নগরকান্দা তালমার কৃষ্ণনগর গ্রামের ৩০ পরিবারের কান্না
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম
নগরকান্দা তালমার কৃষ্ণনগর গ্রামের ৩০ পরিবারের কান্না বিগত ১১ মাসেও থামেনি। কবে থামবে কেউ জানে না। এলাকার ৩০ দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছে ৪৭টি পরিবার। স্বজনহারা কান্নায় এখনও আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আছে। নীরব-নিথর হয়ে বাক-শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছেন কারো মা-বাবা, স্ত্রী এবং এতিম সন্তানরা। প্রায় এক বছর সন্তানদের হারিয়েছেন, তারপরও ফিরে আসবে এ আশা ছাড়েননি সন্তানহারা পাগলিনী ‘মা’। এই বুঝি তার সন্তান ফিরে আসবে। হয়তো কোনো দিন আর ফিরবেও না। না ফেরার দেশে চলে গেছে বুকের ধন, কোনো মায়ের একমাত্র ছেলেসন্তান। সলীল সমাধি হয়েছে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে। এ কথা জেনেও মায়ের মন বিশ্বাস মানছে না। একমাত্র ছেলের ছবি বুকে নিয়ে ঘুমায় কৃষ্ণনগর গ্রামের মোস্তফা মাতবরের স্ত্রী চামেলি বেগম (৪০)। আবার ঘুম থেকে উঠে ছেলে আলামিনের ছবি হাতে করে। মায়ের মন কোনো মতেই বাধ মানছে না।
আলামিনের একমাত্র ছোট বোন মিনু আক্তার। গত বছর ফরিদপুর সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে নার্সিং পাস করেছেন। সলীল সমাধি হওয়া ভাইয়ের একমাত্র বোন মিনু। কত আশা ছিল এই পরিবারটির। সবকিছু বিক্রি করে স্থানীয় আদম ব্যবসায়ী মুরাদ/গিয়াস/পলাশ ব্যাপারীর হাতে ৮ লাখ টাকা দিয়েছেন তাড়াতাড়ি অধিক টাকার মুখ দেখার আশায়। ছেলে ইতালি যাবে, টাকা পাঠাবে। মাসিক শতকরা ২০ টাকা হারে সুদে আনা ৫ লাখ টাকা আগে পরিশোধ করবে। জমি-জমা রাখবে। নতুন বাড়ি করবে। পুকুর কাটবে, পুকুরে দেশি মাছ থাকবে। ছোট পরিবার দেখে সংসারে টুকটুকে একটি নতুন বউ এনে বড় আনন্দে দিন কাটাবে মিনুরা। সে আশা সারাজীবনের তরে শেষ হয়ে গেছে। ১১ মাস হয়ে গেলেও চামেলি বেগমের একমাত্র পুত্র সন্তান আর ফিরে আসেনি বাড়ি। মা- চামেলি, বোন মিনু গড়াগড়ি করে একখনও ঘরের মেঝেতে পড়ে। একমাত্র ছোট বোন মিনু এখন ভাই হারিয়ে বিছানা থেকেও হটাৎ লাফিয়ে উঠে ভাইয়ের মতো অন্যের গলার ডাক শুনে।
চামেলি বেগম ইনকিলাবকে জানান, গত ৪ জানুয়ারি আমার বাজানকে ইতালি পাঠাতে এলাকার আদম ব্যবসায়ী মুরাদ ব্যাপারী ও পলাশ ব্যাপারীর মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার আশায় ৮ লাখ টাকা দেই। কিছুদিন পর জানতে পারি, আমার বাজানের সাথে এলাকা থেকে মোট ৪৭ জন লোক লিবিয়া গেছে ইতালি যাওয়া জন্য। যারা লিবিয়া গেছে তারা সকলেই এই দালালদের প্রত্যেকে ৮/৯ লাখ টাকা দিছে। যাওয়ার পর যখন আমার ছেলে কোনো যোগাযোগ করে না, তখন দালালদের ফোন দেই। তখন তারাও আর ফোন ধরেনি। মনের ভেতর হায়হুতাশ করে ঘুমাতে পারি না। আমার ছেলের সাথে তার আরও ৪/৫ বন্ধু এক সাথে লিবিয়া গেছে। তার আত্মীয়স্বজনরাও আমার কাছে আসে খবর নেওয়ার জন্য। আমার খবর নিতে এসে তারাও পেলো শোকের খবর। বিদেশে যারা গেছে কেউ কোন যোগাযোগ করে না। সন্তানরা বা দালালরা কেউ ফোনও ধরে না। তখন আমরা পাগলের মত হয়ে গেলাম।
হটাৎ একদিন রাত ১০টার খবরে টেলিভিশনে দেখে জানতে পারি লিবিয়া থেকে চোরাইপথে ট্রলারে করে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে বহু লোক মারা গেছে। সবাই ফরিদপুরের। প্রায় দেড়-দুইশ’ লোক এক সাথে গেছে। তার মধ্যে আমাদের এলাকারই ৪৭ জন। এর মধ্যে নগরকান্দা, সালথা, ভাঙ্গা, সদরপুর উপজেলার লোকও ছিল। সবার নাম আমরা জানি না। আমার বাজানের সাথে যারা গেছে তার মধ্যে ৩০ জনই আমাদের উপজেলার। ৪৭ জনের ১৭ জন ফিরলেও বাকি ৩০ জন কেউ ফিরেনি। ঘটনার ২০/২৫ দিন পর ১৬/১৭ জন লোক ফিরলেও আমার বাজান আর ফিরে আসেনি। জানতে পারলাম, ৩০ জনই সাগরে ডুবে মারা গেছে। যারা ফিরে আসছে ওদের কাছে জানতে পারলাম, ওরা ১৮ ঘন্টা পানিতে ভেসে ছিল ওরা। রাখে আল্লাহ মারে কে? এমন অবস্থার মধ্যে, বিদেশি জাহাজে ওদের উদ্ধার করছে। বাকি ৩০ জনের কোনো সন্ধান আর মেলেনি।
সন্তানহারা মা-বাবা, ভাইহারা বোন, বাবা-হারা এতিম সন্তান, স্বামীহারা স্ত্রীদের চোখের পানিতে শরীরের কাপড় ভিজে যায় দিনে এবং চোখের পানিতে বালিশ ভেজে রাতে। এমন কথাই ইনকিলাবকে বললেন আলামিন মাতুব্বর (২১) পিতাঃ মোঃ মোস্তফা মাতুব্বর মাতাঃ চামেলি বেগম। তার ছেলে আলামিনের বন্ধু মাফুজের মা মাফুজা বেগম।
ঘুমের মধ্যে ভিকটিমদের মাথার বালিশ ভিজলেও আনন্দের শেষ নাই দালালদের বাসাবাড়ির। এই দুই প্রতিবেদক সরেজমিনে পরিদর্শনে যান নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামে। সেখানে ইনকিলাবের সাথে কথা হয় বেকারি ব্যবসায়ী মো. রমজান আলীর। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, তার আপন চাচাতো ভাই মো. মাফুজ মোল্যা (২১)কেও আদম ব্যাপারী মুরাদ ব্যাপারী ও পলাশ ব্যাপারী, গিয়াস ব্যাপারী মিলে লিবিয়া থেকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে ৮/৯ লাখ টাকা নেয়। আমার ভাইও ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে আলামিনের সাথে।
তিনি বলেন, এলাকায় ৬/৭ জন আদম ব্যবসায়ী আছে, এরা দীর্ঘদিন যাবৎ লিবিয়া থেকে ইতালি চোরাপথে লোক পাঠায়। এর মধ্যে আমাদের এলাকার লোক আদম ব্যাবসায়ী পলাশ ব্যাপারী, মুরাদ ব্যাপারী, গিয়াস ব্যাপারী, ইসমাইল, সাজ্জাদ, মেহেদী, কাদের মাতুব্বরের বাসাবাড়ি এখন এমপি-মন্ত্রীদের মতো। বছর খানেক আগেও নুন আনতে পান্তা ফুরাতো, আজ তারা লাখ লাখ টাকার মালিক।
আগামীকাল পড়ুন : নগরকান্দার ৩০ দালালের খপ্পরে পড়ে কতজন হারিয়েছেন সন্তান। স্বজনহারা এখন কে কোথায়? চামেলি ও মাফুজার ২ সন্তান খোয়ানো মামলায় দালাল মুরাদ ব্যাপারী, গিয়াস ব্যাপারী ও পলাশ ব্যাপারী কতদিন জেল খেটেছে? তারা এখন কে কোথায়?
উল্লেখ্য, আলামিনের মা- চামেলি বেগম এবং মাহফুজের মা- মাফুজার মামলায় ১০ আদম ব্যবসায়ী আসামি হয়ে মামলা তুলে নিতে পরিবারকে এখনও মামলা তুলে নিতে হত্যার হুমকি দেয়। ৩০ দালালের আদি-দিগন্ত জানতে কালও চোখ রাখুন ইনকিলাবের পাতায়।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট
আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই
যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই
সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন
ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র্যালি
ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস