মহারাষ্ট্রের মসজিদে হিন্দু চরমপন্থিদের হামলায় মুসলিম প্রকৌশলী নিহত
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
আয়েশা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং ৪ দিন ধরে অসহায়। ২৯ বছর বয়সী তার নিজের মঙ্গল সম্পর্কে গাফিলতি করছেন এবং তার স্বামী নুরুল হাসানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করায় সঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তার স্বামী মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার পুসেসাভালি গ্রামের একটি মসজিদে হিন্দু জনতার হামলায় নিহত হয়েছেন।
হাসানের বাবা মোহাম্মদ লিয়াকত টেলিফোনে আল জাজিরাকে বলেন, ‘বিছানায় আমার ছেলের প্রাণহীন দেহ দেখে আমার পুরো পৃথিবী ভেঙে গেল। সেই মুহূর্তে, আমার চোখের সামনে যা ঘটেছিল তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না’।
১০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ৩১ বছর বয়সী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হাসান পাশের একটি মসজিদে এশার নামাজের জন্য তার বাড়ি থেকে বের হন। তার চাচা মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, মসজিদে প্রায় ১৫ জন ছিলেন এবং নামাজ চলছিল, এসময় তারা বাইরে হৈচৈ শুনতে পান।
একদল জনতা মসজিদটি ঘিরে ফেলে, মুসলিমবিরোধী সেøাগান দেয় এবং ইসলাম সম্পর্কে উসকানিমূলক মন্তব্য করে। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৫০-২০০ হিন্দু পুরুষ মসজিদের বাইরে জড়ো হয়ে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে, কিছু পার্ক করা গাড়ির ক্ষতি করে’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যক্ষদর্শী আল জাজিরাকে বলেন, জনতা মসজিদের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তিনি বলেন, ‘তারা ধারালো অস্ত্র, লোহার রড, ছোট ছোট গ্রানাইট এবং লাঠিসোটা বহন করে। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাইকে মারধর শুরু করে। হাসানের মাথায় লোহার রড দিয়ে একাধিকবার আঘাত করায় সে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যায়। আমরা যখন তাকে ঘটনাস্থল থেকে তুলি তখন তিনি ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছিলেন, আরো অন্তত ১৪ জন আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শী আরো বর্ণনা করেছেন কীভাবে জনতা নিকটবর্তী একটি দোকানে আগুন দিয়েছে এবং মুসলিম নামধারী বেশ কয়েকটি গাড়ি এবং হ্যান্ডকাট ভাঙচুর করেছে। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘তারা মসজিদের সমস্ত বাতি ধ্বংস করেছে, কুরআন এবং অন্যান্য ধর্মীয় বই পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আমাদের সবাইকে হত্যা করার অভিপ্রায় প্রকাশ করে’।
সিরাজ বলেন, গ্রামের কেউ আশেপাশের পুলিশ পোস্টে খবর দেয় এবং তাদের হস্তক্ষেপে জনতা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তিনি বলেন, যাওয়ার সময় জনতা গ্রামের অন্য একটি মসজিদের বাইরে পার্ক করা যানবাহনের জানালা ভেঙে দেয় এবং মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করে।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ তাকে [হাসান] একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায় যেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে তাকে আরো তদন্তের জন্য সাতারা জেলা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়’। হাসানের হাত ভেঙে যায় এবং তিনি মাথায়, ঘাড়ে এবং বুকে গুরুতর আঘাত পান, যার ফলে তার তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়।
কী কারণে ঘটনাটি ঘটেছে : সিরাজের মতে, এটি শুরু হয়েছিল একজন হিন্দু ব্যক্তির ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে একটি মুসলিম নাবালকের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার এবং ১৭ শতকের শ্রদ্ধেয় হিন্দু রাজা ছত্রপতি শিবাজির বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর বিষয়বস্তু’ পোস্ট করার সাথে, যিনি মুঘলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন।
পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যায় এবং এলাকায় মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তদন্তের পর পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে, পোস্টটি মুসলিম ছেলে করেনি এবং অমর অর্জুন শিন্দে নামে অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতারার একজন পুলিশ কর্মকর্তা আল জাজিরাকে শিন্দের গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এক কিশোর ছেলে ইনস্টাগ্রামে একটি মেয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল, যে তার সহপাঠীও ছিল। অমর, যে এই মেয়েটির অনলাইন বন্ধু ছিল, সে মুসলিম ছেলেটির সাথে ঘৃণ্য শত্রুতায় লিপ্ত হয়। সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বপন করার প্রয়াসে, অমর মুসলিম ছেলেটির অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে এবং শিবাজি মহারাজ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য পোস্ট করে’।
পুলিশ অফিসার বলেন যে, শিবাজির ওপর আরেকটি আপত্তিকর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট ১০ সেপ্টেম্বর এলাকায় ভাইরাল হয়েছিল। তিনি আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমরা পোস্টটি অবিলম্বে অবগত হয়েছি এবং তদন্ত শুরু করেছি। আমরা এখনও বিষয়টি তদন্তের প্রক্রিয়াধীন ছিলাম এবং সেই সন্ধ্যায় যখন জনতা মসজিদে হামলা চালায়, যার ফলে একজন যুবক মারা যায়’।
ওই কর্মকর্তা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় অন্তত ১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ‘ইন্টারনেট পরিষেবাগুলো অবিলম্বে স্থগিত করা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত মোতায়েন করা হয়’, তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনটি পৃথক প্রথম তথ্য প্রতিবেদন (এফআইআর) দায়ের করা হয়েছে।
অফিসার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ৩৫ জনকে গ্রেফতার করেছি এবং তদন্ত এখনও চলছে’। তিনি বলেন, তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত হাসানের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করতে পারবেন না।
এদিকে হাসানের পরিবারে শোকের ছায়া। হাসানের মৃদুভাষী বাবা স্থানীয় একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং তার মা সরকারি হাসপাতালের একজন অবসরপ্রাপ্ত নার্স। গত বছরের নভেম্বরে আয়েশাকে বিয়ে করেন হাসান। তিনি ছাড়া আমাদের জীবন কিছুই নয়। তিনিই ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসা... এখন আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কে আছে? লিয়াকত আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন।
কয়েক মাস আগে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করা হাসান নির্মাণ কাজে ভাড়া দিয়ে আয় বাড়াতে একটি বুলডোজার কিনেছিলেন। সিরাজ বলেন, ‘তিনি বুলডোজার কেনার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন এবং তার জীবিকার জন্য এটির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। এখন, এ দায়িত্বের ভার তার বৃদ্ধ বাবা এবং তার গর্ভবতী স্ত্রীর কাঁধে পড়েছে’। তিনি একজন দয়ালু এবং সরল মানুষ ছিলেন। এমনকি তার অমুসলিম প্রতিবেশীরাও তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে। কেন হাসানকে হত্যা করা হলো তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে পরিবার।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিরাজ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত লিঞ্চিংয়ের সমস্ত ক্ষেত্রে, কোনো উল্লেখযোগ্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, মনে হচ্ছে যেন তাদের [অপরাধীদের] রক্ষা করা হচ্ছে, যা আমাদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেয়’।
পরিকল্পিত হামলা? : সিরাজের মতে, গ্রামে হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল হিন্দু গোষ্ঠীদের দ্বারা যারা কথিতভাবে মুসলমানদের টার্গেট করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল যখন এটি জানা যায় যে, শিবাজির বিরুদ্ধে পোস্টটি বাস্তবে একটি হিন্দু ছেলে পোস্ট করেছিল।
তিনি বলেন, ‘তারা গত ১০-১৫ দিন ধরে আমাদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা শিবাজি মহারাজের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রাখি এবং তার সম্পর্কে আমাদের কোনো অবমাননাকর পোস্ট করার কোনো কারণ নেই’ ।
স্থানীয় সম্প্রদায়ের একজন সদস্য টেলিফোনে আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘তারা অন্ধকারে আমাদের ওপর হামলা করেছে এবং মুসলমানদের ঘরবাড়ি এবং মসজিদে আগুন দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশত, তারা ব্যর্থ হয়’।
অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস গ্রুপের সভাপতি মোহাম্মদ আসলাম গাজী বলেছেন, গত কয়েক মাস ধরে মহারাষ্ট্রের কোলহাপুর অঞ্চলে কিছু হিন্দু গোষ্ঠীর হাতে সঙ্ঘটিত মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে।
তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এসব ঘটনাকে সুপরিকল্পিত এবং কিছু বিদ্বেষীদের সংগঠিত বলে মনে হচ্ছে, সম্ভবত আসন্ন নির্বাচনের কারণে, কারণ তাদের লক্ষ্য সাম্প্রদায়িক লাইনে ভোট সুরক্ষিত করা’।
গাজী বলেন, দ্য কেরালা স্টোরির মতো চলচ্চিত্রগুলো এ অঞ্চলে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং এর কিছুক্ষণ পরেই অনেক হিন্দু যুবক সমাবেশের সময় বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করে এবং এমনকি কোলহাপুরে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে।
হাসানের বাড়িতে ফিরে আয়েশা তার মৃত্যুর শোকে অসাড় হয়ে পড়েছেন। ‘লিয়াকত আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘সে মসজিদে যাওয়ার আগে আয়েশা তাকে আগে ডিনার করতে বলেছিল। কিন্তু হাসান তাকে আশ্বস্ত করে যান যে, তিনি ২০ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন এবং তারা একসাথে খাবেন’। কিন্তু ‘সে আর ফিরে আসেনি’। সূত্র : আল-জাজিরা।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বারষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার
সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ
সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা
মোহনপুর উপজেলা বিএনপি দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে সভাপতি মুন সাধারণ সম্পাদক মাহবুব বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না:সালাম
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
নির্বাচনে কারা যোগ্য, সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি: বদিউল আলম মজুমদার
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
রেমিট্যান্সে সুবাতাস: ডিসেম্বরের ২১ দিনেই এলো ২০০ কোটি ডলার
প্রশাসন ক্যাডারের ‘ইয়াং অফিসার্স’ ফোরামের সভাপতি শুভ, সাধারণ সম্পাদক জয়
ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কেওক্রাডং বাংলাদেশ’র উদ্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হলো ‘কোস্টাল ক্লিনআপ’
তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাহাত ফাতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ