মাদারীপুরে মানব পাচারকারী গ্রেফতার হলেও ৩০ সদস্য এখনোও সক্রিয়
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
সাম্প্রতিককালে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলের মাদারীপুর অঞ্চর থেকে কম টাকায় লিবিয়া দিয়ে ইতালি পাঠানোর প্রলোভনে মাদারীপুরে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের একটি সিন্ডিকেট এখন সক্রিয় ও তৎপর রয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
মাদারীপুর অঞ্চলেই অন্তত মানবপাচার চক্রের ৩০ সদস্য তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইতালি, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিরীহ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রথমে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে তারা ইউরোপ গমনেচ্ছুকদের বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়া পাঠায়। গত ৫ বছরে মাদারীপুর অঞ্চলে অন্তত অর্ধশতাধিক যুবক কিশোরের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।
সাম্প্রতিককালে ফরিদপুর ও মাদারীপুর অঞ্চলসহ মধ্যাঞ্চলে মানবপাচারের ঘটনা আশঙ্কাজনভাবে বেড়ে দিয়ে সামাজিক ব্যাধীতে রুপান্তরিত হযে সুশীল সমাজ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। যে কারণে মানবপাচার রোধে র্যাবসহ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বেশ তৎপর হয়ে মানবপাচার চক্রের সদস্য পাকরাও করতে বেশ উদ্যোগী হয়েছে। কম টাকায় ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দিয়ে মাদারীপুর অঞ্চলে মানবপাচারের চক্রের অভ্যায়অরণ্য পরিচ্ছন্ন করার লক্ষে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের বিশেষ আদেশে স্থানীয় প্রশাসন মাঠে কাজ করছে বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যেই মাদারীপুরে মানবপাচারের অভিযোগে একটি মামলাল আসামি টুলু খান (৪২) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে র্যাব-৮। গত ১৬ নভেম্বর রাতে আটক টুলু খানকে মাদারীপুর সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়। মামলা সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার পখিরা গ্রামের রফিক মল্লিকের ছেলে তানভীর মল্লিককে ইতালি পাঠানোর জন্য চুক্তি করেন শরীয়পুরের তুলাতলা গ্রামের টুলু খান। চুক্তি মোতাবেক কয়েক দফায় টুলু খানকে ১২ লাখ টাকা দেয় তানভীরের পরিবার। চলতি বছরের ১৯ জুলাই তানভীরকে লিবিয়ায় পাচারের উদ্দেশে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেন টুলু। পরে তানভীরকে মুক্ত করার জন্য আরো সাত লাখ টাকা আদায় করেন তিনি। যা ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বরে দেয়া হয়। এরপরও তানভীরকে মুক্ত না করে দফায় দফায় নির্যাতন চালায় মাফিয়ারা। আবার নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে আরো টাকা দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। এসময় স্বজনরা বাধ্য হয়ে আরো পাঁচ লাখ টাকা দেয় মানব পাচারকারী চক্রকে। এ ঘটনায় গত ১৩ নভেম্বর তানভীরের ভাই মো. সাগর বাদী হয়ে চারজনের নামে মাদারীপুর মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেন।
ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন আসামিদের নামে মামলা রুজু করতে মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। এরপর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৮ এর একটি দল মামলার প্রধান আসামি টুলু খানকে আটক করে সদর থানায় হস্তান্তর করে। টুলুকে আটক করার খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো অনেকেই থানায় আসেন।
বিভিন্ন ভুক্তভোগী ও স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে দৈনিক ইনকিলাবের অনুসন্ধানে মাদারীপুরে সক্রিয় দালালচক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা হলেন- সদর উপজেলার বড়াইলবাড়ির জামাল খাঁ ও রুবেল খাঁ, শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার, কুমড়াখালীর এমদাদ ব্যাপারি, ধুরাইল ইউনিয়নের চাছার গ্রামের ইউসুফ খান জাহিদ, পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর গ্রামের মহসিন মাতব্বর ও মিজান মাতব্বর, গাছবাড়িয়া গ্রামের নাসির শিকদার, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা গ্রামের জুলহাস তালুকদার, হোসেনপুর এলাকার জাকির হোসেন, টেকেরহাটের লিয়াকত মেম্বার, কদমবাড়ির রবিউল ওরফে রবি, শাখারপাড় গ্রামের কামরুল মোল্লা, এমরান মোল্লা, আমগ্রাম ইউনিয়নের কৃষ্ণারমোড় এলাকার শামীম ফকির, সম্রাট ফকির, শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের শহিদুল মাতব্বর ও সিরাজ মাতব্বর।
অনুসন্ধানে এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে বিদেশ যাত্রাকালে ৫ বছরে নৌকাডুবিতে মাদারীপুরের ৪ উপজেলার (মাদারীপুর সদর, রাজৈর, শিবচর ও কালকিনি) অর্ধশত কিশোর-যুবক মারা গেছেন। নিখোঁজ আছেন কয়েকশ। গ্রামের সহজ সরল কিশোর-যুবকদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন আর রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠাচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ জনের দেশীয় দালালচক্র।
স্বজনরা জানান, প্রথমে লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠায় দালালচক্র। পরে নৌকা বা ছোট ট্রলারে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে যুবকদের বাধ্য করে। এতে প্রাণ হারাতে হয় অনেককে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটে অনেক ঘটনা। বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন আর সেই নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপ পাঠানোর সময় নৌকাডুবিতে মৃত্যু-এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটছে। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগরে। চক্রের সদস্যরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরও লোক পাঠাচ্ছে। আফ্রিকার তিউনিশিয়ার উপকূল ও ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে অভিবাসনপ্রত্যাশী কিশোর-যুবকদের সংগ্রহ করে থাকে। এই দালালচক্রে অনেক নারী সদস্য রয়েছে। এ পর্যন্ত র্যাব ও পুলিশ বেশকিছু নারী-পুরুষ দালালকে গ্রেফতার করেছে। তবুও থেমে নেই অবৈধ পথে মানবপাচার।
এছাড়া দালালদের চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারলে লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন টর্চার সেলে রেখে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়। কখনো কখনো তুলে দেয়া হয় লিবিয়ার মাফিয়াদের কাছে।
মাফিয়ারা নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে এবং হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে বাংলাদেশের দালালদের মাধ্যমে ভিকটিমদের পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে। এমন অনেক পরিবার আছে, যারা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের কাছে এ নিয়ে মুখ খুলতে চায় না। কারণ, তথ্য ফাঁস করে দিলে মাফিয়ারা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলবে।
এই চক্রে বেশ কয়েকজন নারী দালাল রয়েছে। তারা কমিশনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কিশোর-যুবকদের সংগ্রহ করে। গত বছর ৩০ জুন পর্যন্ত র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে সুমি বেগম, দিনা বেগম, নার্গিস বেগম, জুলহাস, হানিফ, সেন্টু শিকদার, জাকির হোসেন, লিয়াকত মেম্বার, নাসিরসহ ১৫ জন।
রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের শাখারপাড় এলাকার পারভীন বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে সুমন মোল্লাকে হাসানকান্দি এলাকায় দালাল হানিফের মাধ্যমে ইতালি পাঠানোর কথা হয়। সেই মোতাবেক সাড়ে ৭ লাখ টাকা হানিফের হাতে তুলে দেয়া হয়। পরে লিবিয়া নিয়ে আমার ছেলেকে কয়েক দফা বিক্রি করে দেয় দালালচক্র। পুলিশের হাতে আটক হয়ে আমার ছেলে সুমনসহ অন্তত ৪৫ জন সেখানকার জেলে আছে। এই দালাল হানিফ শ্রীনদীতে তিনতলা বাড়ি করেছে। এছাড়া সে অনেক টাকার মালিক।
একই এলাকার কেরামত আলী ফকির বলেন, ‘দালাল কামরুল মোল্লা আমার ছেলেকে লোভ দেখিয়ে ইতালি পাঠাতে রাজি করে। মাঝপথে লিবিয়া গিয়ে তিন মাস ধরে আমার ছেলে নিখোঁজ। এ ব্যাপারে রাজৈর থানায় মানবপাচার আইনে মামলা করেছি।’
মাদারীপুরে সচেতন নাগরিক কমিটির সাবেক সভাপতি শাহানা নাসরিন রুবি বলেন, ‘দালালচক্র দীর্ঘদিন ধরে অবৈধপথে মানবপাচার করে এলেও প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রশাসনের উচিত দালালচক্রকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা।’
জানতে চাইলে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘মূলত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অসচেতনার কারণে পাচারের সাথে যারা জড়িত তারা প্রলোভন দেখিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পায়। ফলে পাচারকারী ও মাফিয়াদের কাছে জিম্মি হয়ে নানা দুর্ঘটনার শিকার হয়। ঘটে প্রাণহানীর ঘটনা। এ অবস্থা থেকে বের হলে প্রথমে পরিবারকে সচেতন হতে হবে। এরপর কাজের দক্ষতা নিয়ে বিদেশে বৈধপথে যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ এখন বৈধভাবে তাদের দেশে লোক নিচ্ছে। সুতরাং অসচেতন হয়ে প্রলোভনে অবৈধপথে বিদেশে না যাওয়াই সমীচিন। তাছাড়া শুরুতেই ক্ষতিগ্রস্তরা সহজে অভিযোগ দিতে চায় না। মানবপাচারে কারা কারা জড়িত, তা বের করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। দালালচক্রের তালিকা মতে গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান। (চলবে)
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরও গাজায় হামলা ইসরাইলের, নিহত অন্তত ৩০
জুলাই ঘোষণা : কারা যাচ্ছেন আজকের বৈঠকে
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল
যে সব শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি
এনসিটিবির সামনে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২
নোয়াখালীর সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু আটক
বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪
মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫
সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই
ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের
গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের
শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা
বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা
এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম
বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের
ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?
আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু
বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ