ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯ আশ্বিন ১৪৩১
পিলখানা ট্র্যাজেডি পিলখানার চূড়ান্ত বিচার দ্রুত শেষ হবে -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

চোখের পানিতে ভিজলো সন্তানের কবর

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম

১৫ বছর আগে দেশের ইতিহাসে নৃশংসতম পিলখানা হত্যাকাণ্ড বহু বাবা-মাকে করেছে সন্তানহারা। সেইসব বাবা-মায়ের চোখের পানি আজও শুকায়নি। দুঃসহ সেই স্মৃতি এখনো তাদের তাড়িত করে অহর্নিশ। মফিজুল ইসলাম সরকার ও মমিনুর নেসা সরকার তেমনই অভাগা বাবা-মা। যারা পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে হারিয়েছিলেন আদরের সন্তান মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারকে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিডিআরের (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আলোচনা ও চর্চায় আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পূর্ণ হলো। তবে এখনো স্বজন হারানোর শোকে ম্যুহমান অনেক পরিবার। তাদের অনেকে যেমন সন্তানহারা, অনেকেই হারিয়েছেন স্বামী, বাবা অথবা স্বজন।

গত রোববার ফজর থেকে জোহরের নামাজের আগ পর্যন্ত শহীদ ব্যক্তিদের রুহের মাগফেরাতের জন্য পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের মসজিদসমূহে খতমে কোরআন আয়োজন করা হয়। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিজিবির সব স্থাপনায় বিজিবি রেজিমেন্টাল পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং বাহিনীর সব সদস্য কালো ব্যাজ পরিধান করেন। সকাল ৯টায় সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় বনানী সামরিক কবরস্থানে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা (সম্মিলিতভাবে), বিজিবি মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের প্রতিনিধি (একত্রে) এবং শহীদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়রা স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া বাদ আসর পিলখানায় বিজিবির কেন্দ্রীয় মসজিদসহ বাহিনীর সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের সব মসজিদ ও বিওপি পর্যায়ে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে ছেলে হারানোর বেদনা এখনো প্রতিনিয়ত কাঁদায় নিহত মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারের বাবা-মাকে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া দুজনেই গত ১৫ বছর ধরে একসঙ্গে ছেলের কবরের সামনে বসে চোখের পানি ফেলেন। নীরবে অঝোরে কাঁদেন। সন্তানহারা এই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কান্না দেখে আত্মীয়-পরিজন, সেনাসদস্য, এমনকি গণমাধ্যমকর্মীদেরও চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। যেন তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন সবাই।

বনানী সামরিক কবরস্থানে প্রবেশ করে বাম দিকের শেষ সীমানার কবরটি মেজর মোহাম্মদ মুমিনুল ইসলাম সরকারের। রোববার ছেলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার। প্রথমে চাপা কান্না পরে আর্তনাদ। বাবার এমন অশ্রুপাতে যেন ভিজে যাচ্ছিল সন্তানের কবরের মাটি-ঘাস। অপলক চোখে তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছেলের কবরের নামফলকের দিকে।

মফিজুলের সঙ্গে সেখানে ছিলেন তার স্ত্রী মমিনুর নেসা সরকারও। তিনিও শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছেলের কবরের পাশে। তার চোখ দিয়েও ঝরছিল শোকের অঝোর ধারা। হাউমাউ করে কেঁদেই যাচ্ছিলেন। একটা চাপা কষ্ট, একটা শূন্যতা, সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার অসহায় আর্তি বৃদ্ধ এ দম্পতি বয়ে বেড়াচ্ছেন গত ১৫ বছর ধরে। সেই চাপা কষ্ট ও বেদনা নিয়ে এবারও তারা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে ছুটে এসেছেন বনানীতে সন্তানের কবরের পাশে। কখনো চিৎকার করে আবার কখনো নীরবে কাঁদছিলেন এই বাবা-মা। পাশে থাকা স্বজনরা বারবার নানা কথার সান্ত্বনায় থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাদের কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। বাবা-মায়ের চোখের জল যেন শোকের বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল সন্তানের কবরের মাটি ও ঘাসে। ৮৬ বছর বয়সী মফিজুল ইসলাম সরকার এখন বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। দীর্ঘ সময় পর কান্না কিছুটা থামলে তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক। কথা বলতে বলতে পরক্ষণেই ভিজে উঠছিল সন্তানহারা এই পিতার স্মৃতিকাতর চোখের পাতা।

মফিজুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, আমার আট সন্তানের মধ্যে মুমিনুল ছিল সবচেয়ে মেধাবী। ছেলে সেনাবাহিনীতে গিয়েছিল। কেউ কখনো ভাবতে পারিনি ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে। ডিকশনারির প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত সব মুখস্থ ছিল তার। সহকর্মীরা বলতো- স্যার থাকলে ডিকশিনারির পাতা উল্টাতে হয় না। আমাদের এলাকার ছোট থেকে বড় এমন কেউ নেই যে মেজর মুমিনুলের নাম শুনলে আফসোস করে না।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছরেও বিচারকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ নিয়ে জানতে চাইলে মফিজুল ইসলাম সরকারের কথায় শুধু আক্ষেপই ঝরে। তিনি বলেন, এই চৈত্রে আমার বয়স ৮৬ বছর পূর্ণ হবে। ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারবো কি না, আল্লাহই ভালো জানেন। আমি জীবদ্দশায় বিচারকার্য দেখে যেতে চাই, এটাই এখন শেষ ইচ্ছা আমার।

অন্য একটি কববের সামনে আবেগাপ্লুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাবিয়া বুশরা। তিনি পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত শহীদ লে. কর্নেল লুৎফর রহমানের কন্যা। বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসে ফাবিয়া বুশরা সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় জড়িত অনেককে গ্রেফতার করা হলেও বিচারের রায় এখনো কার্যকর করা হয়নি। এখন পর্যন্ত কারও ফাঁসি হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পেছনে অনেক শক্তি থাকার কথা। সেই শক্তিগুলো আসলে সামনে আসেনি। যারা মাঠে বসে গুলি চালিয়েছিল তারা কার মদতপুষ্ট হয়ে এ কাজ করেছে, আমরা জানতে চাই। আমরা চিনতে চাই তারা কারা। জানি না আমাদের জীবদ্দশায় এসব সত্য জানতে পারবো কি না। তবে একটাই চাওয়া, অন্তত বেঁচে থাকতে থাকতে যেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারি। যেন জানতে পারি- হত্যাকাণ্ডের পেছনের শক্তি কারা ছিল।

পিলখানা ট্রাজেডিতে নিহত মেজর মোস্তফা আসাদুজ্জামানের ভায়রা আসলাম সেরনিয়াবাত এসেছিলেন কবরে শ্রদ্ধা জানাতে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসি হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আসলাম সেরনিয়াবাত বলেন, বিচারকার্য বিলম্ব হওয়ায় শাহাদতবরণকারী শহীদদের প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে না, তাদের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। ওই সময়ে পিলখানায় বিদ্রোহ চলাকালীন বেশকিছু টেলিভিশন বিদ্রোহীদের ইন্টারভিউ করেছিল। তারা সরাসরি টেলিভশনে কথাও বলেছে। তারা বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছিল। তখনকার ভিডিও সাক্ষাৎকারই যথেষ্ট, এরচেয়ে বড় সাক্ষী হয় না। ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে হয়তো বিচারকার্য শেষ হবে বলে আশা করি। ন্যায়বিচার হলে নিহতদের পরিবারগুলোতে কিছুটা শান্তি ফিরবে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করেন। সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানো হয় ঢাকায় বিডিআর সদর দপ্তরে। এ ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও আছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাকে নৃশংসতম বলে বর্ণনা করা হয়।

পিলখানার চূড়ান্ত বিচার দ্রুত শেষ হবে: রোববার সকালে বনানীর সামরিক কবরস্থানে পিলখানার শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পিলখানায় একটি বড় হত্যাকাণ্ড হয়েছিলো। তদন্ত সম্পন্ন করা একটা বিরাট কর্মকাণ্ড ছিল। এগুলো শেষ হয়েছে। আপনারা দেখেছেন প্রাথমিক একটা বিচার হয়েছে। চূড়ান্ত বিচার হয়তো অল্পদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি। এটা সম্পূর্ণ আমাদের বিচারিক কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে। আশা করছি খুব শিগগিরই চূড়ান্ত বিচারটাও আমরা দেখবো।

নিহতদের অনেক স্বজন বৃদ্ধ হয়েছে, তারা আদৌ বিচার দেখে যেতে পারবে কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমিও সেটি বলি, যাই হোক দ্রুতই হোক। তবে কবে শেষ হবে সেটা বিচারকরাই জানেন। আদালত যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। আপনারা জানেন আমাদের আদালত স্বাধীন। আদালত একটি ন্যায্য বিচার করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে কারো গাফিলতি নেই। আমি আগেই বলেছি এখানে বিরাট ধরণের হত্যাকাণ্ড ছিল। সবগুলো সঠিকভাবে তদন্ত শেষে বড় ধরণের বিচার কার্য ছিল। এই সবগুলোই সময় লেগেছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জাপানকে হারিয়ে উত্তর কোরিয়ার রেকর্ড

জাপানকে হারিয়ে উত্তর কোরিয়ার রেকর্ড

তৌ‌হিদ-জয়শঙ্কর বৈঠক: আলোচনায় যে সব বিষয়

তৌ‌হিদ-জয়শঙ্কর বৈঠক: আলোচনায় যে সব বিষয়

ভারতে পালানোর সময় সীমান্তে আওয়ামী লীগ নেতা আটক

ভারতে পালানোর সময় সীমান্তে আওয়ামী লীগ নেতা আটক

১,০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে ফিরল হারানো বিড়াল!

১,০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে ফিরল হারানো বিড়াল!

গাজীপুরে নারী নিহত : বাসে আগুন

গাজীপুরে নারী নিহত : বাসে আগুন

চোটে মৌসুম শেষ রদ্রির

চোটে মৌসুম শেষ রদ্রির

পরিবেশবান্ধব শহরে পরিণত হচ্ছে শাংহাই

পরিবেশবান্ধব শহরে পরিণত হচ্ছে শাংহাই

জাপানে ভারী বৃষ্টিপাতে নিহত ৬

জাপানে ভারী বৃষ্টিপাতে নিহত ৬

ভারতীয় পেসাররা এখন আকরাম-ইউনিসের সমতুল্য

ভারতীয় পেসাররা এখন আকরাম-ইউনিসের সমতুল্য

লেবাননজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় একদিনেই নিহত ৪৯২

লেবাননজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় একদিনেই নিহত ৪৯২

নতুন স্পাইমাস্টার নিয়োগ দিলো পাকিস্তান

নতুন স্পাইমাস্টার নিয়োগ দিলো পাকিস্তান

মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সিয়াম গ্রেপ্তার

মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সিয়াম গ্রেপ্তার

বার্সা চাইলে ফিরতে প্রস্তুত ব্রাভো

বার্সা চাইলে ফিরতে প্রস্তুত ব্রাভো

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

চোটে পড়ে মৌসুম থেকে ছিটকেই গেলেন টের স্টেগেন

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ইন্টার মায়ামি ছাড়ছেন মেসি?

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

ডেভিস কাপ দিয়ে কোর্টে ফিরছেন নাদাল

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছে না ইউক্রেন

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

গাজা-লেবাননে নিহত আরো ২২২

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান

আসাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুত এরদোগান