শুরু হচ্ছে পর্যটন মৌসুম

ক্ষতবিক্ষত মেরিন ড্রাইভ প্রশস্তকরণে বন পাহাড় জীববৈচিত্র্যে ধ্বংসের শঙ্কা

Daily Inqilab শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার থেকে

২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৪৮ পিএম | আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০১ এএম

দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কটি দেশের অন্যতম গর্বের বিষয়। ১২০ কি.মির এই সড়কটি সাগর পাহাড় আর বনবনানির অপার সৌন্দর্য অবারিত করেছে পর্যটকদের জন্য। এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী পর্যটকরা আত্মহারা হয়ে যান মহান আল্লাহ তালার সৃষ্টির অপার রূপলাবণ্যে। কিন্তু গত দুয়েক বছর থেকে সাগরের ডেউয়ে ক্ষতবিক্ষত মেরিন ড্রাইভ সড়ক। সড়কের হিমছড়ি ও টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের পশ্চিম মুন্ডার ডেইল এলাকা তীব্র ঢেউর আঁছড়ে এখন প্রচÐভাবে ক্ষতবিক্ষত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় গত মাসে মেরিন ড্রাইভ টেকনাফের সাবরাং অংশসহ প্রায় ১৫টি অংশে তীব্র ভাঙনের ফলে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সৈকতের বালি দিয়ে জিও ব্যাগ সিস্টেম দ্বারা ভাঙন রোধ করার চেষ্টা করা হলেও তা কোনভাবেই স্থায়ী সমাধান নয়। এর টেকসই ও স্থায়ী সমাধান বের করার দাবি স্থানীয়সহ সচেতন মহলের।

তবে ইতোঃপূর্বেই ভাঙন রোধে মেরিন ড্রাইভ রোড আরো প্রশস্ত করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। গত বছরের জুনে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সড়কটি প্রশস্ত করা হলে প্রকল্প এলাকায় আরো গাছ ও পাহাড়ি বন কাটা পড়বে বলে জানিয়েছেন মেরিন ড্রাইভের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, মেরিন ড্রাইভ প্রশস্তকরণের ফলে হুমকির মুখে পড়বে সামুদ্রিক কাছিম ও লাল কাঁকড়ার আবাস। ব্যাহত হবে এ অঞ্চলের প্রাণ জৈববৈচিত্র্য। সড়ক প্রশস্ত করে নয় বরং ভাঙন রোধে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের আহŸান জানিয়েছেন তারা।

কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের বিকাশে ২০০৮ সালে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম পর্বে কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়। দ্বিতীয় পর্বে ২০১৬ সালে ইনানী থেকে টেকনাফের শিলখালি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এবং তৃতীয় পর্বে শিলখালি থেকে টেকনাফ সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয় ২০১৮ সালে। ইতোঃমধ্যেই সড়কটি ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কিন্তু গত বছর হঠাৎ করেই সড়কটিতে ভাঙন শুরু হয়, চলতি বছরে যা তীব্র আকার ধারণ করে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন রোধে গত বছর ‘কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয় সড়ক বিভাগ। প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপে এক হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে উখিয়া উপজেলার পাটুয়ারটেক পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। এছাড়া রেজুখালের ওপর নির্মাণ করা হবে ৩০৫ মিটারের দুই লেনের সেতু। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং প্রকল্প এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উখিয়া উপজেলা সভাপতি সাংবাদিক এম আর আয়াজ রবি বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজার, রামু, উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও প্রাণ প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের উভয় পাশে কয়েক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে, সাথে রয়েছে প্রাকৃতিক প্যারেকখ্যাত পাহাড়। অন্যদিকে মেরিন ড্রাইভের তীরঘেঁষেই রয়েছে সমুদ্রসৈকতের লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিন ও সাগরলতাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাঁচটি নির্ধারিত স্থান। সড়কটি প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ ও প্রাণিদের আবাস ক্ষতির মুখে পড়বে। সড়ক প্রশস্ত করে নয় বরং ভাঙন রোধে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাই বাছাই করে টেকসই অবকাঠামো গঠনের যুক্তিকতা তুলে ধরেন তিনি।

সরেজমিন দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত রাস্তার গা ঘেঁষেই দুই পাশে রয়েছে ছোট-বড় পাহাড় ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজার থেকে ইনানী পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গাছ কেটে ফেলতে হবে। এখানকার বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক কাছিমের অবাধ বিচরণস্থল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব প্রাণের আবাস।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ঢেউয়ে সড়কের ভাঙন ঠেকানোর জন্য রাস্তা প্রশস্ত করা কোনো সমাধান নয়, বরং সড়কের ডিজাইন এমনভাবে করা উচিত যাতে ঢেউয়ের কারণে সড়ক না ভাঙে। সড়ক নির্মাণে কোনোভাবেই পাহাড়ি বন বা পাহাড় কাটা সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚গোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রশস্ত করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। সেখানে সামুদ্রিক ঢেউয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি স্রোতও আসে। তাই সড়ক বড় করে সেখানে বিপর্যয় আরো বাড়ানো হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘৩০ বছর আগেও এ অঞ্চলে ছিল প্রাকৃতিক দ্বীপ। সমুদ্রঘেঁষে পাহাড় থাকার ফলে পাহাড়ের পাদদেশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেখানে তৈরি হয়ে পাহাড়ি ক্লিপ। পৃথিবীর যেখানেই সমুদ্রের পাশে পাহাড় আছে সেখানেই এ ধরনের ন্যাচারাল ক্লিপের দেখা মেলে। সমুদ্র ও পাহাড়ের মেলবন্ধনে এটি একটি চমৎকার ইকোসিস্টেম। পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে ইকোসিস্টেমের লিংক রয়েছে। এ লিংক কোস্টাল এরিয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেরিন ড্রাইভ করার ফলে ওই লিংকেজ বা সংযোগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন নতুন করে যদি আবার সড়কটি প্রশস্ত করা হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। এতে একদিকে পাহাড় কাটা পড়বে, অন্যদিকে সমুদ্রপাড় ভরাট হবে। কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণির আবাস হুমকিতে পড়বে। ব্যাহত হবে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননও।’

তাই মেরিন ড্রাইভ সড়কটির ভাঙনরোধে বনভ‚মি, পাহাড় ও জৈববৈচিত্র্য ধ্বংস করে প্রশস্তকরণ করে নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে টেকসই অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের পছন্দের সড়কটি ঢেলে সাজানোর কথা উচ্চারিত হচ্ছে সবার মুখে।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাহাত ফতেহ আলী খানের সম্মানে পাকিস্তান হাইকমিশনারের নৈশভোজ আয়োজন
এবার সাদপন্থিদের ১০ দফা দাবি
সিকদার গ্রুপের ১৫ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ
বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
আরও

আরও পড়ুন

সড়কে ছয় লেনের কাজ এগিয়ে চলছে গাড়ি চলবে ১০০ কি.মি গতিতে

সড়কে ছয় লেনের কাজ এগিয়ে চলছে গাড়ি চলবে ১০০ কি.মি গতিতে

আটঘরিয়ায় ঘন কুয়াশায় বিনা চাষে রসুনের জমি পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত কৃষক

আটঘরিয়ায় ঘন কুয়াশায় বিনা চাষে রসুনের জমি পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত কৃষক

সীমান্তে বিজিবির গুলি ১৬ বস্তা ভারতীয় ফেনসিডিল  ফেলে পালালো চোরাকারবারীরা

সীমান্তে বিজিবির গুলি ১৬ বস্তা ভারতীয় ফেনসিডিল  ফেলে পালালো চোরাকারবারীরা

সখিপুরে পৃথক পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু

সখিপুরে পৃথক পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু

রামগড়ে ইটভাটায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে ৪লক্ষ টাকা জরিমানা

রামগড়ে ইটভাটায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে ৪লক্ষ টাকা জরিমানা

আমতলীর ইউএনও’র বদলীর আদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন

আমতলীর ইউএনও’র বদলীর আদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন

নবীনগর ও কসবায় বিভিন্ন রকমের  মাদকসহ তিন যুবক গ্রেপ্তার

নবীনগর ও কসবায় বিভিন্ন রকমের  মাদকসহ তিন যুবক গ্রেপ্তার

মণিপুর গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে মিয়ানমার, চাঞ্চল্যকর দাবি রিপোর্টে

মণিপুর গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে মিয়ানমার, চাঞ্চল্যকর দাবি রিপোর্টে

চাঁদপুর মেঘনায় জাহাজে মিলল ৫ জনের মরদেহ

চাঁদপুর মেঘনায় জাহাজে মিলল ৫ জনের মরদেহ

বরিশালে মাহমুদিয়া মাদ্রাসার ৭৮তম মাহফিল ও ইসলামী মহাসম্মেলন শুরু

বরিশালে মাহমুদিয়া মাদ্রাসার ৭৮তম মাহফিল ও ইসলামী মহাসম্মেলন শুরু

বিনা খরচে কৃষকের দেড়’শ ধানের চারা রোপন  করে দিল কালীগঞ্জ কৃষি আফিস

বিনা খরচে কৃষকের দেড়’শ ধানের চারা রোপন করে দিল কালীগঞ্জ কৃষি আফিস

সিরিয়ার নেতার সঙ্গে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান

সিরিয়ার নেতার সঙ্গে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান

আরাফাত রহমান কোকো ৮ দলীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে উদ্দীপন যুব সংঘ চ্যাম্পিয়ন

আরাফাত রহমান কোকো ৮ দলীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে উদ্দীপন যুব সংঘ চ্যাম্পিয়ন

সাতক্ষীরার নলতায় চার দফা দাবিতে ছাত্র -ছাত্রীদের আন্দোলন, ক্যাম্পাসের নাম বদল

সাতক্ষীরার নলতায় চার দফা দাবিতে ছাত্র -ছাত্রীদের আন্দোলন, ক্যাম্পাসের নাম বদল

অর্থনৈতিক সংকটে আফগান রুটি, ঐতিহ্য ও জীবনের অংশ

অর্থনৈতিক সংকটে আফগান রুটি, ঐতিহ্য ও জীবনের অংশ

আশুগঞ্জে গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে  অটোরিকশা নিয়ে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা

আশুগঞ্জে গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে  অটোরিকশা নিয়ে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা

উত্তরপ্রদেশে ৩ খলিস্তানি বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা পুলিশের

উত্তরপ্রদেশে ৩ খলিস্তানি বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা পুলিশের

শিবালয়ের যমুনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হুমকিতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার

শিবালয়ের যমুনায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হুমকিতে বৈদ্যুতিক টাওয়ার

হিলিতে কমেছে আলু পেঁয়াজের দাম

হিলিতে কমেছে আলু পেঁয়াজের দাম

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১,১০০ হতাহতের শিকার : সিউল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১,১০০ হতাহতের শিকার : সিউল