরিককে গ্রেফতার করে।
কেস স্ট্যাডি (তিন)ঃ গত ৮ এপ্রিল অভয়নগর উপজেলার বর্ণী হরিশপুর বাজারে জালাল মোল্লার মার্কেটের শরিফুল ইসলামের মরিয়ম স্টোরের সামনে প্রাইভেটকার থামিয়ে নারিকেল তেল চান এ চক্রের সদস্যরা। এ সময় দোকান মালিক শরিফুলের বাবার সঙ্গে তাদের একজন হ্যান্ডশেক করার পরই বিদেশি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যান তিনি। যা বলে তাই শুনতে থাকেন শরিফুলের বাবা। একপর্যায়ে দোকানে থাকা মোবাইল ব্যাংকিং-এর নগদ প্রায় ছয় লাখ টাকা নিয়ে চম্পট দেন প্রতারকরা।
কেস স্ট্রাড (চার)ঃ রাজধানীর পল্লবীর ১২ নম্বরের ডিওএইচএস কমপ্লেক্সের পি অ্যান্ড জেড ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন জিসান (২১)। গত ২১ জানুয়ারি বিকালে দুজন ইরানি নাগরিক এসে তার কাছে বিমানের টিকিট কিনতে চান। কথা বলতে বলতে ওই দুই ইরানি নাগরিক জিসানের ক্যাশ বাক্স থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা বের করেন। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছিলেন জিসান। একপর্যায়ে টাকা ব্যাগে ভরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান ইরানিরা। এর কয়েক মিনিট পর জিসান বুঝতে পারেন তার দোকানে চুরি হয়েছে। জিসানের বক্তব্য-‘আমার চোখের সামনেই ক্যাশ থেকে টাকা বের করল। আমি সবই দেখছিলাম। কিন্তু তাদের থামাইনি। এমন মনে হচ্ছিল, আমিও তাদের একজন। তাই তাদের সহযোগিতা করছি।’
সম্প্রতি ফরিদপুর শহরে আলেয়া বেগম স্বামীকে নিয়ে ব্যাংক থেকে পেনশনের টাকা তুলে বাড়ি ফিরছিলেন। অটোরিকশায় উঠার কিছুক্ষণের মধ্যে চালকের আরেক সহযোগী উঠে ঐ অটোরিকশায়। এরপর ছলেবলে কৌশলে তাদের কাছে থাকা কাগজে মোড়ানো নেশাদ্রব্য নাকের কাছে নিয়ে শুকিয়ে তাকে স্মৃতিভ্রম করেনেন। এরপর তাদের কথামতো তিনি নিজেই প্রতারকদের হাতে খুলে দেন তার গলায় থাকা সোনার চেন, কানের দুল, হাতের আংটি।
পল্লবীর মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেশে এ ধরনের ৮-১০টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রতি গ্রুপে দুই থেকে তিনজন করে সদস্য আছে। এসব চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে ইরানি নাগরিকরা। এ ধরনের একাধিক ঘটনার অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযানে নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনি। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে ইরানি নাগরিকসহ বেশ কয়েকজন ধরাও পড়েছে।
পল্লবীর ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশ বলছে, শয়তানের নিঃশ্বাস সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা ছিল না। তদন্তের একপর্যায়ে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে প্রতারকদের গাড়ি শনাক্ত করি।
এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, স্কোপালামিন নামে ভয়ংকর মাদক ব্যবহার করা হয় একাজে। শয়তানের শ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই মাদক মস্তিস্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। অন্যের দেয়া আদেশকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয় স্বেচ্ছায়। তারা নিজে কিছু চিন্তা করতে পারেন না শুধু সামনের লোক যা বলবে তাই করেন রোবটের মত। ফলে দুর্বৃত্তরা লোকজনকে সর্বস্বান্ত করতে মোক্ষক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এটি। সম্প্রতি এই চক্রের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রনণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা ইনকিলাবকে বলেন, ২০১৮ সালের তালিকায় স্কোপালামিন মাদকের তালিকায় নেই। আমাদের দেশে এটা নিয়ে কোনো আইনও নেই। তিনি এটিকে মাদকও বলতে চান না। কারন মাদক বা নেশা বলতে যা বুঝায় সেটি এটির মধ্যে নেই। তবে তিনি বলেন, স্কোপোলামিন এখনো আমাদের টিম কোথাও থেকে উদ্ধার করে নি। এ সংক্রান্ত মামলাও মাদকে আছে বলে জানা নেই। কাজেই ওটা নিয়ে এখনো আমাদের ল্যাবে কোনো ধরনের টেষ্ট হয় নি। তবে যেহেতু এটি এখন প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে, অপরিচিতদের থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে কেউ যাতে পাশে বসতে না পারে, কোনো কিছু স্প্রে করতে না পারে কিংবা নামে টিস্যু কিংবা রুমাল ধরতে না পারে সেদিকে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
তবে দুলাল সাহা বলেন, এটি এমন একটি ভয়ঙ্কর জিনিস। যার প্রয়োগে রিমোট কন্ট্রোল থাকে অপরাধীর হাতে। মে´িকানরা এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এক সময় ভারতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এটি গরম দুধের সাথে মিসিয়ে কাউকে খাইয়ে বিনোদন নিতো। কিন্তু এখন এটির অপ ব্যবহার হচ্ছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক (নিরোধ ও শিক্ষা) আবদুল আলিম ইনকিলাবকে বলেন, স্কোপালামিন নিয়ে আমাদের এখনো কোনো স্ট্যাডি বা গবেষনা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি এখনো এটি মাদকের আওতায় আসেনি।
উল্লেখ্য, শয়তানের নিঃশ্বাস নামক এ মাদকের উৎপত্তি কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ ‘সত্যের সিরাম’ অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে এ মাদকটি প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে। পর্নোগ্রাফি বা নগ্ন ছবি তোলার কাজেও অপরাধীরা এটি ব্যবহার করে। স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই আকারেই পাওয়া যায়। এ ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। সাধারণত এর প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে প্রতিক্রিয়া দু-তিন দিন পর্যন্ত থাকে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
১৩ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ
সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে পটল চাষে বাম্পার ফলন
গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু
শাহরাস্তিতে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
পাকিস্তানে অবশেষে সরকার ও বিরোধী দলের আলোচনা শুরু
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি