ঢাকা   রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৭ আশ্বিন ১৪৩১
চট্টগ্রামে বাবাকে খুনের পর পরিচয় গোপন করে ঢাকায় চাকরি নেন সফিকুর

এবার ছেলেকে নিয়ে কাটা মাথার খোঁজে পিবিআই

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

এবার ছোট পুত্র সফিকুর রহমান ওরফে জাহাঙ্গীরকে (৩০) সাথে নিয়ে মো. হোসেন আলীর কাটা মাথার খোঁজে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে মামলার তদন্তকারি সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। গতকাল শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে তল্লাশি চালানো হয়। তবে কাটা মাথাটি না পেয়ে গতকালের মতো অভিযান শেষ করেছে পিবিআই।

খুনের পর হোসেন আলীকে কেটে ১০ টুকরো করেন তার দুই পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান ও সফিকুর রহমান। দুুটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে লাশের নয় টুকরো উদ্ধার করা হলেও খুনের ১৭দিন পরেও মিলেনি তার খন্ডিত মাথাটি। এর আগে সফিকুরের স্ত্রী আনারকলি ওরফে কলিকে নিয়ে ওই মাথার খোঁজে টানা তিনদিন তল্লাশি চালায় পিবিআই।

বাবাকে খুনের পর থেকে পলাতক ছিলেন নগরীর ইপিজেডের একটি কারখানার শ্রমিক সফিকুর রহমান। পিবিআই জানিয়েছে, পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে নাম-পরিচয় গোপন করে একটি কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন গ্রেফতার সফিকুর রহমান। গ্রেফতার এড়াতে যেকোনো ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন তিনি। শুক্রবার দুপুরে ঢাকার হাজারীবাগের একটি কারখানা থেকে সফিকুরকে গ্রেফতার করে পিবিআই টিম। গতকাল শনিবার সকাল থেকে তাকে নিয়ে খন্ডিত মাথার সন্ধানে তল্লাশি শুরু হয়।

এর আগে পিবিআই এই হত্যাকা-ের ঘটনায় সফিকুরের মা ছেনোয়ারা বেগম (৫০), বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান (৩২) ও স্ত্রী আনারকলিকে (২৪) গ্রেফতার করে। মোস্তাফিজুর রহমান ও আনারকলি ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হোসেন আলীকে খুনের দায় স্বীকার করেছেন। বড় ছেলে মোস্তাফিজ দাবি করেন, দীর্ঘ ২৭ বছর নিরুদ্দেশ থেকে ফেরার পর তার বাবা বাড়ি ভিটেসহ সহায় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বলেন, সফিকুরও প্রাথমিক জিজ্ঞাবাদে পিতা হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তাকে রিমান্ডে এনে আরো জিজ্ঞাবাদ করা হবে। বাবাকে খুনের পর সফিকুর তার ভাইয়ের সাথে মিলে লাশ টুকরো করেন। পিবিআই জানায়, এরপর সফিকুর তার স্ত্রী কলিকে নিয়ে প্রথমে নোয়াখালী এবং সেখান থেকে ভোলায় এক বন্ধুর বাড়িতে যান। পরে স্ত্রীকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকায় চলে যান। খুনের পর থেকে সফিকুর গ্রেফতার এড়াতে মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের ডিভাইস থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। ঢাকায় গিয়ে নাম পরিচয় গোপন করে সুমন নাম উল্লেখ করে হাজারীবাগে একটি ট্যানারিতে চাকরি নেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াছ খান বলেন, গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে তার অবস্থান সনাক্ত করা হয়। এরপর টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে পাকড়াও করা হয়।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে সফিকুরের ছবি ছিল। একপর্যায়ে আমরা হাজারীবাগের ট্যানারিতে তার অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হই। গ্রেফতারের সময় তিনি নিজেকে সুমন এবং বাড়ি মীরসরাই উপজেলায় বলে পরিচয় দেন। কিন্তু ছবি-এনআইডি দেখানোর পর নিজেকে আর আড়াল করতে পারেনি। সফিকুরকে গ্রেফতারের মাধ্যমে আলোচিত এই হত্যা মামলার চার আসামিকেই গ্রেফতার করতে সক্ষম হলো পিবিআই।

পিবিআই জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সফিকুর জানিয়েছে, তার বাবা হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২৮ বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন। ফিরে আসার পর সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছিলেন, সেটা একটা বিষয়। তার বাবার দ্বিতীয় সংসার ছিল। তাদের সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে কি না, আরেকটি বিষয়। এছাড়া বাবা ফেরত আসার পর তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা তার মাকে বানটোনা করেছে এমন সন্দেহও ছিল তাদের মধ্যে। এসব কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

সন্তানদের হাতে নির্মম খুনের শিকার মো. হাসান আলী (৬১) চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে। গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর ঘাটে একটি ট্রলি ব্যাগে পাওয়া যায়। কফি রঙের ব্যাগে ছিল ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল কাদির বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এর দুইদিনের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর আকমল আলী সড়কের একটি খাল থেকে বস্তাবন্দি টেপে মোড়ানো শরীরের আরেকটি খ- উদ্ধার করে পিবিআই। এছাড়া আঙ্গুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়। গ্রেফতার করা হয় হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে। তাদের পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বাবাকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রায় ২৭ বছর নিখোঁজ থাকার পর দুইবছর আগে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন হাসান আলী। ফিরেই তিনি ভিটেমাটি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে।

২০ সেপ্টেম্বর সকালে হাসান ও তার স্ত্রী, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেইট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলে সফিকুরের বাসায় ছিলেন। সেখানে বাবা ও দুই ভাইয়ের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। এর মধ্যেই বড় ছেলে তার গলা টিপে ধরলে মারা যান হাসান আলী। ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে দুই ভাই মিলে লাশ গুমের উদ্দেশে সেটি কেটে ১০ টুকরো করে সেগুলো বিভিন্নস্থানে ফেলে দেন।

এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় বাবার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় সফিকুরের স্ত্রী আনারকলিকে। পরদিন আনাকলিকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে তিনদিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। ৩ অক্টোবর আনারকলি আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে আনারকলি জানান, ২০ সেপ্টেম্বর সকালে নিজ বাসার একটি কক্ষে শ্বশুর হাসানকে তার ভাসুর মোস্তাফিজুর রহমান ও স্বামী সফিকুর মিলে একটি বস্তায় ভরতে দেখেন। বিকেলে আনারকলি জানতে পারেন, তার শ্বশুরকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাসুর ও স্বামী হাসানের লাশ কেটে টুকরো করেন। লাশের টুকরোগুলো লাগেজ, ব্যাগ ও বস্তায় ভরেন তারা। রাতে একজন অজ্ঞাত নেশাগ্রস্ত লোকের মাধ্যমে তারা একটি বস্তা বাইরে ফেলে দেন।

পরদিন সকালে লাগেজ ও স্কুলব্যাগ নিয়ে স্বামী ও ভাসুরের সঙ্গে বের হন আনারকলি। লাগেজ নিয়ে ফেলেন পতেঙ্গার ১২ নম্বর ঘাটে। স্কুলব্যাগে ছিল খন্ডিত মাথা, সেটা নিয়ে আনারকলি ও সফিকুর পতেঙ্গা সৈকতে যান। মাথাসহ ব্যাগ পাথরের ব্লকের ভেতরে ফেলে দিতে চাইলে আনারকলি ব্যাগ রেখে দেন। কারণ ওই ব্যাগটি তার খুব প্রিয়, স্কুলে ক্লাসে প্রথম হওয়ায় তাকে ওই ব্যাগ পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়। এরপর সফিকুর শুধু খন্ডিত মাথাটি পাথরের ব্লকের ভেতর ফেলে দেন। আনাকলির তথ্য অনুযায়ী পতেঙ্গা সৈকতে কর্ণফুলী টানেলের প্রবেশমুখের পাশে পুলিশ বক্সের পেছনে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছে পিবিআই। গতকাল সফিকুরকে নিয়ে সেখানে ফের তল্লাশি চালানো হয় কাটা মাথার খোঁজে। এরপর আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয় সফিকুরকে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়

ভিনিসিউস-এমবাপ্পে ঝলকে রিয়ালের বড় জয়

ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট

ফের বিবর্ণ ইউনাইটেড হারাল পয়েন্ট

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব

এবার বুন্দেসলীগায়ও বায়ার্নের গোল উৎসব

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দিয়াজের জোড়া গোলে চূড়ায় অলরেডসরা

দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়

দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও অজিদের অনায়স জয়

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

দেশে সংস্কার  ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান