ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১
অবৈধপথে ইউরোপে মরণযাত্রা-১০ ১০ লাখ টাকায় মুক্তিপণ

মালয়েশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে মাফিয়াদের অবর্ণনীয় নির্যাতন

Daily Inqilab আনোয়ার জাহিদ/ আবুল হাসান সোহেল ফরিদপুর অঞ্চল থেকে

০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

ফরিদপুর সদর থানার শরীয়তুল্লাহ ও হেলিপোর্ট বাজারে ব্যবসা করেন মো. ইসমাইল ইনকিলাবকে বলেন, আমার আপন ভাগিনা মো. সেজান (২৫) কে গত ৫/৭ মাস আগে সুদে করে টাকা এনে এবং বাড়ীর বহু সম্পদ বিক্রি করে তার আপন ভায়রার মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে পাঠান ৫ লাখ টাকা খরচ করে।
তিনি জানান, মালয়েশিয়া পাঠানোর পর কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করে সেজান। এরপর বেশি টাকা কামাই করার আশায় মালয়েশিয়ান দালাল মো. তবিবরের মাধ্যমে ওখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য আর ১৯ লাখ টাকা জমা দেই। এরপর শুরু হয় বিশাল বাড়ি গাড়ি করার আশায় আটঘাট বেঁধে নেমে পড়া। সেজান জঙ্গলে দীর্ঘদিন দিন চোরাই পথে হাঁটতে হাঁটতে পায় ফোসকা পড়ে যায় তার। তারপর ও খুঁজে পায়নি সোনার হরিণ কেনা স্বপ্ন তথা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথ। জঙ্গলে পাড়ি দেয়ার পর নদীপথে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে পড়ে যায় মাফিয়াদের চক্ররে হাতে। দীর্ঘদিন যাবৎ মাফিয়াদের ঢেরায় অর্ধাহারে অনাহারে থাকতে হয় সেজানকে। পানি তৃষ্ণায় কলিজা ফেটে বের হতে চাইতো। তারপরও একটু পানি দিতো না তারা। পানি চাইলে মাফিয়াদের সহযোগীরা প্রসাব করে মুখের কাছে ধরে আনতো। খেতে না চাইলে মাথায় ঢেলে দিতো। কখন কখনও মুখের উপর থুথু ছিটাতো আবার কখনও শরীরে প্রসাব ছিটিয়ে দিতো। প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত চোখ বেঁধে রাখছিল। সারাদিনে একটি মাত্র আটার রুটি খেতে দিতো। মশার কামড়ে মরে গেলেও ছিল না গ্লোব বা ঔষধ ছিঁটানোর ব্যবস্থা।
অন্ধকার একটি ঘুটঘুটে ঘরে থাকতে দিতে। যেখানে স্বাভাবিকভাবে ১০/১২ জন লোক থাকতে পারে সেখানে থাকতো প্রায় ৪০ জনের মতো। কেউ বসে কাটাতো। কেউ একজন আরেক জনের পায়ের উপর অথবা কেউ কারোর হাঁটুতে ভর করে থাকতো। প্রচণ্ড গরমে কাক ভেজা হতে হতো সবাইকে।
প্রতিদিন তিন বেলা চালতো বিভিন্ন কায়দায় প্রত্যেকের উপর অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের চিত্র ভিডিও বার্তায় পাঠাতো ওর মা-বাবার কাছে। কারো স্ত্রী সন্তানসহ আপন স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে সবার কাছ থেকেই মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করতো।
সেজানের মামা ইসমাইল মামা ইনকিলাবকে আরো বলেন, ভাগিনাকে মোট ৪ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া পাঠাই। অস্ট্রেলিয়ার জন্য ৫ লাখ টাকা দিতে হয়। এরপর ভাগিনার জীবন বাঁচানোর জন্য মুক্তিপণ দিতে হয় আরো ১২ লাখ টাকা। মোট খরচ হয় ২১ লাখ টাকা। কি আজব দুনিয়া। কি নিষ্ঠুর পরিণতি। চাহিদা মতো টাকা না দিলে চলে অমানবিক নির্যাতন।
এখানেই শেষ নয়, মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করার পরপরই ওদের গরুর গোশত এবং মুরগির মাংস দিয়ে বিরানি পোলাও খেতে দিল। এই চিত্র ও আমাদের ভিডিও বার্তায় দেখায়। তখনই একটু শান্তি পাই সবাই। শুধু আমার ভাগি নয় এরকম যতোজন ওর সাথে গেছে এবং ও সাথে যারা মাফিয়াদের হাতে ধরা পড়ছে তাদের সকলেরই চাহিদা মতো টাকা দিয়ে হয়েছে। উল্লেখিত কথাগুলো সেজানের মুখ থেকে শুনে এবং জেনে ইনকিলাবকে বললেন।
দৈনিক ইনকিলাবের সাথে কথা হয় শরীয়তপুরের চেয়ারম্যান বাজারের মো. দিন ইসলামের সাথে তিনি জানান, আমা ছোট ছেলে আলামিন (২৩) কে জায়গা জমি বিক্রি করে নড়িয়ার আদম দালাল মো. কামালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য ১৯ লাখ টাকা দেই। দীর্ঘদিন হয়ে গেল এখন সন্তানের সাথেও কথা বলতে পারি না। দালালেও ফোন ধরে না। কথায় মাদারীপুর শিবচর উপজেলার কুদুবপুর গ্রামের মো. ছালাম মাতুব্বরের সাথে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ভাইজানরা কি আর বলবো, লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্য স্থানীয় দালাল আমীর হোসেনকে ৯ লাখ টাকা দেই। যতোদিন টাকা পরিশোধ হয়নি ততোদিন খুব ভাল আচার ব্যবহার করছে এখন বিদেশেও নেয় না টাকা ও ফেরত দেয় না এমন অবস্থায় ৪/৫ মাস কেটে যাওয়া পর ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে আমাকে ভারতে নিয়ে যায়। ওখানে চুরি করে ২/৩ মাস থাকার পর দালালের সামনেই সন্ত্রাসীরা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন আমাকে বহু কষ্টের কাজ করায় এরপর আমি বাড়ী ফিরতে চাইলে আটক করে রাখে। সেখান থেকে পালাতে গেলে আরও খারাপ লোকের হাতে ধরা পড়ি। তাদের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য মুক্তিপণ দিতে হয় আরো ২ লাখ। এখন বাদাম বিক্রি করে সংসার চালাই। দালালদের নামে মামলাও করতে পারি না বিচারও দিতে পারি না। ভুল করছি আমি মাশুল দেই আমি। মাঝখান থেকে লাখ লাখ টাকা শেষ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে জীবনটা নিয়ে ফেরত আসছি।
ইনকিলাবের সাথে কথা হয়, ফরিদপুর কানাইপুর ইউনিয়নের রেবেকা (২০) বেগমের সাথে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, কি বলবো ভাই বিদেশে পাঠানোর নামে দালাল যতো খারাপ কাজ করে এর কোন শেষ নাই। পাসপোর্ট করতে গেলে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে হয়। আবার লেবান, সউদী আরব ওখানে গেলেও বাসা বাড়িতে বাবা-ছেলেরা মিলে কি না নির্যাতন করে তা মুখে বলতে পারব না। আবার সব দালাল বা জায়গাই খারাপ না। তবে একটা বিষয় পরিস্কার জানতে পেরেছি। যে সব দালালরা খারাপ জায়গায় পাঠায় তারা বেশি টাকা পায় এবং কম মুনাফা হলে তারাও বেপরোয়া হয়ে যায়।
ইনকিলাবের সাথে কথা হয়, চরভদ্রাসন উপজেলার নারিকেল বারিয়া চরের কৈতুরী বেগম (২৩) পিতা. রহমান বেপারির সাথে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ভাই সাহেবরা আমরা সারাদিন রাস্তা ঘাটে কাজ করি একটু সুখে থাকার জন্য। জর্ডান যাওয়ার জন্য দালালের কথা মতো ৬টা ছাগল বিক্রি করে প্রায় ৫৪০০ টাকা দেই। দালাল বিদেশে পাঠানোর নাম করে আমারে ভারতে একটা খারাপ জায়গায় পাঠাইয়া দেয়। ওখানে যাওয়ার পর জানলাম এটা ভারত। কি যে অত্যাচার হইছে। ২ মাস পর একজনের হাতে ধরে পালাইয়া আসি। জেলও খাটি ১০/২১ দিন। ফিরে আসার পর নানান অসুখে ভুগছি।
আগামীকাল ও চোখ রাখুন ১১তম পর্বে। ইনকিলাবের পাতায়। হকারকে বলে রাখুন আপনার কপি রাখতে। জানবেন, দালাল ছাড়াই বিদেশে যাবেন কিভাবে। আপনি কেন দালালের হাতে পড়ে সব খুয়াবেন। (চলবে)


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী
দেশের সাংবিধানিক নাম ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার সুপারিশ
সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা
দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম
আরও

আরও পড়ুন

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

ধূমপানকে না বলুন

ধূমপানকে না বলুন

জালিমের পরিণতি ভালো হয় না

জালিমের পরিণতি ভালো হয় না

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত