অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি
১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:১৬ এএম
দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা এখন চরমে। অস্থিরতার ধাক্কা গিয়ে পড়ছে অর্থনীতিতে। এর প্রভাব বা ধকল দিন দিন প্রকট হচ্ছে। অর্থনীতির সব দিক, খাত-উপখাত ধাবিত হচ্ছে অনিশ্চয়তার পথে। সাধারণ জনগণ ‘ভালো’ নেই। চারদিকে অস্বস্তি, হতাশা, হা-পিত্যেস। জনমনে ক্ষোভ-অসন্তোষ। সুখ-শান্তি উবে গেছে। শিল্পপতি থেকে ফুটপাতের দোকানি সবার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের বিদেশি ক্রেতারা উদ্বিগ্ন তটস্থ। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসছে। অথচ নেই নির্বাচনী ‘উৎসব’। বরং আছে ভয়-শঙ্কা। জনগণের মাঝে হাজারো প্রশ্ন-কৌতুহল, সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থনীতি নামক ‘গাড়ি চলে না- চলে না’ দশায় ঠেকে গেছে। ইতোমধ্যে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশসমূহে বিশেষত তৈরি পোশাক রফতানি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। শ্রমনীতি, আইন-বিধি, গাইড লাইন ঘোষণা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে অর্থনীতিতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। থমকে আছে বিদেশে শ্রমবাজার।
ডলার সঙ্কটে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাজুক দশা। রিজার্ভের পরিমাণ কমছেই। বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। রুগ্ন হয়ে পড়ছে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, লিংকেজ খাত, গ্রামীণ ও প্রান্তিক অর্থনীতির বিভিন্ন উপখাত। কর্মসংস্থান থমকে গেছে। বাড়ছে বেকারত্ব। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে জট নেই। তবে টানা হরতাল অবরোধের কারণে বন্দরমুখী ও বহির্মুখী আমদানি-রফতানি পণ্যের স্বাভাবিক পরিবহণ ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির সর্বত্র মন্দার কালো ছায়া। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির সব সূচক নেতিবাচক বা অবনতিশীল ধারায় যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদগণ বলছেন, স্মরণকালের মধ্যে অর্থনীতিতে বহুমুখী ধস সৃষ্টি হয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও অস্থিরতার কারণে অর্থনীতিতে সমস্যা-সঙ্কট কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা অনিশ্চিত। পরিস্থিতি যতই অবনতির দিকে যাচ্ছে ততই উদ্বিগ্ন-চিন্তিত হচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজসহ আপামর মানুষজন। সবার মুখে মুখে উচ্চারিত প্রশ্ন কৌতুহল, এভাবে চলতে থাকলে এরপর কী হবে!
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিসহ মাঠের বিরোধীদলের আন্দোলন এবং আমেরিকাসহ বিদেশিদের পরামর্শ ও চাপ, ভিসা নীতি, নিষেধাজ্ঞার হুমকি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের অনড় অবস্থানের মধ্যদিয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থা চলে আসছে এক বছর যাবৎ। এর জেরে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপিসহ বিরোধীপক্ষের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, সহিংসতা, পুলিশি ধরপাকড়, নেতা-কর্মীদের কারাগারে বন্দি, হামলা, মামলা, হুলিয়া, অগণিত সংখ্যককে সাজা প্রদান ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এ অবস্থায় সিইসি’র দ্বাদশ সংসদ নির্বচনের তফসিল ঘোষণা এবং আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের ফলে বিএনপি বিহীন ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন হতে চলেছে। এর পাশাপাশি বিরোধীপক্ষের হরতাল, সর্বাত্মক অবরোধ, আন্দোলন অব্যাহত থাকায় একতরফা নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সঙ্কট ও অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
একতরফা সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীপক্ষের লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদ, শিল্প-মালিক ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বৈশ্বিক ও জাতীয় প্রয়োজনের তাগিদে স্থিতিশীলতার বিকল্প নেই। এর জন্য জনগণ তথা ভোটারদের অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। প্রত্যেক সেক্টরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সুশাসন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। অন্যদিকে একতরফা নির্বাচনে তা অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়ে গেছে। রাজনীতিতে অস্থিরতা অশান্তি যতই বাড়ছে অর্থনীতিতে গিয়ে পড়ছে তীব্র বিরূপ প্রভাব-প্রতিক্রিয়া। শহর-নগর, শিল্পাঞ্চল থেকে শুরু করে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। একতরফা নির্বাচনের পরে সঙ্কট ও অস্থিতিশীল অবস্থা আরো ঘোলাটে রূপ নেবে এমনটি শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির সঙ্কট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল শনিবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, অবরোধের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতি স্থবিরতায় আটকে গেছে। এটা অব্যাহত থাকবে। ৭ তারিখের নির্বাচনের আগে-পরে সংঘাত সহিংসতা আরও বেড়ে যাবে। সামনে পুরো মাসেই ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে আনবে অর্থনীতিতে।
মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। রিজার্ভ কমে যাবে আরও। রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। ডলার সঙ্কট ঠেকানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশসমূহে পণ্যসামগ্রীর রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতির কোনো খাতই এখন ‘ভালো’ অবস্থায় নেই। অর্থনীতির সব সূচক নেতিবাচক ধারার দিকে ধাবিত হচ্ছে। খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশ। নির্বাচনে গোলমাল বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হবে। সঙ্কট উত্তরণের জন্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ চবি’র অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ বলেন, অস্থির ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে সবার মাঝে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য দেশ স্বাধীন হয়ে স্বৈরতন্ত্রে ডুবে যাবে? দেশের জনগণ গণতন্ত্র চায়। আমেরিকা গণতন্ত্রের আন্দোলনে সমর্থন দিচ্ছে। তাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে গার্মেন্টসহ রফতানি খাত আরো ব্যাহত হবে। অর্থনীতির উপর ক্ষতির মাত্রা বাড়বে। হরতাল অবরোধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমার সহসা হয়তো শেষ হবে না। জনগণের কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়বে। সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনের পরেও অস্থিরতা তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। পরিস্থিতি শ্রীলংকার চেয়েও খারাপ হয়ে যেতে পারে। জনগণ নিষ্পেষিত হয়ে যাবে। তবুও হয়তো একদিন গণতন্ত্র ফিরে আসবে।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ ছুঁইছুঁই অবস্থানে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও দেশে হরতাল, অবরোধ, সংঘাতের সংস্কৃতি আবারও ফিরে এসেছে। এটা দুঃখজনক। হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনীতির উপর প্রভাব যদি ২০ বা ২৫ শতাংশও ধরি তাহলে একদিনেই ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। দুই মাসে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। উন্নয়ন অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ এসব ঘটনাকে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির ফ্যাক্টর হিসেবে দেখছে। তারা নিবিড় পর্যালোচনা করছে। যা অর্থনীতির উপর মরণব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে রফতানিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরিবহণ খাতসহ প্রতিটি খাতে, স্তরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মজীবী ও শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে তৈরিপোশাক শিল্প-মালিক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে ক্রেতাদের (বায়ার) মধ্যে ভয়ভীতি বিরাজ করছে। যে পরিমাণে পোশাক রফতানি অর্ডার পাওয়ার কথা তা পাচ্ছি না। ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ রফতানি কমে গেছে। আমেরিকায় রফতানিতে ‘গো সেøা’ অবস্থা। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদন-পরিচালন খরচও বেড়ে গেছে। ডেলিভারি পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিরাজমান অনিশ্চয়তা। #
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কুষ্টিয়ায় প্লাইউড বোর্ড কারখানায় আগুন
চাঁদাবাজির তকমা থেকে পরিবহন সেক্টরকে বের হতে হবে : শিমুল বিশ্বাস
ফরিদপুরের শ্রেষ্ঠ পুলিশ পরিদর্শক হলেন জাফর ইকবাল
প্রথম ম্যাচের অর্থ পুরস্কার দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের দিলেন ফ্রিটজ
শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট
‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ হতে হবে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি - খেলাফত মজলিস
পাহাড় কাটা মনিটরিংয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার : রিজওয়ানা হাসান
মেট্রোরেলের শুক্রবারের সময়সূচি পরিবর্তন
লৌহজংয়ে বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া ও শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ
নবাব সলিমুল্লাহ অসংখ্য নেতা তৈরির মৌলিকক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন : বাংলাদেশ মুসলিম লীগ
আগামী সপ্তাহে সুইজারল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
নালিতাবাড়ীতে মোবাইল কোর্টে ৭ ব্যক্তির কারাদন্ড
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
গণঅভ্যুত্থানের শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট
কর না কমালে সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট দেয়া সম্ভব হবে না : মন্তব্য খাত সংশ্লিষ্টদের
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
মার্কিন নাগরিক হারুন আসাদ মির্জা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের হোতা
কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওয়েল্ডিং ফোরম্যানের রহস্যজনক মৃত্যু
শিক্ষার্থীদের হৈচৈ নিষেধ করায় আটঘরিয়া কলেজ শিক্ষককে মারপিটের অভিযোগ
বগুড়ায় সড়কে কিশোর বাইক চালকের মৃত্যু