ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১
হত্যা ও ধর্ষণসহ নৃশংস ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা বিলম্বিত না করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে : সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অপরাধীদের ছাড় পাওয়া, মাদকাসক্তি ও অর্থনৈতিক কারণে এসব ঘটনা ঘটছে : অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতামত

সামাজিক অবক্ষয়ে বাড়ছে নৃশংসতা

Daily Inqilab সাখাওয়াত হোসেন

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ এএম

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নাঞ্চলে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। গলাকেটে হত্যা করে লাশের টুকরো করা এবং হত্যার পরে লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অপরাধীদের ছাড় পাওয়া, মাদকাসক্ততা ও অর্থনৈতিক কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে বিচার বিলম্বিত সংস্কৃতিও নৃশংস হত্যাকান্ড বাড়ার নেপথ্যে কাজ করছে।
ঋণের টেনশন থেকে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে হত্যার পর আশিকুল হক মোল্লা গলা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আশিকুলের অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। গত শুক্রবার সকালে নীলফামারী জেলা সদরের চড়াইখোলা ইউনিয়নের দারোয়ানী বন্দর বাজার এলাকার নিজ বাড়ি থেকে তহুরা বেগম, তার মেয়ে আয়েশা আক্তার (১১) ও যারিনের (৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গলাকাটা অবস্থায় বাড়ির উঠান থেকে উদ্ধার করা হয় কাঠ ও ফার্নিচার ব্যবসায়ী আশিকুল হক মোল্লাকে। তিনি চড়াইখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আবদুর রউফ মোল্লার ছেলে। ওই বাড়িতে আশিকুল হক স্ত্রী-সন্তাদের নিয়ে বসবাস করতেন।

আশিকুল হকের মামাতো ভাই ও প্রতিবেশী মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এক মাস আগে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন আশিকুল। তখন তাকে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি জানি আশিকুলের ১৮ লাখ টাকার একটা লোন (ঋণ) আছে। এখন সুদসহ কত হয়েছে, আমার জানা নেই। তবে ওই টাকার জন্য সে বেশি টেনশন করত। এ কারণে সে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে, এটা আমার কল্পনায় আসে না।

প্রতারণার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্ধন্ধের জেরে মিলন হোসেন নামে এক যুবককে হত্যার পর লাশ আট টুকরো করা হয়। কুষ্টিয়া জেলা সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে পদ্মা নদীর চর থেকে ওই যুবকের খণ্ড খণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত শুক্রবার রাত ২টায় শুরু করে শনিবার সকাল পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে মিলনের ৮ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সজিব আহমেদ, জনি আহমেদ ও সজল আহমেদসহ চার যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা ব্লাকমেইল (কৌশলে জিম্মি), ফোন নম্বর ক্লোন বা হ্যাক করে বিকাশের টাকা প্রতারণা, অস্ত্র, মাদকসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জতিড়।

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পলাশ কান্তি জানান, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সাজিব, সজল ও জনিসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। তারা সবাই নিহত মিলনের পূর্ব পরিচিতি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটকদের কাছে পাওয়া তথ্য থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, অনেক সময় অপরাধের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়। মানুষের অনিশ্চিয়তা ও হতাশা থেকে হত্যা, আত্মহত্যা ও নৃশংসতার অনেক ঘটনা ঘটে। এমনকি পরকিয়ার জন্যও মানুষ হিংস্র হয়ে নৃশংস অপরাধ করে। প্রতিটি অপরাধের ঘটনাই পুলিশ তদন্ত করে। পরে আদালতের মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন হয়। হত্যা ও ধর্ষণসহ নৃশংস ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা বিলম্বিত না করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা হলেএ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সমাজে প্রায় সময়েই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। কিন্তু এসব অপরাধ নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। নৃশংস ঘটনাগুলো গবেষণা করে পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।

আইজিপি চেীধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণ মানুষকে সাহায্য ও সেবাদান করা পুলিশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব। পুলিশ জনগণের সেবাদানে সবসময় তৎপর থাকে। পুলিশ সে কাজ করে যাচ্ছে। কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর দ্রুত জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতিটি অপরাধের ঘটনাই গুরুত্বের সাথে নিয়ে তদন্ত করে দ্রুত জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ অপরাধ করার পর তার পরিচয় অপরাধী। এখানে ব্যক্তির পরিচয় মুখ্য নয়। অপরাধে সম্পৃক্তদের দমনের জন্য সারাদেশে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মানবাধিকার কর্মী ইনকিলাবকে বলেন, আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ও ভীতি কমে গেছে। তারা (অপরাধীরা) মনে করে খুন করে পাড় পাওয়া যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের মুখোমুখি করতে না পারলে নৃশংস খুন কমবে না। এখন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও মানুষ খুনের মতো কঠিন কাজ করতে পারছে। তিনি বলেন, অপরাধীদের খুঁজে বের করে সঠিত তথ্য প্রমানে ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনতে হবে আইন-শৃংখলা বাহিনীকে। আদালত যাতে অপরাধীর বিচার করতে পারে সে বিষয়টি কেয়াল করতে হবে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। তবেই মানুষ আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল হবে এবং সমাজে নৃশংস ঘটনা কমে আসবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক ইনকিলাবকে বলেন, নৃশংসভাবে মানুষ খুন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর দুর্বলতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য মানুষ নৃশংস হয়ে উঠেছে। সকলের জন্য সমানভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের সকলকেই আইনের প্রতিশ্রদ্ধা ও আস্থা থাকতে হবে। আইন-শৃংখলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে হবে। নৃশংস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গর্ভে থাকা সন্তান মারা গেলে মা-বাবা প্রতিদান প্রসঙ্গে?

গর্ভে থাকা সন্তান মারা গেলে মা-বাবা প্রতিদান প্রসঙ্গে?

হাজীগঞ্জে বিএনপির ২ গ্রুপের সংঘর্ষে কিশোরসহ ৪ জনের অবস্থা গুরুত্বর : আহত ৫০

হাজীগঞ্জে বিএনপির ২ গ্রুপের সংঘর্ষে কিশোরসহ ৪ জনের অবস্থা গুরুত্বর : আহত ৫০

উত্তরপ্রদেশে নেকড়ের পর এবার রাজস্থানে চিতাবাঘের হামলা, দুদিনে নিহত ৩

উত্তরপ্রদেশে নেকড়ের পর এবার রাজস্থানে চিতাবাঘের হামলা, দুদিনে নিহত ৩

কলকাতায় ৪১ দিনের মাথায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার জুনিয়র ডাক্তারদের

কলকাতায় ৪১ দিনের মাথায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার জুনিয়র ডাক্তারদের

দুই রাজ্যে সংঘাত, ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা

দুই রাজ্যে সংঘাত, ২৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকল পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা

ডায়নার সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল দেহ, এবার ধর্ষণে অভিযুক্ত সেই ডোডির বাবা

ডায়নার সঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল দেহ, এবার ধর্ষণে অভিযুক্ত সেই ডোডির বাবা

ভারতে 'এক দেশ এক ভোট’ আয়োজন কতটা সম্ভব হবে?

ভারতে 'এক দেশ এক ভোট’ আয়োজন কতটা সম্ভব হবে?

বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৯

বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৯

কুমিল্লায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায় প্রবাসীর ওপর হামলা

কুমিল্লায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায় প্রবাসীর ওপর হামলা

এবার হলিউডের সিনেমায় জ্যাকুলিন

এবার হলিউডের সিনেমায় জ্যাকুলিন

৯ বছর পর ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি সিনেমা!

৯ বছর পর ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে পাকিস্তানি সিনেমা!

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

‘হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে’: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যানি

‘হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে’: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এ্যানি

ঢাকাস্থ গণচীনের দূতাবাসের প্রতিনিধিদলের ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত

ঢাকাস্থ গণচীনের দূতাবাসের প্রতিনিধিদলের ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত