ভীতি বাড়াচ্ছে অরক্ষিত ফ্লাইওভার
১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম
রাজধানী ঢাকা চলাচলের জন্য দিনদিন অনিরাপদ হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নির্মাণাধীন ভবনের ইট, রড, কাচ, কংক্রিটের ব্লক পড়ে মৃত্যু হচ্ছে পথচারীদের। ঢাকার যনজট কমানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বেশকয়েকটি ফ্লাইওভার। আশা ছিলো এসব ফ্লাইওভার যানজটে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সম্প্রতি এসব এসব ফ্লাইওভার থেকে নির্মাণ সমগ্রী নিচে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আহত হচ্ছে অনেকে। ঢাকার বেশকয়েকটি ফ্লাইওভার আবার একেবারেই অরক্ষিত অবস্থায় থাকে সবসময়। এসব ফ্লাইওভারে মাঝে মাঝে ঘটে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। আর দুর্ঘটনাতো ঘটছে প্রতিনিয়তই এমনাই জানালেন নগরবাসী। দেখভালের দায়িত্ব থাকা কর্তৃপক্ষ ঠিক মতো এসব ফ্লাইওভারের দেখাশোনা করছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।
নগরবাসী বলছেন, উন্নয়নের জন্য যেসব ফ্লাইওভার ও অন্যান্য নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে এসব শুধু চোখের দৃষ্টিতেই উন্নয়ন। মানুষের কাজে আসছে কতটুকু। যে ফ্লাইওভার মানুষের উপকারের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো এখন মৃত্যুকূপ। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের।
এছাড়াও পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে চলাফেরা করার সময়ও বিপদের আশঙ্কা নিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবন থেকে সরঞ্জাম পড়ে প্রাণহানি বাড়লেও দেখার কেউ নেই। যাদের দেখভাল করার কথা, তারা নির্বিকার। কিছু ঘটনায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পান না নিহতের স্বজনরা। অথচ আইন ও ভবন নির্মাণ বিধিমালায় পথচারীসহ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সর্বশেষ গত বুধবার সন্ধ্যায় মগবাজারে নিউ সার্কুলার রোডে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাথায় কংক্রিটের ব্লক পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক দীপান্বিতা বিশ্বাস ওরফে দিপু সানা। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ধারণা করছে, মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে কংক্রিটের ব্লক খসে ফুটপাথের পথচারী দীপান্বিতার মাথায় পড়ে। পুলিশ বলছে, ফ্লাইওভার থেকে যদি কংক্রিটের ব্লক পড়ে নিহত হয়, সেক্ষেত্রের এর দায় সিটি করপোরেশনের। ইট মাথায় পড়ে মারা যান ফুলি বেগম। গত ২৭ আগস্ট বাজারে যাওয়ার সময় প্রাণ হারান হনুফা বেগম। গত বছরের ২৪ এপ্রিল তুরাগের কামারপাড়ায় ইটের আস্তর পার্শ্ববর্তী টিনের চালে পড়লে সেটি ভেঙে সোহাগী আক্তারের শরীরে আঘাত লাগলে তার মৃতু হয়। ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের ৪ নম্বর সড়কে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবন থেকে ইট পড়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী রবিউল ইসলাম জিহাদ নিহত হয়।
অরক্ষিত ও অবহেলা অবস্থায় কাজ করার সময় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। সম্প্রতি রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় দুপুরের দিকে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ করার সময় উপর থেকে প্লেন শিট একটি গাড়ির উপরে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে পথচারী ও স্থানীয়রা বলেন, উপর থেকে রড পড়েছে, কিন্তু এটি ফাঁকা জায়গায় পড়ার কারণে কোনো ক্ষতি হয়নি। নিচে চলাচলরত পথচারীদের উপরে পড়লে হয়ত বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেত। সেসময় এ বিষয়ে ডিএমপি ট্রাফিক উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) নাবিদ কামাল শৈবাল জানান, কয়েকটি টিনের টুকরা বাতাসের কারণে উপর থেকে পড়ে যায়। এমনটাই আমরা জানতে পেরেছি। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, নির্মাণকাজ চলাকালে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো অত্যন্ত দুঃখজনক। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থাসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন নির্মাণ কাজ চলাকালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি সমন্বয় সভাও করেছি। বারবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বিষয়টি কেউ কানে তুলছে না। এখনও টনক নড়ে নাই, আর কত প্রাণ গেলে আমাদের টনক নড়বে? সরকারকে বিব্রত করা যাবে না, জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা যাবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে কোনো নির্মাণ কাজ করা যাবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু এর ব্যত্যয় করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি যে কোনো সময় বিভিন্ন সাইটে পরিদর্শনে যাব, সঙ্গে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা যাবে। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) বলা আছে, নির্মাণকাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাইলনের জাল দিয়ে পুরো ভবন ঢেকে দিতে হবে। সড়কে কমপক্ষে ১ দশমিক ৫ মিটার দূরত্বে নির্মাণাধীন ভবনকে অবশ্যই ২ দশমিক ৪ মিটার বেষ্টনী দিয়ে রাখতে হবে। ভবনের চারদিকে টিন দিয়ে অস্থায়ী ছাদ বানানোর কথাও বলা আছে।
জানা যায়, রাজধানীতে বেশির ভাগ ভবন নির্মাণ করার সময় ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মানা হয় না। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছাড়াই একের পর এক নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। একটি ঘটনা ঘটার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, প্রত্যেকেই এর দায় অন্য সংস্থার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। এসব দেখভালের দায়িত্ব রাজউকের হলেও তারা বলছে, বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ) বিষয়টি দেখাশোনা করে। আবার সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এর দায় ও দেখভাল করার দায়িত্ব রাজউকের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবনের উচ্চতা অনুযায়ী কতটুকু নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে, তা বিধিমালা ও বিল্ডিং কোডে স্পষ্ট করা আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ভবন মালিক ও নির্মাণকারী সংস্থা সেগুলো মানেন না। অনেক সময় অর্থ বাঁচাতে অদক্ষ শ্রমিক ব্যবহার ও অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো দেখভালের জন্য সরকারের যে দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারাও উদাসীন। এ অবস্থার উন্নতি চাইলে নির্মাণকারী ও সরকারি তদারকি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার। সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এদিকে, প্রতিনিয়তই রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে ঘটছে দুর্ঘটনা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীদের। এখানে মোট দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই ঘটছে মোটরসাইকেলে। সড়ক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে থাকে যানজট। সেটি কাটিয়ে ফ্লাইওভারে উঠেই মোটরসাইকেলচালক তার বাইকের গতি বাড়িয়ে দেন। ফ্লাইওভারে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার। তবে অনেক বাইকার ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চালান। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনার হার রাজধানীর অন্য ফ্লাইওভারগুলোর চেয়ে বেশি। আর এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হওয়া ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনির আখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের ফ্লাইওভারে ওঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে।
২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর উদ্বোধনের পর থেকে গত ১০ বছরে মেয়র মোহাস্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠতে-নামতে ও চলতে ছোট-বড় ৭ হাজার ৯৬৪ টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৫০ আহত ও ১ হাজার ১৪৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য রোড।
সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে জানান, কয়েকদিন পর পরই আমরা জানতে পারি রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় নিহতের খবর। এটা দুঃখজনক। সড়কের উন্নয়ন করা হয় সহজ যোগাযোগের জন্য কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এটা মেনে নেয়া যায় না। পৃথক বাইকলেন না থাকা, যথাযথ তদারকি না করা, নিয়ম না মেনে দ্রুতবাহন চালানো ও সিøপারগুলো দুর্ঘটনামুক্ত করার জন্য উপযোগী না হওয়ায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
সাধ্যের বাইরে গিয়ে মা-বাবার চাহিদা পূরণ করা প্রসঙ্গে?
আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন
ইসলামি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানীয় বিজ্ঞানে শীর্ষ দুয়ে ইরান
জাইসের লেন্সের জয়জয়কার, স্মার্টফোনেও দুর্দান্ত
সাগর-রুনি হত্যার বিচারের প্রাথমিক স্তর পরিষ্কার করা দরকার : শামসুজ্জামান দুদু
আন্দোলন সংগ্রামে থাকা নেতাকর্মীদের পিছনে রাখার সুযোগ নেই : আমিনুল হক
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সাথে বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের বৈঠক
যশোরে সাবেক এমপি, এসপিসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা চাওয়া রিটের আদেশ আগামী রোববার
গণহত্যাকারী আ.লীগের সঙ্গে আলোচনা নয় : আসিফ নজরুল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসি’র সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি শুরু
প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে নোবিপ্রবি শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের বেতন প্রদান
সিল্ক রোড উৎসবে ইরানের ‘মেলোডি’
বেনজির ও আজিজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের
৬ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ বাতিল
১৪৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আমীর আলী চৌধুরীর ইন্তেকাল
ভারতের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা
মেজর জে. অব. তারেক সিদ্দিকসহ ১০ জনের নামে মামলা