‘আমরা এখন জীবিত লাশ’
১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম
সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করা ছেলেটা নিজের কক্ষে ঘুমিয়েছিলো। আমি নিজেই তার দরজায় নক দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি। তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাসায় অবস্থানরত সদস্যদের হাতে তুলে দেই। তারা সেই যে নিয়ে গেলো ছেলেটাকে আর ফিরিয়ে দিলো না। বাবা হয়ে ছেলেকে এভাবে হায়েনাদের হাতে তুলে দিলাম! এ নিষ্ঠুর যন্ত্রণা আমাকে আমৃত্যু কাঁদাবে। কথাগুলো বলছিলেন, সিভিল এভিয়েশন স্কুলের অংকের সাবেক শিক্ষক রুহুল আমিন চৌধুরী।
পুত্রের খোঁজ না পেয়ে শয্যাশায়ী রোগাক্রান্ত এ বাবা বলেন, তার পুত্রের নাম আদনান হোসেন। তখন সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজ থেকে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন চলছে তার ভর্তির প্রস্তুতি। গত ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের রাত। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম শাহীনবাগের ৬৪০ নম্বর বাড়িতে। হঠাৎ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন লোক বাসায় আসেন।
তারা আদনানের কাছ থেকে একটি তথ্যের জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। রুহুল আমিন বলেন, আমি নিজেই ছেলেকে তাদের হাতে তুলে দেই। আদনান কখন ফিরবে জানতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আসা ব্যক্তিরা জানিয়েছিলো এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা নিজেরাই ওকে বাসায় পৌঁছে দিবে। আমার ছেলে সেই যে গেলো আর ফিরে এলো না। কেউ ফিরিয়ে দিয়ে গেলো না। আদনান স্বেচ্চাসেবক দলের পদপ্রত্যাশী ছিলেন। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক রুহুল আমিন অপেক্ষায় রয়েছেন প্রিয় সন্তান ঠিকই ফিরে আসবে।
শুধু এক আদনানের বাবাই নন। অনেক বাবাই সন্তান হারিয়ে হাহাকার করছেন। অনেকেই হারিয়েছেন সন্তান। আবার অনেকেই হারিয়েছেন বাবা। আর্তনাদ ভাই হারানোর। আর্তনাদ স্বামী হারানোর। কেউ প্রিয়জন হারিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে আসা সদস্যদের হাতে। কেউ হয়েছেন খুন, কেউবা হয়েছেন গুম। স্বজন হারানোর আর্তনাদ চারিদিকে। থামছে না তাদের কান্না। শুকিয়ে গেছে চোখের পানিও। ভূক্তভোগীদের মতে, খুন-গুম ও নির্যাতনের শিকার ভূক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের চোখের পানি যদি এক জায়গায় জমা করা যেত, তাহলে একটি নদী হয়ে যেত। গুম ও খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, নিখোঁজ কিংবা গুমের ব্যাপারে তারা কোনো ধরনের আইনি প্রতিকার নিতে পারছেন না। এমনকি তাদের চাপা কষ্টের কথাও প্রকাশ করতে পারছেন না। বিরোধীদল করার কারণে তাদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে। আমরা একপ্রকার জীবিত লাশ। তবে তারা ওরা এখনো অপেক্ষা করছে হারিয়ে যাওয়া স্বজনরা ফিরে আসবে।
জানতে চাইলে গুম নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, তাদের সংগঠনের হিসাব মতে, গত ১ দশকে দেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৬১৯ জন। রাষ্ট্র এখন সন্ত্রাসী ভূমিকা পালন করছে।
সাজেদুল ইসলাম সুমন। ঢাকা মহানগর তৎকালীন ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার খালার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন। সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, সেদিন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। বসুন্ধরা থেকে ভাই সুমনসহ তার আরও পাঁচ বন্ধুকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ। তার পরিবার জানে না সুমন আজো জীবিত না মৃত।
কাওসার হোসেন। ২৪-২৫ বছরের টকবগে যুবক। পেশায় ছিলেন গাড়ি চালক। নেত্রকোনার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। থাকতেন শাহীনবাগের একটি টিনসেড ভাড়া বাড়িতে। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ওই বাড়ি থেকে রাতে আাইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় কাওসারকে। আজো তার খোঁজ মেলেনি। কাওসারের স্ত্রী বলেন, ছেলের চিন্তা করতে করতে কাওসারের মা মারা গেলেন অকালেই। স্বামী একদিন ঠিকই ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশায় কাওসারের স্ত্রী অন্যের সন্তানকে আরবি শিক্ষার বিনিময়ে সামান্য পয়সায় একমাত্র সন্তান মীমকে বুকে আগলে রেখে এখনো পথ চেয়ে আছেন।
২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর। রাজনৈতিক ছোট ভাইদের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করতে যান বর্তমান ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেলসহ ৫ নেতা-কর্মী। কারাগারের সামনে থেকেই ডিবি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয় সোহেলসহ ৫ জনকে। ১১ দিন পরে ৩ জনকে ছেড়ে দেয়া হলেও সোহেল ও সম্রাটকে আজো ছেড়ে দেয়া হয়নি। তখন সোহেলের ৫ বছর বয়সি ছেলে আরিয়ান এখন দশম শ্রেণির ছাত্র। পিতার স্মুতি তার কিছুই স্মরণে নেই।
এই ৫ জনকে আটকের পর আত্মগোপনে যান সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টু। কিন্তু ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর পল্লবীতে ভাইয়ের বাসা থেকে প্রশাসনের লেঅক পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায় অজানার উদ্দেশে। আজো গুম হওয়া সেলিম রেজা তখন বিয়ের আংটি পরিয়েছিলেন।
এদিকে এভাবে স্বজনহারা মায়েদের কান্নার পর আত্মপ্রকাশ হয় মায়ের ডাক নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের। এই সংগঠনের ব্যানারে ভূক্তভোগীদের পরিবার তাদের হারানো স্বজনদের ফিরে পাবার জন্য আন্দোলন করছে। আজ রোববার মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে গতকাল মায়ের ডাক আয়োজিত জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর জাতীয় প্রেস ক্লাসের সামনে দাঁড়ায় ‘বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের’ পরিবারগুলোর এ প্লাটফর্ম।
সেখানে শিশু সাদিকা সরকার সাফা বলেন, বাবা প্রায় ১০ বছর ধরে নিখোঁজ। বাবা যখন নিখোঁজ হন, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র তিন মাস। ‘আমি বাবাকে কখনো দেখিনি, বাবা বলে ডাকতে পারিনি। আমার একটাই দাবি, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি আর কিচ্ছু চাই না।’
এ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, মানবতার ডাক সরকারের কানে যায়নি। এখন মানুষের সব মানবিক অধিকার হরণ করে, গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করে তামাশা করছে।’
বিএনপি নেত্রী সেলিমা রহমান বলেন, এই সরকার, মানুষের বুকের রক্তের ওপর দিয়ে, মানুষের লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে।’
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকারের নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। গুম-খুন চলছে, বিনা বিচারে হত্যা চলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কিংবা জেলের ভেতরে হত্যাকাণ্ড চলছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গায়েবি মামলা দিয়ে, মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হচ্ছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘কতজনকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, অনতিবিলম্বে তাদের মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেন। যাদের নিখোঁজ করেছেন, তাদের ফিরিয়ে দেন। বর্তমান সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য মানুষকে গুম, হত্যা করছে। অসংখ্য মায়ের বুক খালি করছে। বাবাকে না পেয়ে ছেলেকে ধরছে, ছেলেকে না পেয়ে বাবাকে ধরছে। শুধুমাত্র ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত বাইশ হাজারের বেশি বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় নেতারা এখন জেলখানায়। সারা দুনিয়ার মধ্যে এখন আরেকটা মানবিক বিপর্যয় চলছে এখন বাংলাদেশে।
‘মায়ের ডাকের’ সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, এই সরকার গুম-খুনের বিচার তো করছেই না, উল্টো অন্যায়, অত্যাচার ও গণগ্রেপ্তার চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে, সেটা নেয়ার মতো সাহস সরকারের নেই। আমাদের কথা শোনার মতো সাহসও নেই সরকারের।’
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, দেশে আবার বাকশাল প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে শেখ হাসিনা। আজকে র্যাবকে ডেথ স্কোয়াড হিসেবে আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়। সোয়াটকে আর প্রশিক্ষণ দিবে না যুক্তরাষ্ট্র এগুলোর পেছনে দায়ী বর্তমান সরকার।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতায় চায় না: ইসলামী আন্দোলন
কুষ্টিয়ায় প্লাইউড বোর্ড কারখানায় আগুন
চাঁদাবাজির তকমা থেকে পরিবহন সেক্টরকে বের হতে হবে : শিমুল বিশ্বাস
ফরিদপুরের শ্রেষ্ঠ পুলিশ পরিদর্শক হলেন জাফর ইকবাল
প্রথম ম্যাচের অর্থ পুরস্কার দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের দিলেন ফ্রিটজ
শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট
‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ হতে হবে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি - খেলাফত মজলিস
পাহাড় কাটা মনিটরিংয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার : রিজওয়ানা হাসান
মেট্রোরেলের শুক্রবারের সময়সূচি পরিবর্তন
লৌহজংয়ে বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া ও শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ
নবাব সলিমুল্লাহ অসংখ্য নেতা তৈরির মৌলিকক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন : বাংলাদেশ মুসলিম লীগ
আগামী সপ্তাহে সুইজারল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
নালিতাবাড়ীতে মোবাইল কোর্টে ৭ ব্যক্তির কারাদন্ড
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
গণঅভ্যুত্থানের শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট
কর না কমালে সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট দেয়া সম্ভব হবে না : মন্তব্য খাত সংশ্লিষ্টদের
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
মার্কিন নাগরিক হারুন আসাদ মির্জা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের হোতা
কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওয়েল্ডিং ফোরম্যানের রহস্যজনক মৃত্যু
শিক্ষার্থীদের হৈচৈ নিষেধ করায় আটঘরিয়া কলেজ শিক্ষককে মারপিটের অভিযোগ