দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তরুণ-যুবকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেশে কাজ না পেয়ে ১৫ বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ গেছে ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৪ জন :: চাকরির বাজারে দলবাজি, কোটা, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কারণে দেশ ছাড়ছেন মানুষ :: উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রায় নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে, প্রতি বছর ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা নিতে বাইরে চলে যাচ্ছেন :: যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মুখে, ফ্লাইওভার-মেট্রোরেলের মতো দৃশ্যমান উন্নয়নের বদলে কর্মসংস্থান-মানবসম্পদ উন্নয়নের তাগিদ

বাড়ছে বিদেশমুখি প্রবণতা

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

রাজধানীর ফ্লাইওভার, উড়ার সড়ক, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলিতে বঙ্গবন্ধু ট্রানেল, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখলে মনে হয় দেশ দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে জিডিপি’র আকার, মাথাপিছু আয়। জীবনযাত্রায় এসেছে ব্যপক পরিবর্তন। কয়েক বছর আগেও বাসায় এসি, ফ্রিজ, প্রাইভেট কারকে বিলাসিতা মনে করা হলেও এখন তা প্রয়োজনীয়। দেশ উন্নয়নশীল থেকে মধ্য আয়ের দেশের পরিণত হতে চলেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। কিন্তু এরপরও কমছে না তরুণ-যুবকদের মধ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা। বরং প্রতিবছরই বাড়ছে বিদেশগামীদের সংখ্যা। এর মধ্যে যেমন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে, আবার শহুরে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত শ্রেণীর স্বল্প-শিক্ষিত বেকার ও উচ্চাভিলাষী তরুণ-তরুণীও আছে, শিক্ষিত, চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণির মানুষই এখন বিদেশমুখী। তাদের কেউ কেউ দেশ ছাড়াছেন উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়, কেউবা চাকরির জন্য। এতে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে মেধা। সেই সঙ্গে যাচ্ছে অর্থও। প্রতি বছর গড়ে অর্ধলক্ষ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। তাদের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অন্তত ৫৮টি দেশ। অনেকেই আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরুভুমি, বন, সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছেন। তাদের ভাগ্য ভালো হলে প্রাণ নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা পৌঁছাচ্ছেন, নয়তো সাগরে ডুবে মৃত্যু। আবার ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও মিলছে না আশ্রয়। প্রশ্ন হচ্ছে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে চলমান হলে দেশের এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশমুখি হচ্ছেন কেন? কেন হাজার হাজার মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ‘ভবিষ্যৎ গড়ার’ প্রত্যাশায় বিদেশ চলে যাচ্ছেন? আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে ২০২১ সালে ইইউ প্লাস দেশগুলোতে আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছিলেন ২০ হাজার বাংলাদেশি। এবার এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

বেসরকারি দাতব্য সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান তৃতীয়। প্রতি বছর এই সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে গড়ে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। একই সংস্থার তথ্য মতে, ২০২১ হতে ২০২৩ সালের জুন মাস অবধি ২৯ হাজার ৭৭৮ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে। আর ২০০৯ থেকে ২০২৩ অবধি এই সাগরে পাড়ি দিয়েছে ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৪ জন বাংলাদেশি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ-২০২২’ এর প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে উন্নয়নে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই, সে উন্নয়নে জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। আর ব্রীজ-ফ্লাইওভার দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে বেশি প্রয়োজন কর্মসংস্থান এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন। বাংলাদেশ এ দুটোতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ফলে দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে জনসম্পদ উন্নয়নের দিকে জোর দিতে হবে।

স্টুডেন্ট ভিসায় বিদেশ গিয়েছেন বা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরি না পাওয়া, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের অভাব, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, সুচিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি ছাড়া সেবা না পাওয়া, ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, দূষিত পরিবেশ, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো তাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহিত করছে।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। তৌহিদ মোস্তাফিজ বলেন, বাংলাদেশে একটা নি¤œ মানের চাকরি করতে গেলেও ঘুষ দিতে হয়। কোন কিছুর নিরাপত্তা নেই। সবখানে সব সময় যে যেভাবে পারছে ক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত। কোথাও কোন কাজে গেলেও ঘুষ ছাড়া হয় না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আর বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরাও লেখাপড়া থেকে রাজনীতি করতে বেশি পছন্দ করেন। যা বিদেশে নেই। আমিও খুব শিগগিরই বিদেশেই পাড়ি দিব।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশিদ বলেন, উচ্চ-স্তরের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী দেশগুলির প্রলোভন মানুষকে বিদেশে পাড়ি দিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। কারণ পেশাদাররা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য উন্নতমানের জীবন কামনা করে। পরিবারের উন্নত মানের জীবনযাত্রার পাশাপাশি বাইরের দেশগুলি প্রায়শই মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়, অভিভাবকদের সন্তানদের সর্বোচ্চ মানের শিক্ষা দিতে সেদিকে আকৃষ্ট হন। এই আকাক্সক্ষার জন্য প্রায়শই বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন, এমনকি বিদেশে তাদের ক্যারিয়ার অসুবিধার সম্মুখীন হলেও তারা পরোয়া করেন না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আছে প্রশাসনে কর্মরত দুর্নীতিবাজদের সন্তান। অসৎ উপায়ে টাকা অর্জনকারী এবং বিদেশে টাকা পাচারকারীদের সন্তানরাও বিদেশমুখি। দুর্নীতিবাজরা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার নামে তারা অনেকেই বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন বৈদেশিক মুদ্রা। ওই টাকায় সংশ্লিষ্ট দেশে গাড়ি-বাড়ি কিনে কিংবা ব্যবসায়ী সেজে স্থায়ী বসবাসের (পিআর) অনুমতি নিচ্ছেন। এরপর শুরু হয় তাদের উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন।

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রা : শিক্ষাজীবন শেষ করে সবারই পছন্দের তালিকায় থাকে বিসিএসসহ সরকারি চাকরি। তবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের এখন টার্গেটে পরিণত হয়েছে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ পাড়ি দেয়া। বিগত এক দশকে এটিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে। এক বছরের তুলনায় বেড়েছে পরের বছরের হার। বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির সূত্র বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর উচ্চশিক্ষায় বিদেশগমনের হার প্রায় দ্বিগুণ। তারা বলছেন, উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রায় একটা নীরব বিপ্লব হয়ে গেছে দেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়াতে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ালেও মানসম্মত শিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক নিশ্চয়তা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব, দেশে কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়ছে। এসব শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গেলেও পরবর্তী সময়ে সেখানেই স্থায়ী হচ্ছেন। ফলে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

এদিকে ইউনেস্কোর ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছরই ৪০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর শিক্ষার্থী যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে। সাম্প্রতিক সময়ে ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, সাইপ্রাস, ফিনল্যান্ডেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে।

২০২২ সালে প্রকাশিত ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪৪ হাজার ২৪৪ জন, ২০২০ সালে ৫০ হাজার ৭৮, ২০১৯ সালে ৫৭ হাজার ৯২০ এবং ২০১৮ সালে ৬২ হাজার ১৯১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বেশ নাজুক। জনবল ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব একটি সমস্যা অবশ্যই। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়ে গেছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশায় ভোগে। তখন তারা দেশ ছেড়ে পালাতে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ইমেরিটাস প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বেকারত্বের কারণে অনেকে বিদেশ যাচ্ছেন। তবে বিদেশ গিয়ে যদি কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে সেটা খারাপ নয়। এটা তার জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। সে রেমিট্যান্স পাঠাবে। তবে সব মেধাবীরাই যদি বিদেশে পাড়ি দেয়, তাহলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশকে এগিয়ে নিতে উদ্ভাবন দরকার। মেধাবীদের ফিরতে হবে। এ জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছে তারা ফিরলে যেন যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত কাজ ও সম্মান পায় সেই ব্যবস্থা সরকারি ও বেসরকারিভাবে করতে হবে। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, উন্নত প্রযুক্তি ও পরিবেশে লেখাপড়া-গবেষণা আর বৈশ্বিক জ্ঞানভা-ারের সঙ্গে পরিচিত হতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়াটা অপরাধ নয়, বরং জরুরি। তবে ফিরে এসে তারা দেশের জনশক্তিকে বৈশ্বিক মানে তৈরি করতে পারেন। চীন-ভারত প্রতি বছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েটকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা-যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশে পাঠাচ্ছে। যারা পড়তে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগ আবার ফিরে এসে নিজ দেশে সেবা করছেন।

অবৈধ পথে অনিশ্চিত যাত্রা : দেশ থেকে বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথে বিদেশ যাত্রাও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশেষ করে সাগর পথে ইউরোপ যাত্রার নামে জীবণের ঝুঁকি নিতেও পরোয়া করছেন না তরুণরা। তাদের ভাগ্য ভালো হলে প্রাণ নিয়ে ইউরোপে পৌঁছাচ্ছে, নয়তো সাগরে মৃত্যু। আবার ইউরোপে পৌঁছতে পারলেও মিলছে না আশ্রয়। এমন অনিশ্চিত মরণযাত্রা জেনেও লিবিয়া থেকে ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি অভিমুখে যাত্রা করছে বাংলাদেশিরা। উন্নত জীবনের স্বপ্নে তারা নিজেদের সঁপে দিচ্ছে আন্তর্দেশীয় মানব পাচারকারী চক্রের হাতে।

অভিবাসী সংস্থা ও মানবাধিকার এনজিওগুলোর তথ্য বলছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দেয়ার ঘটনায় প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এমনকি বাংলাদেশ থেকে অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বা রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশে চলে যাচ্ছেন অনেকে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম প্রকাশ করেছে যে, ২০০৯ সাল থেকে ৬২ হাজার ৫৮৩ জন বাংলাদেশি ৯টি ভিন্ন রুট ব্যবহার করে অনিয়মিতভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছে এবং এই বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৩ হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশি বিপজ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩৭ হাজার ১৯৪ জন বাংলাদেশি কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরীয় পথ ব্যবহার করেছেন। ১৭ হাজার ৬৩৯ জন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুট ব্যবহার করেছেন এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুট দিয়ে ২০০৯ থেকে মে ২০২১ এর মধ্যে প্রবেশ করেছে ৮৫৭ জন। ব্র্যাকের মতে, যারা এই ধরনের সমুদ্র যাত্রায় নিজেদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেন তাদের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর আনুমানিক সাত লাখ বাংলাদেশি যারা বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে পছন্দ করেন, তারা এই ঝুঁকির মুখোমুখি হন।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, আমরা দেখছি যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়তে চলে আসছে। যেখানে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে অবস্থান করছি, সেখানে এটা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, অবৈধ অভিবাসনকে সরকার সমর্থন করে না। অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিরা দেশকেই বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে।

দেশ ছাড়ছেন চাকরিজীবীরাও : দেশের তরুণদের একটি অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাত্রার প্রবণতা তো আছেই, এর পাশাপাশি এখন চাকরিজীবীদের মধ্যেও এটি লক্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যেও অনেকে চাকরি ছেড়ে শিক্ষা শিক্ষা গ্রহণ কিংবা ভাল ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন দক্ষ ব্যক্তিরা। দৈনন্দিন এবং পেশাগত জীবনে একাধিক অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার জেরে এই ঘটনাটি বাড়ছে।

জানা যায়, যারা দেশ ছাড়ছে তাদের মধ্যে অনেকেই স্নাতক হয়ে চাকরির জগতে সদ্য যোগ দিয়েছে, এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি যারা পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে চাকরি করছেন, সদ্য বিবাহিত, পরিবারে শিগগিরই একটি সন্তানের প্রত্যাশা করছেন, অথবা একটি ছোট শিশু আছে তারাও বিদেশে যেতে আগ্রহী। এই লোকেরা বেশিরভাগই সাধারণ কোনো পরিবার থেকে উঠে এসে বিশ্ব বাজারে নিজের আলাদা একটা পরিচয় তৈরি করছে। বাংলাদেশি পেশাদারদের বিদেশের মাটিতে পা রাখার সব থেকে লোভনীয় কারণ উচ্চতর কর্মজীবনের সুযোগ।

আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারগুলি প্রায়শই উচ্চতর পারিশ্রমিক প্যাকেজ, ব্যাপক সুবিধা এবং পেশাদার অগ্রগতির অনন্য সুযোগ দিচ্ছে। এছাড়াও, দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। কিছু পেশাদার বিশ্বাস করেন, তাদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক চাকরির বাজারে অধিকতর প্রশংসিত হয়েছে, বেড়েছে আর্থিক পারিশ্রমিক। বৈচিত্রপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন এবং স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও কাজের পরিবেশের এক্সপোজার পেশাদারদের অনুপ্রেরণার আরো একটি উৎস। অভিবাসনের একটি অবিচ্ছেদ্য দিক হলো একটি উন্নত মানের জীবনযাত্রা।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী
বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ
১০০ টাকা ঘুষ খেলেও চাকরি থাকবে না: নৌপরিবহন উপদেষ্টা
আরও

আরও পড়ুন

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

৯ গোলের উৎসবে লিভারপুলের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

বড়দিনের ছুটির আগে রিয়ালের বড় জয়

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

ঘরের মাঠেই বিধ্বস্ত ইউনাইটেড

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

গোলশূন্য ড্রয়ে থামল চেলসির জয়রথ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না: আব্দুস সালাম

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সরকারের আশ্বাসে শাহবাগ থেকে সরে গেলেন বিএসএমএমইউ ট্রেইনি চিকিৎসকরা

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

সাকাকে হারিয়ে চিন্তিত আর্সেনাল কোচ

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব জমা হবে : বদিউল আলম মজুমদার

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বদলী

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

মানিকগঞ্জের ঘিওরে ছাত্রদল নেতা লাভলু হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়া মামলায় একজন গ্রেফতার

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক

জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধীর গতিতে চলছে: আমিনুল হক

জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

জমকালো আয়োজনে পালিত হলো বান্দরবান সেনাবাহিনীর ৬৯ ব্রিগেডের ৪৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী