অস্বাস্থ্যকর বাতাসে বাড়ছে রোগ-বালাই
২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৩ এএম
ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ছেই। গতকালও রাজধানীর বাতাস ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক অনুযায়ী স্কোর ২৯৮ নিয়ে বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল দ্বিতীয়। আর বাতাসের এই মানকে বলা হয় খুবই অস্বাস্থ্যকর। অন্য দিকে স্কোর ৩৩৪ নিয়ে দূষিত শহরের শীর্ষে ছিল ভারতের দিল্লি। আর ওই শহরের বাতাসের এ মানকে বিপজ্জনক বলা হয়।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩। বায়ুমান সূচকে নম্বর ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে গণ্য হয়। নম্বর যত বেশি হবে, মান তত খারাপ। বায়ু মানের স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়।
ঢাকায় বায়ুমানের এই অবনতির মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকে। রাজধানীবাসীর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণেরা ভুগছেন বেশি। চিকিৎসার জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যা চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে সংসারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শীত এলে প্রায়ই বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করে ঢাকা। ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। আর এই বায়ু দূষণের জন্য অতিরিক্ত ধুলাকেই দায়ী করা হয়। এ দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেগুলো দূষণ রোধ করতে পারছে না। ফলে দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়ই শীর্ষস্থানে থাকছে রাজধানী ঢাকা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের বাতাসের মানসূচক (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি জানুয়ারির মোট ৯ দিন রাজধানীর বাতাসের মান দুর্যোগপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে গত ৬ জানুয়ারি থেকে টানা তিনদিন বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ধুলার দূষণে রোগবালাই থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাসাবাড়ি, খাবার-দাবার সবকিছুতেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিশেষ করে ধুলাদূষণের প্রধান উৎস নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো মানছে না সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। ফলে শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করছে ধুলা দূষণ।
প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্পকারখানা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন, এর পর ঢাকার আশপাশের অবৈধ ইটভাটা। বর্তমানে শঙ্কা হলো নির্মাণবিধি না মেনে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধুলাবালি বেশি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না।
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বায়ুদূষণে শিল্পায়নের প্রভাব ও আশপাশের ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণ স্থান হলো ধুলা দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী আনা নেওয়ার সময় বড় বড় মালবাহী গাড়িতে ছাউনি না থাকায় ছড়াচ্ছে ধুলা।
ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়। নির্মাণকাজ চলাকালীন ঠিকাদাররা যেন মাটি ঢেকে রেখে কাজ করে সে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র রেখে পরিবেশ দূষণ করলে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছেন। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় সেটি কম হচ্ছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্প কারখানা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বর্তমানে শঙ্কা হলো নির্মাণবিধি না মেনে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধুলাবালি বেশি হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না।
রাজধানীতে সারা বছরই ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণ ও রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। এসব নির্মাণ কাজের কারণে সবচেয়ে বেশি ধুলা দূষণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এসব নিয়ম পালন করতে তেমন দেখা যায় না। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ ছাউনি বা ঢেকে রাখার নির্দেশনা রয়েছে। একই সঙ্গে ভেতর ও বাইরে নির্মাণসামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনা অনুসরণ না করায় রাজধানীতে ধুলার পরিমাণ বাড়ছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না।
ক্যাপসের গবেষণা বলছে, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে যে এলাকায় পানি ছিটানো হচ্ছে দুই ঘণ্টা পর সেখানের দূষণ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধুলা দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উচিত নির্মাণকাজে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া। যারাই ঢাকা শহরের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী কাজ শেষ করতে হবে। ঢাকা শহরে ১০টি মন্ত্রণালয় ও ৩০-৩৫টি সংস্থা বায়ুদূষণের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন এটার টেকসই সমাধান করতে পারবে না। এজন্য সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, রাজধানী বায়ুদূষণ ও পরিবেশ দূষণ রোধে ইতোমধ্যে আমরা ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এ কর্মপরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে আশা করি রাজধানী ঢাকা একটি সুস্থ্য সুন্দর ও স্মার্ট নগরীতে পরিণত হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি
ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী
সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু
রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে
বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে
বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা
লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই
রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে
দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা
জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ
উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন
সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।
ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার
রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল
‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড
সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড
শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে