ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩০ পৌষ ১৪৩১
অবৈধপথে ইউরোপে মরণযাত্রা

ইতালি পাঠানোর লোভ দেখিয়ে লিবিয়া নিয়ে টাকার জন্য নির্মম নির্যাতন

Daily Inqilab আবুল হাসান সোহেল, আনোয়ার জাহিদ

২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

দালালচক্রের সদস্যর প্রথম দিকেই ইতালিতে উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখায়। স্বল্প অঙ্কের টাকায় পাঠানোর প্রলোভনে আগ্রহ বেড়ে যায় যুবকদের মাঝে। পরে দালালরা লিবিয়ায় পাঠিয়ে তাদেরকে তুলে দেয়া হয় সংঘবদ্ধ মাফিয়াদের হাতে। এরপর থেকেই চলে মাফিয়াদের অমানবিক ও নারকীয় নির্যাতন। আর সেই নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এমনকি পরিবার মুক্তিপণ দিতে রাজি না হলে অনেককে দিতে হয় জীবন। এমন প্রলোভনের শিকার হয়েছেন মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়ন পূর্ব মাদ্রা গ্রামের ৮নং ওয়ার্ডের আজিজ মাতুব্বরের ছেলে সজল মাতুব্বর (৩০)। দৈনিক ইনকিলাবের দুই প্রতিবেদক সরেজমিনে ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে গিয়ে এ করুন দশার কাহিনী জানতে পারেন।

ভুক্তভোগীর বাবা আজিজ মাতুব্বর বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ছেলেকে ইতালিতে পাঠানোর জন্য ১২ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাশকান্দী ইউনিয়নের চরশেখপুর গ্রামের সিদ্দিক ব্যাপারীর ছেলে রফিক দালালের সাথে। পরে তাকে পাসপোর্টের সাথে ৬ লাখ টাকা দেই আর বাকি টাকা ইতালি পৌঁছানোর পরে দেব। একথা বলে রফিক দালাল আমার ছেলেকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া নেন। লিবিয়ায় পৌঁছানো পরে আবার ভিসা করানোর জন্য চুক্তি হয় তিন লাখ টাকায়। পরে সে গেম বা ভিসা করানোর জন্য একই স্থানে ৬ মাস রেখে মাফিয়াদের কাছে আমার ছেলেকে বিক্রি করে দেয়। লিবিয়ার বেনগামীতে বন্দী রেখে কয়েক মাস পরে ওই দালাল আমাদের কাছে আরো ১৪ লাখ টাকা দাবি করেন। না দিলে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয়। আমার ছেলেকে নির্যাতন করার দৃশ্য মোবাইল ফোনে দেখায়। এরপর আমরা জমি ও বাড়ি বিক্রি করে তাকে ১৪ লাখ টাকা দিলে এর কয়েক দিন পরে গেম করায়। গেমের তিন দিনের মাথায় আবার ধরা খায়। পরে অন্য দালালের মাধ্যমে চার লাখ টাকা দিয়ে মাফিয়ার থেকে আমার ছেলেকে রক্ষা করি। কোনমতে জীবনে বেঁচে গেলেও শরীরের ক্ষতস্থানে এখনো শুকায়নি। মাথার আঘাতে মাঝে মাঝে মাথায় চমকে ব্যাথায়, হাটতে গেলে পায়ে লাগে ব্যথা এবং কোমর সোজা করে দাঁড়াতে আমার ছেলের অনেক কষ্ট হয়। গত মাস মার্চে একবার আমার ছেলে ফোন করেছিল বলছিল আমার জন্য দোয়া করবেন। এরপর থেকে আমাদের ছেলের সাথে এখনো যোগাযোগ করতে পারিনি। তারপর আমরা রফিক দালালের কাছে আমাদের টাকা ফেরত চাইতে গেলে তিনি উল্টা আমাদের নামে মানবপাচার মামলা দেয়।
নির্যাতিতা সজলের মা সুরাতন নেছা বলেন, রফিক আমার ছেলেকে ইতালি নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় রেখে আমার ছেলেকে টাকার জন্য নির্যাতন করেছে। পাওনাদার টাকার জন্য আমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত আসে। টাকা দেয়ার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। আমাদের তো এখন ভাত খেতে কষ্ট হয়ে যায়। এই সোহেল দালালের বিচার চাই প্রশাসনের কাছে।

লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার সজল মাতুব্বরের স্ত্রী রিক্তা বেগম বলেন, টাকা জন্য প্রথমে গলায় পারা দিয়া মারধর করত, লাথি মারত, মাথা ধরে দেয়ালে ঠুকে মারত, ইলেকট্রিক শক দিত। পানি খেতে চাইলে বাথরুম থেকে বদনায় করে পানি এনে দিত। এইভাবে বিদেশ যাওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে অন্যের জমিতে কাজ করে খাওয়া অনেক ভালো ছিল। এমন নির্যাতনের দৃশ্য দেখে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনরাও নিঃস্ব হয়ে গেছে। এই রফিক দালালের কারণে। আজকে আমরা নিঃস্ব হয়েছি। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই রফিক দালালের সঠিক বিচার এবং আমার পাওনা টাকা ফেরত চাই।

স্থানীয় বাচ্চু আকন বলেন, দালাল রফিক বেপারি ইতালি নেয়ার কথা বলে সজলের কাছে থেকে প্রথমে ৬ লাখ টাকা নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে আবার ১৪ লাখ টাকা নিয়েছে। এরকম করে দফায় দফায় ২৯ লাখ টাকা নিয়েছে। এই টাকার জন্য যে নির্যাতন করেছে সেই ভিডিও দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারি নাই। তাদের একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে তারা এখন জর্জরিত। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি সরকার যেন তার কঠিন বিচার করে।

ঝাউদি ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মফিজুর রহমান মিন্টু হাওলাদার বলেন, দালালের খপ্পরে পড়ে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে লিবিয়াই সজল। বিদেশ যাওয়ার সজলের পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের সাহায্য করা হবে।

ঝাউদি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আবুল হাওলাদার বলেন, সজলের সাথে যে দালাল প্রতারণা করেছে আমি প্রশাসনের নিকট সেই দালালকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দাবি জানাচ্ছি।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাইনউদ্দিন খান বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। লিবিয়ায় বন্দী অনেককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে আরো প্রায় দেড় শত লোক লিবিয়ায় বন্দী আছে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া ফিরে আসা যুবকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে বেকার সমস্যা সমাধান হয়।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, অবৈধ মানবপাচার রোধে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দালালদের বা মাফিয়ার হাতে কেউ আটকা থাকলে বিভিন্ন কারণে আমাদের জানায় না। তারা নিজেরাই আপস করে ফেলে। অভিযোগ যতগুলো পাওয়া গেছে তার ওপরে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, এ অঞ্চলে অবৈধপথে বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেক বেশি। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ গমন করতে গিয়ে মারা গেছে। অবৈধ বিদেশ গমন ঠেকাতে আমরা বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শীত আসতেই রাজনগরে শুরু হয়েছে নাচ-গান আর জুয়ার আসর

শীত আসতেই রাজনগরে শুরু হয়েছে নাচ-গান আর জুয়ার আসর

বিজিবি দিনাজপুর সেক্টরের উদ্যোগে শীতার্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ

বিজিবি দিনাজপুর সেক্টরের উদ্যোগে শীতার্থদের মাঝে কম্বল বিতরণ

বুড়িচংয়ে  কাকদী নদীর পাড় কাটায়  বাধঁ ভাঙ্গার আশঙ্কা বিরাজমান

বুড়িচংয়ে  কাকদী নদীর পাড় কাটায়  বাধঁ ভাঙ্গার আশঙ্কা বিরাজমান

বীজ সরবরাহে প্রতারণা উপরে সুন্দর গাছে আলু ফলন নেই

বীজ সরবরাহে প্রতারণা উপরে সুন্দর গাছে আলু ফলন নেই

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় খালাস পেলেন বাবর

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় খালাস পেলেন বাবর

ভারতের মহাকুম্ভ মেলায় পবিত্র নদীতে স্নানের মহোৎসব , আধ্যাত্মিকতার মহাযজ্ঞ

ভারতের মহাকুম্ভ মেলায় পবিত্র নদীতে স্নানের মহোৎসব , আধ্যাত্মিকতার মহাযজ্ঞ

কলাপাড়ায় বিএনপি'র দপ্তর সম্পাদকের বাসায় চুরি

কলাপাড়ায় বিএনপি'র দপ্তর সম্পাদকের বাসায় চুরি

কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল

কালীগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল

রাজউক উত্তরা জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন

রাজউক উত্তরা জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন

নিষিদ্ধ সংগঠন  সহ-সভাপতি সজল ১ দিনের রিমান্ডে

নিষিদ্ধ সংগঠন  সহ-সভাপতি সজল ১ দিনের রিমান্ডে

কুলাউড়ায় জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

কুলাউড়ায় জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন

ট্রাম্পের শপথের আগে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ উত্তর কোরিয়ার

ট্রাম্পের শপথের আগে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ উত্তর কোরিয়ার

টেকনাফের কৃতিসন্তান সাইফুল্লাহকে পুলিশের এআইজি পদে পদায়ন

টেকনাফের কৃতিসন্তান সাইফুল্লাহকে পুলিশের এআইজি পদে পদায়ন

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেল ফরিদপুরের চার আলেম

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেল ফরিদপুরের চার আলেম

টিকটক কিনছেন না মাস্ক, জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা

টিকটক কিনছেন না মাস্ক, জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা

সাতক্ষীরায় নববধূকে নির্যাতন করে হত্যা! স্বামী আটক

সাতক্ষীরায় নববধূকে নির্যাতন করে হত্যা! স্বামী আটক

ফরিদপুরে চুরি করতে গিয়ে দেখে ফেলায় বাড়ির কেয়ারটেকারকে হত্যা : গ্রেপ্তার ৩

ফরিদপুরে চুরি করতে গিয়ে দেখে ফেলায় বাড়ির কেয়ারটেকারকে হত্যা : গ্রেপ্তার ৩

হাজীগঞ্জে বিভিন্ন দপ্তর পরিদর্শনে জেলা প্রশাসক

হাজীগঞ্জে বিভিন্ন দপ্তর পরিদর্শনে জেলা প্রশাসক

৪৩ বছর বয়সে ক্রিকেটে ফিরছেন অ্যান্ডারসন

৪৩ বছর বয়সে ক্রিকেটে ফিরছেন অ্যান্ডারসন

ইসরায়েলে হুথি গোষ্ঠীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১১ জন আহত

ইসরায়েলে হুথি গোষ্ঠীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১১ জন আহত